অন্যান্যবার রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই হৈ হৈ করে শুরু হয়ে যেত বিশ্বখ্যাত বিয়ার ফেস্টিভাল ‘অক্টোবারফেস্ট'৷ কিন্তু কোথায় কী? প্যারিস-ব্রাসেলস-নিসের পর ভ্যুয়র্ৎসবুর্গ ও আন্সবাখের হামলা যেন নাড়িয়ে দিয়েছে বাভেরিয়ার ভিত৷
বিজ্ঞাপন
এ বছর ১৮৩ বছরে পা দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এই বিয়ার উৎসব৷ তাই সাজগোজ, আলোর রোশনাই আরেকটু বেশিই আশা করেছিল সবাই৷ কিন্তু ইউরোপে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভীত-সন্ত্রস্ত বাভেরিয়া৷ পর্যটকদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে এবার তাই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে মিউনিখ, গোটা মেলাপ্রাঙ্গণ জুড়ে৷
বিশাল এই তাঁবুর প্রতিটি দরজায় বসানো হয়েছে পুলিশ-পোস্ট৷ মেট্রোতে ওঠা-নামার সিঁড়ির সামনে চলছে নজরদারি৷ শুধু তাই নয়, পথে-ঘাটে, তাঁবুর সর্বত্র বসানো হয়েছে সিসিটিভি-ক্যামেরা, চলছে যত্রতত্র তল্লাসিও৷ পর্যটকদের বলা হচ্ছে, বড় ব্যাকপ্যাক আনা যাবে না, ট্রলি তো দূরের কথা৷ এর ফলে মানুষের মনে একটা ত্রাসের যেমন সৃষ্টি হলেও ভিড় হচ্ছে অসম্ভব৷
কিভাবে বুঝবেন, অক্টোবরফেস্ট?
দক্ষিণ জার্মানির মিউনিখ শহরে অক্টোবরফেস্টে যাবার স্বপ্ন কে না দেখে! কিন্তু স্বপ্ন যখন সত্যি হয়, তখন সেটা বোঝা যায় কিছু কিছু লক্ষণ থেকে...৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
ভিড়ে ভিড়াক্কার
অক্টোবরের উৎসব যে ষোলো দিন চলবে, তার প্রতিদিনই মনে হবে যেন সারা দুনিয়া চলেছে ‘মাঠ’ অভিমুখে৷ সেই স্রোতে ভেসে চলে যান, কেননা ভি’জন-এর ষাট লাখ – হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, ষাট লাখ ‘অভিযাত্রী’ তো আর ভুল করতে পারেন না...৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Leonhardt
চলন্ত সিঁড়ি তো নয়, যেন রোলারকোস্টার!
মেট্রো-তেই ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে: ‘মিউনিখ! টেরেসা-র মাঠ! সবাই নেমে পড়ুন!’ এর অর্থ, ঘণ্টায় বারো থেকে সাড়ে বারো হাজার মানুষ এই এস্ক্যালেটর দিয়ে ওপরে উঠবেন৷ চলন্ত সিঁড়ির গতি সাধারণত প্রতি সেকেন্ডে ১৬ ফুট হলেও, অক্টোবরফেস্টের সময় তা আরো কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়৷ ফলে লোকজন সাঁ সাঁ করে টিউব স্টেশন থেকে উৎসব প্রাঙ্গণে পৌঁছে যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Hase
ধৈর্য চাই
মার্চ মাসেই খবরের কাগজে বেরিয়েছিল: ‘ভি’জন-এর তাঁবুগুলোর সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে!’ এখন ‘মাঠে’ পৌঁছালে দেখবেন বিয়ারের তাঁবুগুলোর উপর লেখা রয়েছে: ‘ভিড় বেশি হওয়ায় আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷’ কাজেই লাইন করে দাঁড়ান, আর কী করবেন৷ মনে রাখবেন, শুক্র কি শনিবার রিজার্ভেশন না থাকলে কোনো বিয়ারের তাঁবুতে জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
বিয়ার পরিবেশন, না ভারোত্তলন?
তাঁবুতে ঢুকে দেখবেন, যে মহিলারা বিয়ার পরিবেশন করছেন, তাঁদের পেশীশক্তি ও বাহুবল!একটি বিয়ারের ‘মাগ’-এর ওজন প্রায় দু’কিলো তিন’শ গ্রাম৷ অথচ এই মহিলারা প্রতিবার ১২টি ভরভরতি বিয়ারের ‘মাগ’ বহন করতে পারেন৷ এ বছর আবার এই ‘মাস’ বা এক ‘মাগ’ বিয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে দশ ইউরোর ওপরে, সেই সঙ্গে আছে টিপস৷ ভেবে কি লাভ, চিয়ার্স!
