একে অঘটন বলার চেয়ে নীলনকশা বলাই ভালো৷ রুশ পরিকল্পনার কাছেই হেরেছে স্পেন৷ তাই আর্জেন্টিনা, পর্তুগালের পর দ্বিতীয় রাউন্ডের ঘরের পথ দেখেছে তারাও৷ পেনাল্টি শুটআউটে ৪-৩ গোলে জিতেছে রাশিয়া৷
বিজ্ঞাপন
এ যেন নার্ভের পরীক্ষা৷ শুটআউটের আগে ১২০ মিনিটে ৯০ শতাংশেরও বেশি সঠিক পাস৷ অথচ গোল করতে না পারা৷ রুশ শিবিরের যেন পরিকল্পনাই ছিল খেলাকে টাইব্রেকারে নিয়ে যাওয়া৷ কারণ সেখানে তাদের শক্তি শক্ত দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গোলরক্ষক ইগোর আকিনফ্যিফ৷
সে কাজটা সফলভাবেই করলেন তিনি যখন ১২০ মিনিট শেষে খেলার স্কোরলাইনে ১-১ সমতা৷
টসে জিতে আগে শট নেবার সিদ্ধান্ত স্প্যানিশ অধিনায়ক রামোসের৷ সেই সিদ্ধান্তকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন দলটির কিংবদন্তী মিডফিল্ডার ইনিয়েস্তা৷ তাঁর শট বুঝতেই পারেননি আকিনফ্যীফ৷
রাশিয়ান প্লেমেকার স্মলোভ নেন স্বাগতিকদের পক্ষে প্রথম শটটি৷ বলের অ্যাঙ্গেল ঠিকই বুঝে ফেলে সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তারকা গোলরক্ষক ডে গেয়া ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলের গতির কাছে হেরে গেলেন৷
এরপর স্পেনের ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকে সহজেই পরাস্ত করেন প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে৷ একইভাবে সফল হন রাশিয়ার ইগানশেভিচ৷ এরপরই প্রথম ধাক্কা খায় স্পেন৷ কোকে'র শটটি ঠেকিয়ে দেন আকিনফ্যিফ। কিন্তু রাশিয়ান তারকা গলোভিন ঠিকই পরাস্ত করেন ডে গেয়াকে৷ ফলে ৩-২ গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা৷ এরপর রামোস ও চেরিশেভ নিজ নিজ দলের পক্ষে গোল করলে স্পেনের স্ট্রাইকার আসপাসের সামনে গোল করার বিকল্প ছিল না৷ কিন্তু গোলরক্ষকে ফাঁকি দিয়ে তিনি মাঝ বরাবর শটও নেন৷ কিন্তু ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভুল বুঝতে পেরে শূন্যে থেকেই পা দিয়ে বলের দিক পরিবর্তন করে দেন আকিনফ্যিফ৷ বনে যান রুশদের জয়ের নায়ক৷
ম্যাচের শেষ দিকে গ্রীষ্মের গরমে মস্কোর আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টি যেন শুভবার্তা নিয়ে এসেছিল স্বাগতিকদের জন্য৷ ৮১ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার লুঝনিকি স্টেডিয়ামটির গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ৷
৫-৪-১ ফর্মেশনে খেলা রাশিয়া দল শুরু থেকেই যেন পন করে রেখেছিল আর যাই হোক প্রতিপক্ষকে গোল করতে দেয়া যাবে না৷ সঙ্গে চালাতে হবে পালটা আক্রমণ৷ তাই বল দখল সিংহভাগ লালনীল শিবিরে থাকলেও, নিয়ন্ত্রণ ছিল না৷ যদিও ইসকো'র নেতৃত্বে স্পেনের আক্রমণভাগের চাপে অনেকবারই নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল রুশ ডিফেন্স, কিন্তু দলকে একাধিকবার বাঁচিয়ে দিয়েছেন সেই আকিনফ্যিফ৷
১২ মিনিটে প্রথম গোল পায় স্পেন৷ প্রতিপক্ষের ডিবক্সে ডান দিকে থেকে আসা একটি ক্রস প্রতিপক্ষের জালে ফেলার জন্য তৈরিই ছিলেন তিনি৷ কিন্তু ইগানশেভিচের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে দু'জনই গেলেন পড়ে৷ সেখানে ইগানশেভিচের পায়ের পেছন দিকে লেগে রুশ জাল ভেদ করে বল৷ বেচারা ইগানশেভিচ টেরই পাননি কীভাবে কী হয়ে গেল!
