বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আমফান শক্তি বাড়িয়ে ‘অতি প্রবল’ রূপ ধারণ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, ঝড়টি আরও শক্তিশালী হয়ে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে৷ তখন ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ২৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে৷
আগামী বুধবার বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ আমপানপশ্চিমবঙ্গের দীঘা এবং বাংলাদেশের হাতিয়ার মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ৷ উপকূলে উঠে আসার সময় সেটির সামান্য শক্তিক্ষয় হবে৷
ঝড়টির উপকূলে উঠে আসার সময় নিয়ে ভারতের আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেছেন বলে জানায় ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷
আবহাওয়াবিদদের মতে, মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঘূর্ণিঝড় আমফান৷
ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার বেগে উত্তর দিকে এগিয়ে এসে সোমবার বাংলাদেশ সময় বেলা ১২টার দিকে আমফান পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছিল৷
এক দশকের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা৷ এক নজরে দেখে নিন গত এক দশকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলি...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
ক্যার ও মাহা, ২০১৯
চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মাহা ও ক্যার৷ এর আঁচ এসে পড়ে ভারত-বাংলাদেশ টি টুয়েন্টি ক্রিকেট সিরিজেও৷ বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯৬৫ সালের পর এই প্রথম একসাথে দুটি ঘূর্ণিঝড় একসাথে অনুভব করছে ভারত৷
(প্রতীকী ছবি)
ছবি: IANS
ফেনী, ২০১৯
ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ওড়িষার উপকূলে কেন্দ্রবিন্দু থাকা এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সীমিত থাকেনি ভারতে৷ বাংলাদেশেও আসে তার প্রভাব৷ ১৯৯৯ সালের পর থেকে ওড়িষার উপকূলের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি৷ মোট ক্ষয়ক্ষতি ছিল ৭০ কোটি টাকার সমান৷
ছবি: AFP/M.U. Zaman
তিতলি, ২০১৮
গত বছর অক্টোবর মাসে ভারতের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় তিতলি৷ নাসার তথ্য অনুযায়ী, এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা থেকে মাত্র ৩১২ মাইল দূরে৷ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছিলেন, এই ঝড় বাংলাদেশে এসে ঢুকবে৷ কিন্তু তা না হয়ে শেষ মুহূর্তে ঝড়টি পথ বদল করে চলে যায় দক্ষিণের দিকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
অক্ষী, ২০১৭
দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা এই ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করেছিল বাংলাদেশ৷ ২০১৭ সালের এই ঝড় বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে জন্ম নিয়ে দক্ষিণের দিকে এগোয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ভারতের দ্বীপ লাক্ষাদ্বীপ, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়৷ ঝড়ে প্রাণ হারান অন্তত ২৪৫ জন এবং নিখোঁজ হন সাড়ে পাঁচশরও বেশি মানুষ, যাদের বেশির ভাগই মৎস্যজীবী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
মোরা, ২০১৭
একই বছরের আরেকটি বিদ্ধংসী ঝড় ছিল মোরা৷ শ্রীলঙ্কা, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উত্তরপূর্ব ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, তিব্বত ও বাংলাদেশ এই ঝড়ে আক্রান্ত হয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম এবং ঝড় চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম, পায়রা, মংলা ও কক্সবাজার বন্দরে বিপদসঙ্কেত জারি করা হয়৷ বন্ধ রাখা হয় বিমানবন্দরও৷
ছবি: bdnews24.com/Muhammad Mostafigur Rahman
রোয়ানু, ২০১৬
বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, রোয়ানু দুর্বল ঘূর্ণিঝড় হওয়ার কারণে তেমন ক্ষতি হবে না৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে নতুন করে জেগে ওঠে এই ঝড়৷ মিয়ানমার উপকূলের কাছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রাথমিকভাবে আছড়ে পড়ে রোয়ানু৷ মারা যান ২৭জন৷ এরপর বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সংস্পর্শে এসে শক্তিলাভ করে আরো বড় হয় ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু৷ শ্রীলঙ্কায় এই ঝড়ের কবলে প্রাণ হারান ২০১জন৷
ছবি: Imago/Zuma Press
কোমেন, ২০১৫
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের উৎস৷ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই ঝড় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে৷ মিয়ানমারেরও কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ছবি: Getty Images/D. Chakraborty
হুদহুদ, ২০১৪
পূর্ব ভারত ও নেপাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারত মহাসাগরের এই ঝড়ে৷ এছাড়াও, অন্ধ্র প্রদেশ ও ওড়িষায় এসে পড়ে এর ছোঁয়া৷ প্রায় ২৪ কোটি টাকা মূল্যের ক্ষতি হয় এই ঝড়ের কারণে৷ প্রাণ হারান ১২৪ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
ফিলিন, ২০১৩
থাইল্যান্ড, ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের গায়ে আছড়ে পড়া এই ঝড় ছিল ১৯৯৯ সালের পরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড় ছিল এটি৷ এর আগের ২৩ বছরে এত বড় মাপের কোনো ঝড় ভারত সামলায়নি৷ সরকারী তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২৫০ কোটি ভারতীয় রুপির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইলা, ২০০৯
গত এক দশকে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ছিল আইলা, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে পূর্ব উপকূলের বিশাল অংশ৷ প্রায় দুই কোটি মানুষ এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ঘরছাড়া হন অনেকে৷ শুধু কলকাতা শহরেই এই ঝড় কেড়ে নেয় ১৮টি প্রাণ, বাংলাদেশে হারিয়ে যায় প্রায় ৬০ হাজার গবাদি পশু৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. U. Zaman
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ওই সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল৷
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘‘অতি প্রবল এ ঘূর্ণিঝড় আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং পরে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে৷’’
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ থাকায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে৷ সেই সঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতে বলা হয়েছে৷
মঙ্গলবার রাতে আমপান বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানতে পারে আশঙ্কায় ওই দিন বিকাল থেকেই নিচু ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ কামাল৷
খুলনার বাগেরহাট জেলার স্থানীয় প্রশাসন থেকেও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে৷ ঝড় আসার আগেই মাঠের বোরো ধান কেটে ঘরে তোলার জোর চেষ্টা চলছে৷ মঙ্গলবার রাত থেকে উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস৷ বলেছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূলের কাছাকাছি এলে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে৷ মাঠে পেকে যাওয়া বোরো ধান যাতে বৃষ্টিতে নষ্ট না হয়, সেজন্য দুর্যোগ শুরুর আগেই তা কেটে কৃষকের ঘরে তুলতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ৷ ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি মাইকিং করে কৃষকদের দ্রুত ধান কেটে ঘরে তুলতে বলা হয়েছে৷
এদিকে, বাংলাদেশ প্রতিদিনই নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড হচ্ছে৷ এ অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে৷
এ অবস্থায় সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দুর্গতদের আশ্রয় দিতে জেলার ২৩৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও সংশ্লিষ্ট উপজেলার স্কুল ও কলেজগুলো খোলা রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