সরকার বিরোধী একের পর এক আন্দোলনের ঘোষণা করছে বিরোধীরা। পিছিয়ে নেই অরাজনৈতিক সংগঠনগুলিও। আরজি করে হত্যার বর্ষপূর্তি থেকে আইন কলেজে ধর্ষণ, এ সব ইস্যুতে আন্দোলন কি দাগ কাটতে পারবে?
কলকাতার রাস্তায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে বছরখানেকের মধ্যে। বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে রেখে আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াতে চাইছে বিরোধীরা।
আন্দোলনের ঘোষণা
চলতি মাসে দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে পথে নেমেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এরই মধ্যে আগামী ৯ আগস্ট আরজি করে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার এক বছর পূর্তি হচ্ছে। সেই উপলক্ষে একাধিক কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়েছে।
৯ আগস্ট নবান্ন অভিযানের ডাক দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আরজি করে নিহত চিকিৎসকের বাড়িতে যান। সেখানে চিকিৎসকের বাবা নবান্ন অভিযানের কথা বলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে বিজেপি নেতা শুভেন্দুর ঘোষণা, রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়া সেদিন নবান্ন অভিযান হবে।
আর জি কর আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া অভয়া মঞ্চ কালীঘাট অভিযানের ডাক দিয়েছে একই তারিখে। দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ৯ আগস্ট কালীঘাট চলো কর্মসূচি নিয়েছে অভয়া মঞ্চ।
গত বছরে ১৪ই আগস্ট নারী সুরক্ষার দাবিতে রাত দখলের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা শহরে লাখো নারী মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই কর্মসূচির এক বছর পূর্তি হতে চলেছে। তাই এই স্বাধীনতা দিবসের ঠিক একদিন আগে ফের একই কর্মসূচি ডাক দেয়া হয়েছে।
আইন কলেজে ছাত্রীকে ধর্ষণ : যা হয়েছে, যা হচ্ছে
আরজি করের ঘটনা দেখিয়েছিল, কলকাতার হাসপাতালে নারী সুরক্ষিত নয়। ল কলেজের ঘটনা দেখালো, পথে-ঘাটে তো বটেই, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীরা অসুরক্ষিত।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আবার ধর্ষণ
কলকাতা আছে কলকাতাতেই। আরজি কর নিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, অসংখ্য প্রতিশ্রুতি, সমালোচনার পরও কলকাতায় ধর্ষণ কমেনি। বরং সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ছাত্রীকে প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমানে কলেজের অস্থায়ী কর্মী ও তার দুই সঙ্গীর ধর্ষণ দেখিয়ে দিলো, কলকাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীরা সুরক্ষিত নয়। একসময় নারী-সুরক্ষা নিয়ে গর্ব করা এই শহরের পরিস্থিতি এখন কতটা খারাপ, তা একের পর এক ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ফর্ম ভরতে এসে
ওই ছাত্রী কলেজে ফর্ম ভরতে এসেছিলেন। অভিযোগ, তারপর তাকে অপেক্ষা করতে বলে ধর্ষক ও তার সঙ্গীরা। অনেকক্ষণ তাকে ইউনিয়ন রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তারপর সন্ধ্যায় তাকে জোর করে গার্ডের ঘরে নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। তারপর চলে অকথ্য নির্যাতন। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ভিতরে ধর্ষণ করা হয়। তার ভিডিও তুলে তাকে ভয় দেখানো হয় বলে অভিযোগ। মেয়েটি পরে তার বাড়িতে ফোন করলে তারা পুলিশে অভিযোগ করেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের এফআইআর
কসবা থানার পুলিশের কাছে ধর্ষিতা তিনজন অভিযুক্তর নাম নেন। তবে পুলিশ তিন অভিযুক্তের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে 'এম', 'জি 'ও 'পি'-র বিরুদ্ধে এফআইআর করে। পরে পুলিশ আদালতে জানায় ও আদালতের নথিতে আছে, 'এম' হলো মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র, 'পি' হলো প্রমিত মুখোপাধ্যায় ও 'জি' হলো জাইব আহমেদ। ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। তিন অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কেন এফআইআরে নাম লেখা হলো না?
