ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল রাশিয়া সফরে গেলেন। এ মাসের শেষে যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর।
ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির পর অজিত ডোভালের রাশিয়া সফরের মধ্যে একটা স্পষ্ট বার্তা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।ছবি: Tauseef Mustafa/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনে, তাহলে ২৫ শতাংশ শুল্কের অতিরিক্ত জরিমানাও দিতে হবে। রাশিয়া নিয়ে ট্রাম্পের এই চাপের পরেও অজিত ডোভাল তার পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল না করে মস্কো গেছেন। সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, তিনি সেখানে অস্ত্র ও তেল কেনা নিয়ে কথা বলবেন।
সোমবারই ট্রাম্প বলেছেন, ''বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে ভারত ভালো নয়। তারা আমাদের সঙ্গে প্রচুর বাণিজ্য করে, কিন্তু আমরা ওদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারি না। তাই আমরা ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছি। আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই শুল্কের পরিমাণ আরো অনেকটাই বাড়িয়ে দেব। কারণ, ওরা রাশিয়ার তেল কিনছে। তারা রাশিয়ার ওয়ার মেশিনকে জ্বালানি যোগাচ্ছে। ওরা যদি এটা করে, আমি খুশি হব না।''
ট্রাম্পের অভিযোগ, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনে লাভ করছে, আর ইউক্রেনের রাশিয়ার ওয়ার মেশিন মানুষকে হত্যা করছে।''
ঠিক এই পরিস্থিতিতে অজিত ডোভালের রাশিয়া যাওয়া এবং তেল ও অস্ত্র কেনা নিয়ে কথা বলার মধ্যে একটা বিশেষ বার্তা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা জানাচ্ছেন, ভারতও একটা বার্তা পাঠাতে চাইছে।
বিশ্লেষকরা যা মনে করেন
ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত লেফটোন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ‘‘অবশ্যই এর মধ্যে একটা বার্তা আছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনে। রাশিয়া থেকে আমরা এস ৪৪ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নিয়েছি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাতের সময় এস ৪০০-র কার্যকারিতা দেখেছি। এই এস ৪০০-র পুরো কনসাইনমেন্ট পাঠানো নিয়ে কথা হবে।''
তবে উৎপল ভট্টাচার্য মনে করেন, ''এফ ৩৫ কেনা বা না কেনার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত আগে এফ ৩৫ নেবে বলে ঠিক ছিল। কিন্তু সেটা নেওয়া হয়নি।''
ট্রাম্পের শুল্কের চাপ বিশ্বব্যাপী যেমন প্রভাব ফেলতে পারে
ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ছবিঘরে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কোথায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তার বিস্তারিত...
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
শুল্কের ঘোষণা
২ এপ্রিল বিশ্বের সব দেশের পণ্য আমদানির উপর নানা হারে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ঘোষণার এক সপ্তাহ পর অবশ্য চীন, ক্যানাডা ও মেক্সিকো ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলোর উপর আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন ট্রাম্প৷ ৯০ দিন পর যদি এই শুল্ক তিনি আবার আরোপ করেন, তাহলে ভোক্তা পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি- সব জায়গাতেই এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের৷
ছবি: Jim Lo Scalzo/UPI Photo/Newscom/picture alliance
মার্কিন শুল্কের ইতিহিস
অ্যামেরিকার বাণিজ্যের শুরুর দিক থেকেই শুল্ক আরোপের ইতিহাস রয়েছে৷ দেশটি ১৮২০ সালে বিদেশি পণ্যের উপর ৩০ ভাগের মতো শুল্ক আরোপ করেছিল৷ ১৯৩০ সালে ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর গঠনের পর থেকে শুল্ক কমাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র৷ ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুল্ক নিয়ে চীনের সাথে বাদানুবাদ শুরু হয়৷ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে, অর্থাৎ, ১৮২০ সালের দুইশ বছর পর মার্কিন শুল্কের হার আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে৷