৩৮ মিনিটে স্প্যানিশ ডি বক্সে জেরার্ড পিকে'র উঁচু করা হতে বল লাগলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি৷ সেখান থেকে স্বাগতিকদের মুখে হাসি ফেরান স্ট্রাইকার জুবা৷
আক্রমণের ধার বাড়িয়ে ও সুযোগ তৈরি করেও পুরো ম্যাচে এরপর গোলের দেখা পায়নি স্পেন৷ রেফারির কিছু সিদ্ধান্তের জন্যও হয়ত আক্ষেপ থাকবে তাদের৷
তবে মোদ্দা কথা হলো, দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নিতে হলো ২০১০-এর চ্যাম্পিয়নদের৷
বিশ্বকাপে বেশি গোল করেছেন যাঁরা
বিশ্বকাপ শুরুর আগে বেশি আলোচনায় ছিলেন মেসি, রোনাল্ডো, নেইমাররা৷ তারকাদ্যুতিতে যে অনেক এগিয়ে তাঁরা! কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সে তাঁরা থেকে গেলেন নিষ্প্রভ৷ সেখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল হ্যারি কেন৷ তাঁর পরে কারা?
ছবি: picture-alliance/V.R.Caivano
হ্যারি কেন, ৬ গোল
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতাকে ‘গোল্ডেন বুট’ পুরস্কার দেয়ার চল শুরু ১৯৮২-র আসর থেকে৷ সেবার সবাইকে অবাক করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইটালি৷ আরো অবাক করেছিলেন পাওলো রসি৷ আসর শুরুর আগে যাঁকে কেউ প্রায় চিনতোই না, সেই রসিই পুরস্কারটি জিতেছিলেন প্লাতিনি, জিকো, মারাদোনাদের পেছনে ফেলে৷ এবারের আসরে পানামার বিপক্ষে একটি হ্যাটট্রিকসহ মোট ৬ গোল করায় ‘গোল্ডেন বুট’ জিতে নিলেন ইংল্যান্ডের হ্যারি কেন৷
ছবি: Reuters/C. Barria
গ্রিসমান, ৪ গোল
২০ বছর পর ফ্রান্স আবার চ্যাম্পিয়ন৷ দলকে চ্যাম্পিয়ন করায় গ্রিসমানের অবদান ৪ গোল৷
ছবি: Reuters/A. Vaganov
কিলিয়ান এমবাপে, ৪ গোল
আর্জেন্টিনাকে বলতে গেলে একাই বিদায় করেছেন তিনি৷ ১৯ বছর বয়সি এ ফরোয়ার্ড নিজে করেছেন দুই গোল আর পেনাল্টি আদায় করে আরেকটি গোলেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান৷ ফাইনাল শেষে তাঁর নামের
পাশে লেখা চার গোল৷ এমবাপের মাঝে আগামীর সুপারস্টারকে দেখতে শুরু করেছেন অনেকেই৷
ছবি: Reuters/D. Martinez
রোমেলু লুকাকু, ৪ গোল
বেলজিয়ামের ফরোয়ার্ড লুকাকুও কম যান না৷ ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম দুই ম্যাচে ১৫৩ মিনিট খেলে ৫ গোল করেছেন হ্যারি কেন৷ লুকাকু খেলেছেন তার চেয়েও কম, মাত্র ১৪৯ মিনিট৷ ওই সময়েই আদায় করে নিয়েছেন ৪ গোল৷
ছবি: imago/Photonews/Panoramic
ডেনিস চেরিশেভ, ৪ গোল
রাশিয়ার এই মিডফিল্ডারও করেছেন ৪ গোল৷ তবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে করা গোলটিই ছিল এ আসরে তাঁর শেষ গোল৷ কারণ, সেই ম্যাচ টাইব্রেকারে হেরে যাওয়ায় তাঁর দেশ রাশিয়ার জন্য শেষ হয়ে গেছে বিশ্বকাপ অভিযান৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, ৪ গোল
পর্তুগালের প্রথম তিন ম্যাচ শেষে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর নামের পাশেও লেখা হয়ে যায় ৪ গোল৷ তারপর অবশ্য আর গোলের দেখা পাননি৷ তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের বাসনা অপূর্ণ রেখেই উরুগুয়ের কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে পর্তুগাল৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
এডেন হ্যাজার্ড, ৩ গোল
বেলজিয়ামের হ্যাজার্ড ৭ ম্যাচে করেছেন ৩ গোল৷ দলের সাফল্যে তাঁর অবদান অবশ্য তার চেয়ে অনেক বেশি৷ মধ্যমাঠে দলের মধ্যমণিই ছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/V.R.Caivano
মারিও মানসুকিচ, ৩ গোল
ক্রোয়েশিয়ার এই ফরোয়ার্ডও সাত ম্যাচ খেলে করেছেন ৩ গোল৷