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
বিদেশ থেকে আসেন যারা
অক্টোবরফেস্টের অতিথিদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনই বিদেশি! এদের অধিকাংশই ইটালীয় কিংবা মার্কিনি৷ অস্ট্রেলীয় আর নিউজিল্যান্ডাররা পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে ‘ভি’জন’ দেখতে আসেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PIXSELL/G. Stanzl
বেঞ্চের উপর দাঁড়া নয়, বেঞ্চের উপর নাচা
বিয়ার পানের পর হয়ত দেখলেন যে, নিজেই চেয়ার-টেবিলের ওপরে উঠে নাচতে শুরু করেছেন! পরস্পরের সঙ্গে হাতে হাত গলিয়ে গানের তালে তালে দোলাকে জার্মানে বলে ‘শুঙ্কেল্ন’৷ হঠাৎ খেয়াল করলেন: ‘আরে! আমি তো দিব্যি সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জার্মান গান গাইতে পারছি!’
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
অনন্ত সাপ্লাই
অক্টোবরফেস্টের কিছু বাঁধা খাবার আছে – যেমন ‘ব্রেৎসেল’ নামধারী ‘বান’ কিংবা ‘ভি’জন-হেন্ডল’ নামধারী চিকেন রোস্ট৷ গোটা অক্টোবরফেস্ট জুড়ে প্রায় দশ লাখ ভাজা মুর্গি বিক্রি হয়৷ কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম মানবমেলায় অতিথিরা যে পরিমাণ বিয়ার পান করেন, সে তুলনায় মুর্গিরা নস্যি! অক্টোবরফেস্টে প্রতি বছর মোট ৭০ লাখ লিটার বিয়ার পান করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Streicher
দুনিয়াটা উল্টে গেল নাকি?
না, একে অতটা বিয়ার পান৷ তার ওপর আবার রোলার-কোস্টারে চড়েছেন৷ কাজটা ভালো করলেন কিনা, কে জানে....যাকগে, পরের তাঁবুতে আর একটা বিয়ার খেয়ে নিলেই হলো...৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.-J. Hildenbrand
পরের দিন সকালের খোঁয়াড়ি ও খোয়ারি
পয়সা-কড়ি ফুরিয়েছে৷ মাথাটা ধরে রয়েছে৷ কাল যেন কোথায় গিয়েছিলাম? ও হ্যাঁ, অক্টোবরফেস্টে! মোবাইল ফোনে ঐ ছবিটা – ও-তে কি আমাকে দেখা যাচ্ছে নাকি? সেল্ফি?
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
9 ছবি1 | 9
কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও নেই৷ আসলে অক্টোবরফেস্ট বিয়ার পান করার উৎসব বলে পরিচিত হলেও, বিয়ার পানের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডা, হৈ চৈ করতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন আমোদপ্রিয় মানুষ৷ তাছাড়া যে কোনো মেলার চরিত্র যেমন হয়, তেমনি রঙ্গব্যঙ্গ থেকে নাগরদোলা, নানারকম খাবার-দাবার, জাদুর আসর – সবকিছুরই ব্যবস্থা থাকে অক্টোবরফেস্টে৷ তাই এমন ভিড়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থাকাটাই স্বাভাবিক৷
For the love of beer
00:49
তারপরও শুধুমাত্র বিয়ারের প্রেমে প্রতিবারের মতো এবারো অক্টোবরফেস্টে যোগ দিয়েছে দেশ-বিদেশের প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ৷ রঙিন পোশাক পরে, হাতে হাতে বিয়ারের গ্লাস নিয়ে মেতেছে উৎসবে৷
অক্টোবরফেস্ট এখন এক বৈশ্বিক উৎসব৷ তবে মূল আয়জনটা হয় জার্মানির মিউনিখে৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিয়ার উৎসবের রয়েছে বিশেষ পোশাক, রীতিনীতি৷ চলুন এই উৎসবে নজর কাড়ার কিছু উপায় জেনে নেই৷
ছবি: dapd
ঐতিহ্যবাহী পোশাক
‘ড্রিন্ডেল’ এবং ‘লেডারহোসে’ জার্মান পোশাক হিসেবে গোটা বিশ্বেই পরিচিত৷ তবে অক্টোবরফেস্টে শুধু জার্মানরাই তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে না৷ ছবির এই দলটিতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স এবং চেক প্রজাতন্ত্রের নাগরিকরা৷ তবে পোশাকে তাঁরা জার্মানই বটে!