ছবি: Liu Jie/Xinhua/IMAGO
শুরু হয় ‘শুল্ক-যুদ্ধ’
ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করে, যা আগে ছিল ৩৪ শতাংশ৷ পাল্টা জবাব দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ চীনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ট্রাম্পের প্রাথমিক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের উপর শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নও৷ যদিও ট্রাম্পের স্থগিতাদেশের ঘোষণায় পিছু হটে ইইউ৷
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
তেলের দাম, শেযার বাজার
ট্রাম্পের ঘোষণার সাথে সাথেই অস্থিরতা দেখা যায় তেল ও শেয়ারের বাজারে৷ তেলের দাম কমেছে প্রতি ব্যারেলে ৫০ ডলার পর্যন্ত৷ ভয়াবহ পরিস্থিত তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারে৷ মন্দার আশঙ্কায় ট্রাম্পের ঘোষাণার প্রথম দুই দিনে শুধুমাত্র মার্কিন শেয়ারবাজার ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে৷
ছবি: Mark Ralston/AFP
অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা
পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হলে চলতি বছরের শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান জে পি মর্গ্যান জানায়, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পর চলতি বছরের শেষ নাগাদ মন্দার শঙ্কা ৬০ ভাগে দাঁড়িয়েছে৷ অর্থনৈতিক মন্দা চরম পর্যায়ে গেলে ভূগতে হবে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকেই৷
ছবি: Gregor Fischer/Getty Images
প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা
শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়বে আমদানি-রপ্তানিতে৷ এর ফলে বিভিন্ন দেশের আশানুরূপ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে৷ ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ইউরোপের দেশ ইটালি চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক দুই থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ছয়-এ নামিয়ে এনেছিল৷ অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ফলে চলতি বছর জার্মানির জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক এক ভাগে নেমে আসতে পারে৷
ছবি: natatravel/Depositphotos/IMAGO
ক্রেতাদের ভোগান্তি
শুল্ক আরোপের প্রভাব পণ্যের দামের উপর পড়বেই৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রবেশে অধিক শুল্কের মাশুল সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলবে৷ শুধু তাই নয়, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন শুল্ক বাড়ানোয় তার প্রভাবও ক্রেতাদের উপর পড়বে৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/IMAGO
ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদন
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাণিজ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এমনটাই মনে করেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনাভির্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জান-ইন চোং৷ এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী পণ্যের চাহিদার উপর প্রভাব ফলেবে, যার প্রভার পড়বে উৎপাদনে৷
ছবি: CFOTO/NurPhoto/IMAGO Images
বাজারে অবস্থান হারাতে পারে অনেক দেশ
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যাদের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, সেই দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাজারে তাদের অবস্থান হারাতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের৷ এর প্রভাব এমন দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে পড়তে পারে৷
ছবি: Joy Saha/ZUMA Press Wire/picture alliance
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্য জোটে প্রভাব