ছবি: picture-alliance/GES/M. Gilliar
ইভান পেরিসিচ, ৩ গোল
মদ্রিচ, মানসুকিচের মতো ক্রোয়েশিয়ার ইভান পেরিসিচের খেলাও এবার সবার নজর কেড়েছে৷ ৭ ম্যাচে তিনিও করেছেন ৩ গোল৷
ছবি: Reuters/D. Staples
এডিনসন কাভানি, ৩ গোল
প্রথম রাউন্ডে একেবারেই নিষ্প্রভ ছিলেন তিনি৷ তিন ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ১ গোল৷ কিন্তু ঠিক সময়েই জ্বলে উঠে উরুগুয়েকে তুলে দিয়েছেন কোয়ার্টার ফাইনালে৷ কাভানির জোড়া গোলের কারণেই রোনাল্ডোর আশাভঙ্গ হয়েছে, বিদায় নিয়েছে পর্তুগাল৷
ছবি: Reuters/T. Hanai
আর্টেম জিয়ুবা, ৩ গোল
রাশিয়ার এই ফরোয়ার্ডে প্রথম রাউন্ড শেষ করেছিলেন দুই গোল নিয়ে৷ কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনকে বিদায় করা ম্যাচে এক গোল করায় তিনিও উঠে এসেছে স্বদেশী চেরিশেভের পাশে৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
ইয়েরি মিনা, ৩ গোল
খামেস রদ্রিগেস দলে থাকতেও এবার কলম্বিয়ার ইয়েরি মিনা নজর কেড়েছেন৷ দ্বিতীয় রাউন্ডে ইনজুরির জন্য খেলতে পারেননি রদ্রিগেস৷ মিনার গোলেই ম্যাচে সমতা ফিরিয়েছিল কলম্বিয়া৷ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচ টাইব্রেকারে হেরে যাওয়ায় অবশ্য সেখানেই শেষ হয়ে যায় কলম্বিয়া আর মিনার ২০১৮-র বিশ্বকাপ মিশন৷
ছবি: Reuters/C. Garcia Rawlins
দিয়েগো কস্তা, ৩ গোল
পর্তুগালের বিপক্ষে তিনি যেন রোনাল্ডোর সঙ্গে গোল করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন৷ তবে কস্তা দুই গোল করে থামলেও রোনাল্ডো থেমেছেন শেষ মুহূর্তের গোলে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে৷ প্রথম রাউন্ড শেষ করেছিলেন তিন ম্যাচে তিন গোল নিয়ে৷ তারপরই স্পেনের বিদায় এবং কস্তার জন্যও বিশ্বকাপ আপাতত শেষ৷
ছবি: Reuters/L. Nicholson
জন স্টোনস, ২ গোল
এই তালিকায় জন স্টোনসের নামটা কিন্তু বিস্ময় জাগানোর মতো৷ ডিফেন্ডার হয়েও ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন ২ গোল৷ পানামাকে ৬-১ গোলে হারিয়ে এ আসরে প্রথম রাউন্ডে সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ডটি গড়েছে ইংল্যান্ড৷ সেই ম্যাচেই দুই গোল করেছিলেন স্টোনস৷
ছবি: Reuters/M. Childs
ফিলিপে কুটিনিয়ো, ২ গোল
নেইমার যখন গোলের দেখা পাচ্ছেন না, তখনই ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলেন কুটিনিয়ো৷ প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিলের একমাত্র গোলটি এসেছিল তাঁর পা থেকেই৷ কোস্টারিকা ম্যাচেরও গোল-বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছিলেন প্রথম পর্বের পারফর্ম্যান্সে নেইমারসহ অনেক বড় তারকাকেই ছাড়িয়ে যাওয়া এই মিডফিল্ডার৷
ছবি: Reuters/D. Staples
মোহামেদ সালা, ২ গোল
ভক্তদের অনেক আশা ছিল তাঁর কাছে৷ কিন্তু ইনজুরির কারণে বেশি কিছু করতে পারেননি মিশরের মোহামেদ সালা৷ দুই ম্যাচ খেলে করেছেন দুই গোল৷
ছবি: Reuters/H. Romero
আরো যাঁদের ২ গোল
ব্রাজিলের নেইমার, জাপানের তাকাশি ইনুই, নাইজেরিয়ার আহমেদ মুসা, ক্রোয়েশিয়ার লুকা মডরিচ, উরুগুয়ের লুই সুয়ারেজ, সুইডেনের আন্দ্রেয়াস গ্রাঙ্কভিস্ট, আর্জেন্টিনার আগুয়েরো, দক্ষিণ কোরিয়ার সন হিউংমিন, টিউনিশিয়ার খাজরি আর অস্ট্রেলিয়ার জেডিনারও করেছেন দু’টি করে গোল৷
ছবি: Reuters/C.G. Rawlins
পারলেন না মেসি
এবারও বিশ্বকাপ জেতা হলোনা লিওনেল মেসির৷ দ্বিতীয় রাউন্ডেই আর্জেন্টিনার ৪-৩ গোলে হেরে গেছে ফ্রান্সের কাছে৷ মেসির বিশ্বকাপ মিশনও শেষ হয়েছে মাত্র ১ গোল নিয়ে!