পুলিশের এফআইআর-এ কেন তিন অভিযুক্তের পুরো নাম লেখা হলো না? কেন তাদের নামের অদ্যাক্ষর লেখা হলো? তাহলে কি কিছু লুকাতে চাওয়া হচ্ছে,এ ই প্রশ্ন ওঠে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার রূপেশ কুমার বলেছেন, ''মেয়েটি পুরো নামই নিয়েছিল। এফআইআর লেখার সময় তা যাচাই করার পর্যায়ে ছিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে পুরো নাম লেখা যায় না। তাই এই সতর্কতা।'' আইনজীবীরা বলছেন, তারা এই ধরনের এফআইআর দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মূল অভিযুক্তর তৃণমূল যোগ
মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ দাস তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। তৃণমূলের ছোট-বড় নেতার সঙ্গে সে নিয়মিত ছবি পোস্ট করত সামাজিক মাধ্যমে। সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে তার খুব প্রতাপ ছিল বলে অভিযোগ। সাবেক ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার অবাধ গতিবিধি ছিল। তাকে অস্থায়ী কর্মী হিসাবেও নিয়োগ করা হয়। কলেজে তার নামে এখনো পোস্টার আছে। কলেজে সে অত্যন্ত প্রভাবশালী বলে পরিচিত। ঘটনার পর তাকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ছাত্র থাকার সময়
মনোজিৎ ছাত্র থাকা অবস্থায় কলেজের প্রিন্সিপালকে সারারাত ঘেরাও করে রাখে। সাবেক প্রিন্সিপাল দেবাশিস চট্টোপাধ্য়ায়ের স্ত্রী নবনীতা টিভি৯কে বলেছেন, ''আমার স্বামী বারবার চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। মনোজিৎ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রেখেছিল। রেজিস্টারকে বলেও লাভ হয়নি। পুলিশে বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।'' প্রশ্ন উঠেছে, কার আশকারায় মনোজিতের এই বাড়বাড়ন্ত?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
একের পর এক প্রতিবাদ
এই ঘটনার পর একের পর এক ছাত্র সংগঠন কসবা থানার সামনে প্রতিবাদ দেখায়। কংগ্রেস, এসএফআই, ডিএসও, ডিওয়াইএফআই-এর তরফে প্রতিবাদ দেখানো হয়.। প্রশ্ন করা হয়, কেন ছাত্রীকে কলেজের ভিতরে ধর্ষণ করা হবে? কী করে এই সাহস পায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা? কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ কিছু বলে না বলেই কি এরকম ঘটনা বারবার ঘটছে।? পুলিশ বলপ্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাতাহাতিও হয়
পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। আরজি করের সময়ও একই ধরনের ছবি দেখা গিয়েছিল। এই ধরনের ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু প্রতিবাদ দেখাতে গেলেই পুলিশের লাঠি জোটে বিক্ষোভকারীদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মশাল মিছিল
রোববার রাতে কলকাতায় মশাল মিছিলও বের হয়। নারীদের সুরক্ষার দাবি, দোষীাদের শাস্তির দাবি নিয়ে সোচ্চার হন বিক্ষোভকারীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অভয়া মঞ্চের মিছিল
রাস্তায় নেমেছিল অভয়া মঞ্চও। আরজি করের ঘটনার পর কলকাতার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দেখিয়েছিলেন। তাদের সেই দাবিপূরণ হয়নি। কিন্তু সেই জোরদার আন্দোলন এখন স্তিমিত। ল কলেজের ধর্ষণের পর সেই অভয়া মঞ্চও রাস্তায় নেমেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মামলা দায়েরের অনুমতি সুপ্রিম কোর্টে
সুপ্রিম কোর্টে সত্যম সিং নামে এক আইনজীবী এই ধর্ষণের ঘটনার সিবিআই তদন্ত চেয়ে মামলা দায়ের করার অনুমতি চেয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে। তিনি মামলা দায়ের করতে পারবেন। তারপর সর্বোচ্চ আদালত ঠিক করবে মামলা খারিজ করা হবে নাকি গ্রহণ করা হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মদন-বচন
তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র বলেছেন, ''ওই মেয়েটি যদি না যেত, তাহলে তো এই ঘটনা ঘটতো না। যাওয়ার সময় মেয়েটি কাউকে বলে গেলে, দুইজন বান্ধবী নিয়ে গেলে এরকম হতো না। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, যে এই খারাপ কাজ করেছে, সে পরিস্থিতির সুয়োগ নিয়েছে।'' এরপর তৃণমূলের তরফ থেকে মদন মিত্রকে শো কজ ক,রা হয়েছে। বলা হয়েছে, তার মন্তব্য, অপ্রয়োজনীয় ও সংবেদনহীন। তিন দিনের মধ্যে জানাতে হবে, তিনি কেন এই মন্তব্য করেছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কল্যাণ বন্দ্যোপাায়ের মন্তব্য
