দক্ষিণ কোরিয়ায় আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনীতে দুই কোরিয়া একটি পতাকা নিয়ে মার্চ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ বুধবার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷
বিজ্ঞাপন
এছাড়া দুই কোরিয়ার খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে মেয়েদের আইস হকি দল গঠনের কথাও জানিয়েছে তারা৷ অবশ্য এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বা আইওসির অনুমোদন নিতে হবে৷ রবিবার এ ব্যাপারে আইওসির সঙ্গে কথা বলবেন দুই কোরিয়ার কর্মকর্তারা৷
উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচির কারণে গত কয়েক বছর ধরে কোরীয় উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল৷ উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন নতুন বছরে দেয়া তাঁর বক্তব্যে অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দল পাঠানোর আগ্রহের কথা জানান৷ এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়৷ সেই থেকে দুই কোরিয়ার মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে৷
ইনস্টাগ্রামের ছবিতে উত্তর কোরিয়া
প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনামে থাকলেও উত্তর কোরিয়া দেশটি বিচ্ছিন্ন ও প্রায় অজানা৷ ব্রিটিশ ইনস্টাগ্রামার পিয়ের ডেপন্ট নিয়মিতভাবে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সেখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছবি তোলার চেষ্টা করেন৷
ছবি: DW/P.Depont
অজানার আকর্ষণ
উত্তর কোরিয়া গোপনে থাকতেই পছন্দ করে, বলা হয়ে থাকে৷ দেশটি কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে৷ উত্তর কোরিয়ায় পর্যটক হওয়ার অর্থ, বিশেষ ‘গাইড’-রা প্রতিপদে সঙ্গে থাকবে ও নজর রাখবে৷ এ সব সত্ত্বেও পিয়ের ডেপন্ট সাত বার উত্তর কোরিয়া যাত্রা করেছেন ও সেখানকার সাধারণ মানুষদের ছবি তুলেছেন৷
ছবি: DW/P. Depont
পুঁজিবাদের ভূত?
ডেপন্ট প্রথম উত্তর কোরিয়ায় যান ২০১৩ সালে৷ সেযাবৎ কর্তৃত্ববাদী দেশটিতে পরিবর্তন এসেছে, বলে তিনি লক্ষ্য করেছেন৷ বিগত দু’তিন বছরের মধ্যে ‘‘পিয়ংইয়াংয়ে নিজের সম্পদ প্রদর্শন করাটা গ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷’’ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও পিয়ংইয়াংয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়ছে ও প্রচুর বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে৷
ছবি: Pierre Depont
আলাপ করা সহজ নয়
ডেপন্ট দেখেছেন, পিয়ংইয়াংয়ের রাস্তায় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলা সহজ নয়৷ প্রথমত, গাইডদের একজন সবসময় কান খাড়া করে শোনে৷ দ্বিতীয়ত, স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের ফটো তুলতে দিতে বিশেষ পছন্দ করেন না৷ রাস্তাঘাটে মহিলারা ক্রমেই আরো ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠছেন বটে, তবে সেটা প্রধানত বড় শহরগুলোয়৷
ছবি: DW/P. Depont
শহর বনাম গ্রাম
পিয়ংইয়াংয়ের মেট্রো স্টেশনটি দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়: মনে হবে যেন কারুকার্য করা শ্বেতপাথরের দেওয়ালের ওপর সুবিশাল ঝাড়বাতি ঝুলছে৷ ডেপন্টের কাছে উত্তর কোরিয়া ‘‘ফটো তোলার একটা আশ্চর্য জায়গা,’’ কেননা এখানে রাস্তাঘাটে কোনো বিজ্ঞাপন নেই৷ অপরদিকে শহরে স্বাচ্ছল্যের নানা চিহ্ন চোখে পড়লেও, গ্রামাঞ্চলে এখনও চরম দারিদ্র্য বিরাজ করছে৷
ছবি: Pierre Depont
টুরিস্টরা যা দেখতে পান না...
...তা হলো উত্তর কোরিয়ার গ্রামাঞ্চলের মানুষদের বাস্তবিক পরিস্থিতি৷ সামরিক খাতে বিপুল বিনিয়োগ করলেও, দেশটি কৃষিপ্রধানই রয়ে গিয়েছে৷ ‘‘প্রত্যেকটি ছোট ক্ষেতে চাষ করা হয়, প্রতি বর্গমিটার জমি ব্যবহার করা হয়,’’ বলেছেন ডেপন্ট৷
ছবি: Pierre Depont
মেকি প্রাচুর্য?