ছবি: DW/I. Moog
পুরনো স্টাইলে ফেরা
কয়েক বছর আগে কাউকে ড্রিন্ডেল পরতে দেখলে বাকিরা ভ্রুকুটি করতেন৷ এখন আবার ড্রিন্ডেল গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে৷ বিশেষ করে অক্টোবরফেস্ট চলাকালে বিভিন্ন রং, সুতার এবং স্টাইলের ড্রিন্ডেল সব জায়গায় কিনতে পাওয়া যায়৷
ছবি: cc - Florian Schott
ক্ল্যাসিক সংস্করণ
আপনি ঐতিহ্যবাহী, আধুনিক কিংবা কালো রংয়ের ড্রিন্ডেল কিনতে পারেন৷ তবে এগুলোর সঙ্গে মানানসই রঙিন ‘অ্যাপ্রন’ বেছে নিতে হবে৷ আর তখনই পোশাকটি পূর্ণতা পায়৷
ছবি: Getty Images
খরচ আছে
ড্রিন্ডেল যে শুধু দেখতে সুন্দর তা নয়, দামিও৷ মোটামুটি মানের একটি ড্রিন্ডেল কিনতে খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ ইউরো৷ চাইলে আরো দামি পোশাকও কিনতে পারেন৷ এমনকি সিল্কের এবং আসল ‘সোয়ারভস্কি’ পাথর দিয়ে সাজানো ড্রিন্ডেলও রয়েছে৷ তবে সেগুলোর দাম এক লাখ ইউরোর মতো৷
ছবি: Getty Images
আফ্রিকান ড্রিন্ডেল
এই পোশাক জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী হতে পারে৷ তবে ডিজাইনাররা এটির একটি আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন৷ মিউনিখের ‘নো নি’ কোম্পানি ছবির এ সব ড্রিন্ডেলে ব্যবহার করেছেন আফ্রিকার কাপড়৷
ছবি: Dirndl à l´Africaine
দৃষ্টি আকর্ষক
ড্রিন্ডেল বাছাইয়ের পর এর সঙ্গে মানানসই অন্তর্বাস ঠিক করতে হবে আপনার৷ অক্টোবরফেস্টের মৌসুমে বিভিন্ন দোকানে ড্রিন্ডেলের সঙ্গে পরার বিশেষ অন্তর্বাস পাওয়া যায়৷ ড্রিন্ডেল কার্যত যে কারণে বিখ্যাত, সেটা ফুটিয়ে তুলতে এ সব অন্তর্বাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷
ছবি: dapd
এটাও কি দরকার?
শুধু পোশাক নয়, অক্টোবরফেস্টের সাজে সাজতে চাইলে এর সঙ্গে মানানসই অনুসঙ্গও জরুরি৷ যেমন এই কানের দুলটি দেখুন৷ বিখ্যাত হৃদয়াকৃতির ‘জিঞ্জারব্রেড’-এর আদলে তৈরি এই রিং অনেকেই পরেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Leonhardt
মোবাইল জিঞ্জারব্রেড
নিজে এত সুন্দর করে সাজবেন আর সঙ্গের মোবাইলটিকে নগ্ন রাখবেন – তা কি হয়? বরং মোবাইলের জন্য বেছে নিতে পারেন জিঞ্জারব্রেড পোশাক৷ তবে অক্টোবর ফেস্টে মোবাইল ব্যবহার খুব একটা সহজ নয়৷ অনেক মানুষের ভিড়ের কারণে সেখানে সহজে ‘সিগনাল’ পাওয়া যায় না৷
ছবি: Prag Agency
চর্চাটা আগেভাগেই শুরু হোক
এমনকি অক্টোবরফেস্টের সবচেয়ে কম বয়সি দর্শনার্থীও পোশাক সম্পর্কে সচেতন৷ ছবির ছেলেটি ঐতিহ্যবাহী পোশাকের প্যারেডে অংশ নিয়েছে, যা অক্টোবর ফেস্টের একটি অংশ৷ প্রতিবছর গড়ে ৬০ লাখ মানুষ মিউনিখের এই উৎসবে হাজির হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
পোশাক নিয়ে তো অনেক কথাই হলো৷ অক্টোবরফেস্টে যে কারণে যাবেন, সেটার কথা আবার ভুলে যাবেন না যেন৷ সেটা হলো ‘বিয়ার’৷ মিউনিখের অক্টোবরফেস্টে গিয়ে ‘ওয়েট্রেসকে’ সংক্ষেপে ‘কোল্ড লাইট ওয়ান’ বললেই তিনি বুঝে যাবেন যে, আপনি কী চাচ্ছেন৷