ডানকুনিতে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "লজ্জা ! এতদিন ধরে দল করছি, এখন এসব জিনিস দেখছি । কেন এই ধরনের বিকৃত মনস্ক মানুষ আমাদের দলে থাকবে? তাদেরকে চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া উচিত। কোনো ভুসিমাল দলের মধ্যে রাখবেন না। এমন লোককে বের করে দিলে মানুষ খুশি হবে। কী এমন নেতা সে। পাশ করে চলে গিয়েছে, ওকালতি করে ৷ আবার একটা অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজও করে ? কী করে হয়?" তৃণমূল বলেছে, এটা কল্যাণের নিজস্ব মন্তব্য।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অগ্নিমিত্রা যা বলেছেন
বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল বলেছেন, ''এই মামলার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার দরকার নেই। কারণ, আরজি করের তদন্ত নিয়ে সিবিআই কিছুই করেনি। পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দলই তদন্ত করুক।'' এই ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত কলকাতা পুলিশের নয় সদস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল করছে। বিজেপি বলছে, এটা অগ্নিমিত্রার ব্যক্তিগত মন্তব্য, দলের নয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাইকোর্টেও মামলা
কলকাতা হাইকোর্টেও কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলার বিচার দ্রুত করার আবেদনও জানানো হয়েছে। বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি স্মিতা দাসের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, মামলাগুলি নিয়ে বিরুদ্ধ পক্ষকে নোটিশ দিতে বলেছেন। দিন কয়েকের মধ্যে শুনানি হতে পারে।
ছবি: DW/P. Tewari
এক ছাত্রীর ভাবনা
সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সায়ন্তনী কলাপাত্র ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমাদের দাবি, সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে হবে, বহিরাগতদের ঢুকতে দেয়া যাবে না। ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত ক্লাস করতে হবে।'' তবে রাজ্যের সব কলেজের দাবি এটাই, ছাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। একের পর এক ধর্ষণ, সহিংসতার কাণ্ড হবে, তারপর রাজনীতির খেলায় মূল প্রশ্নটা পিছনে চলে যাবে, এটা হয় না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
16 ছবি1 | 16
অতীতের আন্দোলন
আরজি করে চিকিৎসকের হত্যার পরে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক উদ্যোগে একের পর এক কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। জুনিয়র চিকিৎসকরা দিনের পর দিন অবস্থান ও অনশন করেছেন ধর্মতলায়। বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে অবস্থান করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজ নামে হঠাৎ প্রকাশ্যে আসা একটি সংগঠন নবান্ন অভিযানের ডাক দেয় গত বছর এই অভিযান ঘিরে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই অভিযানের শরিক হয়েছিল সরকারি কর্মীদের সংগঠন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ।
রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা তাদের বকেয়া মহার্ঘভাতার দাবিতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি পথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন, লাগাতার ধরনা অবস্থান করেছেন। তাদের আন্দোলন এখনো চলছে।
আরজি করের পরে সবচেয়ে বড় আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল নিয়োগ দুর্নীতি। সুপ্রিম কোর্টের রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে যায়। এ নিয়ে চাকরিহারারা মাঝেমধ্যেই মিছিল করছেন শহর থেকে জেলায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আগামী বছর পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ।
গত এপ্রিলে ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদে হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঘরে ঢুকে দুই গ্রামবাসীকে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। এ নিয়ে বিজেপি হিন্দু শহিদ দিবস পালন করতে রাস্তায় নেমেছিল। এছাড়া বারবার বিজেপি সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলে রাস্তায় নেমেছে।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনের ফল