বাণিজ্য ক্ষত্রে অনিশ্চিয়তা ফলে অনেক দেশ নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী খুঁজে পাওয়ার দিকে ধাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের৷ এরই মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে চীনের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে অনেক দেশ- এমনটাই দাবি সিঙ্গাপুরের গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস-ইউসোফ ইশাক ইনস্টিটিউটের এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিনা ফং৷
ছবি: Ute Grabowsky/photothek/picture alliance
অসমান্তরাল বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে যেমন ক্ষতির মুখে ফেলবে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ঠিক ততটাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ এক নিবন্ধে বিজনেস হার্ভার্ড রিভিউ ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ৩৬০ ডিগ্রির বাণিজ্য যুদ্ধ বলে মন্তব্য করে৷
ছবি: Anna Moneymaker/Getty Images
11 ছবি1 | 11
এফ ৩৫-এর বিকল্প হলো রাশিয়ার এসইউ-৫৭
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, ভারত এফ ৩৫ কিনছে না। এই অবস্থায় তাদের সবচেয়ে ভালো বিকল্প রাশিয়ার এসইউ-৫৭। রাশিয়াও ভারতের বিমান বাহিনীকে 'গোল্ডেন ডিল' অফার করেছে। সেটা হলো, এসইউ-৫৭ই-র উৎপাদন ভারতেও হতে পারবে। এসইউ-৩০ এমকেআই তৈরির যে পরিকাঠামো আছে, তাকে কাজে লাগিয়েই এসইউ-৫৭ বি-র উৎপাদন করা যেতে পারে।
ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার অঙ্গ হিসাবে এসইউ-৫৭এস কেনা ও প্রযুক্তি সহায়তা নিয়েও কথা হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন চাপে তা স্থগিত ছিল। এখন যদি ভারত এসইউ-৫৭ কেনে তাহলে আরো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে বা রপ্তানি নিয়ে আরো কড়াকড়ির মুখে পড়তে হতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল অনিল চোপড়া ইউরেশিয়ান টাইমসকে বলেছেন, ''ট্রাম্প ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে একটা বার্তা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এখন পাকিস্তানকে সুবিধা দিচ্ছে, এই অবস্থায় ভারতের অ্যামেরিকার কাছ থেকে কোনো সাজসরঞ্জাম কেনা উচিত নয়। আমরা এটা আগেও দেখেছি। অ্যামেরিকা বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার নয়। কে জানে, তারা ভবিষ্যতে কোন পথ নেবে এবং আমাদের উপর আরো শুল্ক বসাবে না?''
তিনি বলেছেন, ''ওরা ১৮ মাস দেরিতে জিই ৪০৪ ইঞ্জিন সরবরাহ করছে, ফলে আমাদের তেজস যুদ্ধবিমানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।''
উৎপল ভট্টাচার্য বলেছেন, ''ভারত তো জানিয়েছে, অ্যামেরিকাও রাশিয়ার কাছ থেকে অনেক কিছু কিনছে। এখন দেখা যাচ্ছে ট্রাম্পের সিলেকটিভ অ্যামনেশিয়া হয়েছে।''
বিজ্ঞাপন
'ভারত-রাশিয়া সংকটের সময় একে অপরকে সাহায্য করে'
কূটনীতি বিশেষজ্ঞ এবং দ্য টেলিগ্রাফ ও আউটলুকের কূটনৈতিক সম্পাদক প্রণয় শর্মা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''ট্রাম্প যা করছেন, তা ঠিক নয়। তিনি পণ্য বিক্রি করবেন কিনা, শুল্ক বসাবেন কিনা, সেটা তার বিষয়। সাধারণত, কোনো দেশ আলোচনার সময় জানিয়ে দেয়, তারা কী করবে। কিন্তু ট্রাম্প হঠাৎ হঠাৎ নতুন জিনিস করে যাচ্ছেন। যার ফলে অসুবিধা হচ্ছে। অ্যামেরিকা ও ইউরোপ আজও রাশিয়া থেকে বহু জিনিস কেনে। তাই তাদের অন্যের দিকে আঙুল তোলার কোনো অধিকার নেই।''
প্রণয় বলেছেন, ''ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক বহুদিনের ও খুব কাছের। রাশিয়া সবসময় ভারতের পাশে থেকেছে। ভারত যখনই সমর্থন চেয়েছে, তখনই পেয়েছে। ভারতও একই কাজ করেছে। ২০১৪তে সংকটের সময় ভারত ক্রাইমিয়া নিয়েও রাশি্য়াকে সমর্থন করেছে। চীন এখনো ক্রাইমিয়া নিয়ে রাশিয়াকে সমর্থন করে না। ভারত সমর্থন করার পর ক্রেমলিন তাদের ওয়েবসাইটে তা দেয়।''
প্রণয় মনে করেন, ''এখন ভারত আবার বার্তা দিয়েছে যে, রাশিয়া তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অ্যামেরিকা চাপ দিলেও তারা রাশিয়ার কাছ থেকে সরবে না। ডোভালের সফর পূর্বনির্ধারিত হলেও তার মধ্যে এই রাজনৈতিক বার্তা আছে।''