সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা শর্ত দিয়েছিল, তার সবগুলো পূরণ করা হয়েছে৷ কিন্তু ঢাকায় অবস্থানকারী মার্কিন প্রতিনিধিদল বলছে, ‘প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড স্ট্যাটাস' ফিরে পাওয়ার জন্য আরো বহু কিছু করা দরকার৷
বিজ্ঞাপন
প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড স্ট্যাটাস, অর্থাৎ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত দেশগুলির তালিকা থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়া হয় ২০১৩ সালে, রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর৷ অবশ্য বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক শিল্প বা গার্মেন্টস শিল্প এর থেকে কোনো সুবিধা পায় না৷ অবশ্য সেই শিল্প প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানি করে বছরে ৪০০ কোটি ডলার আয় করে থাকে; চল্লিশ লাখ মানুষ কাজ করেন এই গার্মেন্টস শিল্পে, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত মহিলা৷
বাংলাদেশ সরকার বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছেন, বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্টস রপ্তানির সুবিধা পাবার৷ ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাজরিন ফ্যাশনস ফ্যাকটরিতে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা ধসে পড়ে সব মিলিয়ে মোট দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারানোর পর, স্বভাবতই বিনা শুল্কে গার্মেন্টস রপ্তানির সুবিধা পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে৷
ওয়াশিংটন গত আগস্ট মাসে যে জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস ঘোষণা করে, তা-তে ১২২টি দেশের নাম করা হয়েছে৷ এই সিস্টেমের কল্যাণে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলি কম বা বিনা শুল্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির অধিকার পায়৷ ২০১২ সালে বাংলাদেশ এই জিএসপি-র সুবিধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে তিন কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল – প্রধানত তামাক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, চীনে মাটির বাসন ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
এবার মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটেটিভ-এর কার্যালয় থেকে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছেন কলকারখানায় নিরাপত্তার মান এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সরেজমিনে যাচাই করার জন্য৷ মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ মার্কিন অ্যাকশন প্লানের সব দফা পূরণ করেছে৷ কিন্তু বুধবার মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটেটিভ মাইকেল ডেলনি মন্তব্য করেছেন, মার্কিন প্রতিনিধিরা নিজেরাও অ্যাকশন প্ল্যানের বিভিন্ন দফার খেয়াল রাখছেন এবং সব কিছু দেখে তাঁদের মনে হয়েছে যে, এখনও কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন৷ ডেলনি বলেন, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রগতি অর্জিত হয়েছে; কিন্তু নিরাপত্তা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলিকে হয়রানি থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে আরো বেশি করা দরকার৷
বাংলাদেশ সরকার অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার দরুণ এ যাবৎ মোট ৩৬৪টি গার্মেন্টস ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছেন; শ্রমিক সংগঠন সংক্রান্ত আইনের রদবদল করা হয়েছে; ফ্যাকটরি ইনস্পেক্টরদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে৷ সরকার বলছেন, প্রায় ৫০০ নতুন কারখানা-ভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং স্পেশাল এক্সপোর্ট জোনে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠন করা হয়েছে৷ তবে মূল শ্রমিক সংগঠনগুলিকে গার্মেন্টস সেক্টরে রেজিস্ট্রেশনে বাধা দেওয়া হচ্ছে, বলে শ্রমিক অধিকার আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, যেমন তাদের অভিযোগ যে, অনেক কারখানা-ভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন বস্তুত মালিকদের সৃষ্টি ও মালিকদের মর্জিতেই চলে৷