আরজি কর কেন্দ্রিক উত্তাল আন্দোলনের পরপরই রাজ্যের ছয়টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছিল। উত্তর থেকে দক্ষিণে রাজ্যের সব প্রান্তে জয়লাভ করেছিল তৃণমূল। ১৩ নভেম্বর ভোটগ্রহণ করা হয়, যখন আরজি কর আন্দোলনের রেশ কাটেনি।
কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া ও নৈহাটি, বাঁকুড়ার তালডাংরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর আসনে উপনির্বাচন হয়। পাঁচটি আসন ধরে রাখার পাশাপাশি মাদারিহাট বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল।
ওয়াকফ নিয়ে অশান্তির পরে গত মাসে নদিয়ার কালীগঞ্জে উপনির্বাচন হয়। সংখ্যাগুরুর ভোটকে একজোট করার ডাক দিয়ে নির্বাচনে ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। সংখ্যালঘু প্রধান হলেও এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট কমে গিয়েছে। ব্যবধান বাড়িয়ে জিতেছে তৃণমূল।
আরজি কর আন্দোলনের মতো এত ব্যাপক অরাজনৈতিক জন বিক্ষোভ স্মরণাতীত সময় পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। তা সত্ত্বেও যদি নির্বাচনে কোনো প্রভাব না পড়ে, তাহলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে হতে চলা রাজ্য বিধানসভা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এ ধরনের আন্দোলন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রামে পৌঁছনো না গেলে আন্দোলনের প্রভাব ভোটবাক্সে দেখা যাবে না।
আরজি করে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন থেকে মামলার রায়
আরজি করে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন করার পাঁচ মাস নয় দিন পর রায় এলো। সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুন
৯ অগাস্ট ২০২৪: কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উদ্ধার হয়েছিল এক নারী চিকিৎসকের দেহ। অভিযোগ উঠেছিল, ওই চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পাঁচ মাস নয় দিন পরে ১৮ জানুয়ারি, শনিবার সেই ধর্ষণ-খুনের মামলায় রায় ঘোষণা হলো শিয়ালদহ আদালতে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিভিক ভল্যান্টিয়ার গ্রেপ্তার
১০ অগস্ট: ঘটনার তদন্তে নেমেই এক সিভিক ভল্যান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআইও তদন্ত চালিয়ে ধৃত সিভিক ভল্যান্টিয়ারকেই ‘একমাত্র অভিযুক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করে আদালতে চার্জশিট পেশ করে। তার দুই দিন পরেই নিহত ছাত্রীর বাড়িতে পৌঁছে তাঁর বাবা, মায়ের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত
১৩ অগস্ট: সিবি আই তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পাঁচ দিনের মাথায় সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকে এই বিষয়ে মামলা শুরু করে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নারীদের রাত দখলের ডাক
১৪ অগস্ট: কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা রাত দখলের ডাক দেন। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নামেন। নজিরবিহীন ‘নাগরিক আন্দোলন’ দেখে কলকাতা সহ সারা দেশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরজি করে হামলা
১৪ অগস্ট: মধ্যরাতেই দুষ্কৃতী তাণ্ডব চলে আরজি কর হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ে। ভেঙে তছনছ করে ফেলা হয় সরকারি সম্পত্তি সহ আন্দোলনকারীদের অবস্থান মঞ্চ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
লালবাজার অভিযান
২ সেপ্টেম্বর: কলকাতা পুলিশ কমিশনারের ইস্তফা চেয়ে মিছিল করে লালবাজার অভিযান জুনিয়র ডাক্তারদের। লালবাজারের দু-শো মিটার আগেই ব্যারিকেড করে আটকে দেওয়া হয় তাদের। সেখানেই অবস্থান শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। অবস্থান তার পরের দিন পর্যন্ত চলে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পুলিশ কমিশনারের কাছে
৩ সেপ্টেম্বর: জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে দেখা করেন। দাবিসনদ-সমেত তার হাতে তুলে দেন একটি ‘প্রতীকী শিরদাঁড়া’।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান শুরু