টুরিস্টদের শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় বৈকি, তবে বড় বড় কৃষি সমবায়ের গাইডেড টুরে৷ ডেপন্ট দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হামহুং-এর কাছে একটি কৃষি সমবায়ে যাওয়ার সুযোগ পান; সেখানকার ছোট্ট বাজারটিতে সুন্দর করে পণ্য সাজানো ছিল ও অনটনের কোনো চিহ্নই ছিল না – খুব সম্ভবত ‘‘শুধু লোক-দেখানো,’’ বলে ডেপন্ট মন্তব্য করেছেন৷
ছবি: DW/P.Depont
হালফ্যাশনের স্কুল, তবে সবার জন্য নয়
উত্তর কোরিয়ায় টুরিস্ট হিসেবে সেখানকার একটি এলিট স্কুল বা মডার্ন স্কুল না দেখে ছাড় নেই৷ সংডোওয়ান ইন্টারন্যাশনাল সামার ক্যাম্পটি পূর্ণ সংস্কারের পর আবার খোলা হয় ২০১৪ সালে৷ সেখানে ছেলেমেয়েরা সর্বাধুনিক আর্কেড গেম্স নিয়ে খেলছে আর তাদের ব্যবহারের জন্য গোটা বিশেক কম্পিউটার রাখা আছে দেখে ডেপন্টের মনে হয়, দৃশ্যটা ‘‘কিছুটা অবাস্তব৷’’
ছবি: DW/P.Depont
সর্বত্র মিলিটারি
দেশটির সত্তা ও সমাজের প্রাণকেন্দ্র হল মিলিটারি৷ দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মিলিটারিতে কাজ করে৷ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতার তুলনায় সামরিক খাতে পিয়ংইয়াংয়ের ব্যয় বিশ্বের বৃহত্তম মিলিটারি বাজেটগুলির মধ্যে পড়ে৷ উত্তর কোরিয়ার কচিকাঁচারা মিলিটারি প্রতীকে অভ্যস্ত – এমনকি খেলার জায়গাতেও৷
ছবি: Pierre Depont
কর্তাভজা
মিলিটারি, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং কিম জং-উন ও তাঁর পূর্বপুরুষদের ঘিরে ‘ব্যক্তি উপাসনা’ – এই হলো উত্তর কোরিয়ার কাহিনি৷ মহান নেতাদের কিংবদন্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে ও তাঁদের সুবিশাল মূর্তিগুলোর পরিচর্যায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তা দেখে ডেপন্ট চমৎকৃত৷
ছবি: DW/P.Depont
9 ছবি1 | 9
অবশ্য অলিম্পিকে এক পতাকা নিয়ে দুই কোরিয়ার অংশ নেয়ার ঘটনা এটিই প্রথম হবে না৷ ২০০০ সালে সিডনিতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো দুই কোরিয়ার অ্যাথলেটরা একটি পতাকা নিয়ে মার্চ করেছিলেন৷ সেই সময় দর্শকরা দাঁড়িয়ে তাঁদের সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন৷ এরপর ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিক ও ২০০৬ সালে ইটালিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকেও এক পতাকা নিয়ে মার্চ করেন দুই কোরিয়ার অ্যাথলেটরা৷ তবে ইভেন্টগুলো নিজ নিজ পতাকা নিয়েই প্রতিযোগিতা করেছেন তাঁরা৷ পদক জেতার পর অ্যাথলেটদের তাঁদের নিজ দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়৷
তবে এর ব্যতিক্রমও ঘটেছে৷ ১৯৯১ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় সৌল ও পিয়ংইয়ং একটি যৌথ দল পাঠিয়েছিল৷ মেয়েদের বিভাগে ঐ যৌথ দল স্বর্ণপদক জয় করেছিল৷ সেই সময় উত্তর বা দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সংগীত না বাজিয়ে ‘আরিরাং’ নামে এক ঐতিহ্যবাহী কোরীয় লোক সংগীত বাজানো হয়৷
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের এশিয়ান গেমসের সময় প্রথম দুই কোরিয়ার সমন্বয়ে যৌথ দল পাঠানোর চিন্তা শুরু হয়েছিল৷ সেজন্য একটি ‘কোরীয় একত্রীকরণ পতাকা’ও ঠিক করা হয়েছিল৷ কিন্তু পরে সেটি সম্ভব হয়নি৷
উত্তর কোরিয়ার সামরিক মহড়া?
এদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার এক সরকারি কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে দেশটির এক বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, শীতকালীন অলিম্পিক শুরুর আগের দিন নিজেদের সামরিক শক্তি দেখানোর পরিকল্পনা করছে উত্তর কোরিয়া৷ দেশটির সামরিক বাহিনীর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই আয়োজন করা হচ্ছে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ দক্ষিণ কোরীয় কর্মকর্তা৷
জেডএইচ/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
যেসব দেশের কারণে টিকে আছে উত্তর কোরিয়া
উত্তর কোরিয়ার উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও এমন কয়েকটি দেশ আছে যারা উত্তর কোরিয়া থেকে পণ্য বা অস্ত্র আমদানি করে৷ চলুন দেখে নিই কোন দেশগুলো আছে এই তালিকায়৷
ছবি: Gianluigi Guercia/AFPGetty Images
অ্যাঙ্গোলা
আফ্রিকার এই দেশটির প্রেসিডেন্সিয়াল নিরাপত্তারক্ষীদের মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দেয় উত্তর কোরিয়া৷
ছবি: Gianluigi Guercia/AFPGetty Images
চীন
চীন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশ৷ চীনের শিল্পকারখানায় উত্তর কোরিয়ার অনেক নাগরিক কাজ করে৷ চীনে উত্তর কোরিয়ান অনেক রেস্তোরাঁও রয়েছে, যেখান থেকে উত্তর কোরিয়া বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
কঙ্গো
কঙ্গোর সরকার উত্তর কোরিয়া থেকে স্বয়ংক্রিয় পিস্তল এবং অন্য ছোট অস্ত্র আমদানি করে, যা মধ্য আফ্রিকার এই দেশটির প্রেসিডেন্সিয়াল দেহরক্ষী এবং পুলিশ ব্যবহার করে৷
ছবি: Reuters/R. Carrubba
মিশর
অভিযোগ রয়েছে, উত্তর কোরিয়া মিশরকে ক্ষেপণাস্ত্রের উপকরণ পাঠিয়েছে৷ এ অভিযোগ সত্য কিনা সে ব্যাপারে তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র৷
ছবি: Reuters/Amr Abdallah Dalsh
ইরিত্রিয়া
ইরিত্রিয়া আফ্রিকার ছোট একটি দেশ৷ এই দেশটিরও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে৷ জানা গেছে, তারা উত্তর কোরিয়া থেকে সামরিক উপকরণ কিনে থাকে৷
ছবি: DW
কুয়েত
উত্তর কোরিয়ার অনেক শ্রমিক কুয়েতে নির্মাণ কাজে যুক্ত আছে৷ কুয়েতে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসও আছে৷
ছবি: Imago/Xinhua
মোজাম্বিক
উত্তর কোরিয়া মোজাম্বিককে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহযোগিতা করছে৷ এছাড়া ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণেও সহায়তা দিচ্ছে দেশটিকে৷
ছবি: Gianluigi Guercia/AFP/Getty Images
নামিবিয়া
দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশে সমরাস্ত্র উপকরণ তৈরি করার একটি কারখানা স্থাপনের জন্য উপকরণ এবং কর্মী পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া৷
ছবি: DW/B. Osterath
নাইজেরিয়া
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় উত্তর কোরিয়া থেকে অনেক চিকিৎসক যান৷ ২০১৩ সালে এক সন্ত্রাসী হামলায় উত্তর কোরিয়ার তিন চিকিৎসক নিহত হয়েছিলেন সেখানে৷
ছবি: picture alliance /AP Photo/L. Oyekanmi
ওমান
ওমানে নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে কাজ করার জন্য উত্তর কোরিয়া তাদের শ্রমিক পাঠিয়ে থাকে৷
ছবি: SR
কাতার
কাতারেও নির্মাণ প্রকল্পে উত্তর কোরিয়ার অনেক শ্রমিক কাজ করে৷ ২০২২ সালে দেশটিতে ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে৷ এজন্য সেখানে স্টেডিয়ামসহ বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Zumapress
সুদান
উত্তর কোরিয়া সুদানে যেসব সামরিক উপকরণ পাঠায়, তার মধ্যে রকেট কন্ট্রোল সেকশন এবং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Shazly
সিরিয়া
দীর্ঘ সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলা দেশটিও উত্তর কোরিয়ার উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম৷ জানা গেছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকার উত্তর কোরিয়া থেকে অনেক সমরাস্ত্র এবং উপকরণ কিনে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Press Service of the President
উগান্ডা
আফ্রিকার দেশ উগান্ডারও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে৷ উত্তর কোরিয়ার সেনারা উগান্ডায় বিমানবাহিনীর পাইলট এবং টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন৷
ছবি: AP
সংযুক্ত আরব আমিরাত
ইউএই-তে উত্তর কোরিয়ার অনেক রেস্তোরাঁ এবং নির্মাণ কোম্পানি রয়েছে, যেখানে কাজ করার জন্য সবসময়ই উত্তর কোরিয়া থেকে কর্মী পাঠানো হয়৷ এছাড়া উত্তর কোরিয়া থেকে স্কুড মিসাইল কিনে থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাত৷