১০ সেপ্টেম্বর: সলটলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকের জন্য তাদের নবান্নে ডাকেন। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে। লাইভ স্ট্রিমিং না হওয়ায় সেই বৈঠক ভেস্তে যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চে
১৪ সেপ্টেম্বর: হঠাৎ করেই সবাইকে চমকে দিয়ে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্দীপ ঘোষ গ্রেপ্তার
১৪ সেপ্টেম্বরে: ধর্ষণ-খুনের ওই মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আদালতে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিতে না পারায় সন্দীপ এবং অভিজিৎ দু’জনেই জামিন পান। অভিজিতের জেলমুক্তি হলেও সন্দীপ এখনও জেল হেফাজতে রয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সরানো হলে পুলিশ কমিশনারকে
১৪ সেপ্টেম্বর, দুই দিনের ব্যর্থ চেষ্টার পর মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক হয়। সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াই এই বৈঠকে রাজি হন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেখানে খানিক ‘পিছু হটে’ সরকার। সরানো হয় পুলিশ কমিশনার বিনীতকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কর্মবিরতি উঠলো
২০ সেপ্টেম্বর: স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান তুলে কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আমরণ অনমশন শুরু
৫ অক্টোবর: ধর্মতলার মোড়ে আমরণ অনশন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সাত জুনিয়র ডাক্তারের পাশাপাশি বহু মানুষ অনশন মঞ্চে এসে প্রতীকী অনশনে অংশ নেন। ১৯ অক্টোবর অনশন মঞ্চে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ আসেন এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ফোনে কথা বলান। ২১ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দুই ঘণ্টার বৈঠকের পর ১৭ দিনের দীর্ঘ অনশনের অবসানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিবিআইের চার্জশিট
৭ অক্টোবর: ধর্ষণ ও খুনের মামলায় আদালতে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। কলকাতা পুলিশ যে পথে তদন্ত শুরু করেছিল, সিবিআইও সেই পথে হেঁটেই একজনকেই অভিযুক্ত হিসেবে দাড় করায়। ৪ নভেম্বর ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয় এবং ১১ নভেম্বর থেকে শিয়ালদহ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিচার শুরু
১১ নভেম্বর: আরজি কর মামলায় মোট ৫০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে শিয়ালদহ আদালতে। সেই তালিকায় রয়েছেন নিহত চিকিৎসকের পিতা, সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার, কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী অফিসার, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং নিহতের কয়েক জন সহপাঠী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রায় দিলেন বিচারক
১৮ জানুয়ারি: শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বান দাস রায় দিলেন। খুন এবং ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো সঞ্জয় রায়কে। আদালতে বিচারক অনির্বাণ দাস সঞ্জয়কে বলেন, আপনার বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ। আপনার অপরাধ প্রমাণিত। দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এই অপরাধে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাজা যাবজ্জীবন কারাবাস। সোমবার সাজা ঘোষণা করা হবে। সঞ্জয় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি নির্দোষ, তাকে ফাঁসানো হচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
16 ছবি1 | 16
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শুভময় মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "শহরের আন্দোলন গ্রামের মানুষের কাছে কতটা পৌঁছতে পারছে, এই বিষয়টা খুব একটা পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে আন্দোলন গ্রামে পৌঁছতে পারছে না, এটা ধরে নিয়ে শাসক দল যদি ভাবতে শুরু করে এটাকে পাত্তাই দেব না, তারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছে, সংখ্যালঘু ভোট তাদের দখলে আছে, সেক্ষেত্রে বিষয়টা অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেখতে হবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমীকরণগুলি কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখনও সেটা বলার সময় আসেনি। গ্রামবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের জমি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এমন নয়। তবে নির্বাচন একদিনে ঘুরে যেতে পারে। ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে যে প্রচার, তার ফলে মানুষের ভাবনা দ্রুত পরিবর্তনশীল। যদি বিরোধীদের আন্দোলন একজোট না হয়, যার সম্ভাবনা যথেষ্ট, যেহেতু বিজেপি ও বামেদের বোঝাপড়ায় আসা খুব শক্ত, তাহলে শাসকদের বেগ দেয়া কঠিন। সুতরাং রাজ্যের যে ভোট রাজনীতি, তাতে যে বিপুল পরিবর্তন হবে, সেটা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। এখনই ভোট হলে বড় পরিবর্তন কতটা হত, সেটা বলা শক্ত। বলা যেতে পারে, সেই সম্ভাবনা খুব বেশি এখনই নয়।"
সিনিয়র চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "আন্দোলন হলেই ভোটে তার প্রভাব পড়বে, এভাবে বলা যায় না। তবে শহরের মতো গ্রামে আন্দোলনের প্রভাব ততটা পড়েনি, এ কথাটা সত্যি। যদিও অনেক জেলা শহরে ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে। নারী সুরক্ষার দাবিতে আবার এই আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে। এর পিছনে ভোটের ভাবনা নেই, এটা অরাজনৈতিক নাগরিক উদ্যোগ।"
‘এখন বিরোধী ভোট বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস শিবিরে বিভক্ত’
This browser does not support the audio element.
এই আন্দোলন কেন গ্রামকে ছুঁতে পারছে না? কারণ ব্যাখ্যা করে সিনিয়র সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই আন্দোলন শুধু শহর নয়, একেবারে কলকাতা কেন্দ্রিক হয়ে রয়ে গিয়েছে। এটা আন্দোলনের নেতৃত্বের ভুল পদক্ষেপের ফলেই হয়েছে। সে কারণে আরজিকর আন্দোলনের পরে ছটি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল। এরপরে চিকিৎসক আন্দোলনের মুখ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন যখন গ্রামে পোস্টিং নেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা দেখান, তখন তারা গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আরো দূরে সরে গিয়েছেন। যে ইস্যুগুলি আন্দোলনের নেতারা তুলে ধরতে চাইছেন, সেগুলি ভীষণ শহুরে ও এলিট। তাই ক্যানিংয়ের সাবির শেখকে হরিয়ানায় গোরক্ষকরা যখন পিটিয়ে মারে, তখন এদের দেখা যায় না। বাঙালি শ্রমিকদের যখন বিএসএফ পুশব্যাক করে, তখনও এরা কিছু বলেন না। তাই প্রান্তিক মানুষের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।"
আরো একাধিক ফ্যাক্টর রয়েছে বিরোধীদের ব্যর্থতা ও শাসকের নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন,
"মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন সিপিএম বিরোধী সব ভোট এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এখন বিরোধী ভোট বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস শিবিরে বিভক্ত। এছাড়া বিজেপির কারণে সংখ্যালঘু ভোটের প্রায় সবটাই চলে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে। উল্টো দিকে এ রাজ্যে যদি হিন্দু ভোটের অধিকাংশ বিজেপির দিকে যেত, তাহলে সরকার ও প্রধান বিরোধীর মধ্যে ব্যবধান ঘুচে যেত। কিন্তু আমাদের রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির পরম্পরা আছে। ফলে হিন্দু প্রান্তিক মানুষের সব ভোট বিজেপি পাচ্ছে না। এর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সামাজিক প্রকল্পগুলি বিপুল সাড়া ফেলেছে। উপভোক্তারা মনে করেন, মমতা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এটুকু সুবিধাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। একই সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর ক্যারিশমা এবং শাসক দলের সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা বলতে হয়। অনেক অনাচার, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলেও মূলত এইসব কারণে তৃণমূল ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে।"