প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে নাৎসি বন্দিশিবির ও তার পরবর্তী যুগ অবধি কোনো স্মৃতি বা স্মৃতিসৌধই যে ফেলে দেবার নয়, এ কথা জানেন জার্মানরা৷ তাই সব কিছু সযত্নে বাঁচিয়ে রাখেন৷
বিজ্ঞাপন
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলতে জার্মানির মতো একটি সমৃদ্ধিশালী দেশে যে কী বোঝায়, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বোধহয় পথে-ঘাটে বহু পুরনো বাড়ির গায়ে ‘ঐতিহাসিক ভবন' হিসেবে লটকে দেওয়া সরকারি তকমা বা ফলক৷ সে ধরনের বাড়ির সংখ্যাও খুব কম নয়৷
বলতে কি, ইউরোপের আবহাওয়ার কারণেই হয়ত এদেশে যুগের পর যুগ চলে যায়, কিন্তু বাড়িঘরের তেমন ক্ষতি হয় না৷ বাড়িঘর তৈরিতে পাথর ও কাঠের – কড়িকাঠের – ব্যবহার বেশি; সেটাও একটা কারণ হতে পারে৷ আর্দ্রতা কম বলে হয়তো ইট বা পলেস্তারায় নোনা ধরে না৷
দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই আইন করে ঐতিহাসিক ভবন ও স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির সংরক্ষণ শুরু হয়েছে৷ আজও স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণের ব্যাপারটি কেন্দ্রের নয়, রাজ্যগুলির হাতে – তারাই এই সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে এবং আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সেই আইন বলবৎ করে৷
২০১৬ সালে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০টি পর্যটন স্থান
জার্মানির পর্যটন বোর্ড বিদেশি পর্যটকদের তাঁদের দৃষ্টিতে সেরা পর্যটন স্থান নির্বাচন করতে আহ্বান জানিয়েছিল৷ ছবিঘরে থাকছে শীর্ষ ১০ স্থানের কথা৷ আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে বার্লিন নেই!
ছবি: Mapics/Fotolia
নম্বর ১০: ড্রেসডেন শহরের পুরনো অংশ
এলবে নদীর পাশে অবস্থিত এই অংশে গেলে রেনেসাঁ, বারোক ও উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত কয়েকটি ঐতিহাসিক ভবনের দেখা পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নম্বর ৯: কোলন ক্যাথিড্রাল
প্রতিদিন ২০ হাজারের মতো মানুষ এই গির্জা দেখতে যান৷ সাত শ’ বছরেরও বেশি পুরনো কোলন ডোম তৈরিতেও প্রায় একইরকম সময় লেগেছে৷ ১৯৯৬ সালে এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Baeck
নম্বর ৮: উল্ম শহরের গির্জা
এই গির্জার টাওয়ারটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু - ১৬১.৫৩ মিটার৷ ১২৬ বছর আগে এই গির্জার নির্মাণকাজ শেষ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Carsten Schmidt
নম্বর ৭: মানহাইমের বারোক শৈলীর প্রাসাদ
এই প্রাসাদের একটি অংশ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: Landesmedienzentrum Baden-Württemberg/ Staatliche Schlösser und Gärten Baden-Württemberg
নম্বর ৬: লেক কন্সটান্স অঞ্চল
জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার আল্পস পর্বতমালা এলাকায় এই লেকটি অবস্থিত৷
ছবি: Imago/bodenseebilder.de
নম্বর ৫: রথেনবুর্গ অব ডেয়ার টাওবার
জার্মানির বিখ্যাত ‘রোম্যান্টিক রোড’এর অংশ রথেনবুর্গে গেলে এখনও মধ্যযুগের ঐতিহ্যের দেখা পাওয়া যায়৷
ছবি: Fotolia/Frank Merfort
নম্বর ৪: নয়শোয়ানশ্টাইন দুর্গ
প্রতিবছর ১৪ লাখের মতো মানুষ দুর্গটি দেখতে যান৷ ১৮৬৯ সালে এটি তৈরি করেন রাজা দ্বিতীয় লুডভিশ৷
ছবি: picture-alliance
নম্বর ৩: রুস্ট শহরের ইউরোপা পার্ক
প্যারিসের ডিজনিল্যান্ডের পর রুস্ট শহরের এই থিম পার্কটিই ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়৷ জার্মানির সবচেয়ে বড় থিম পার্কও এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Seeger
নম্বর ২: হাইডেলব্যার্গ ক্যাসেল ও পুরনো শহর
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Wittek
নম্বর ১: হামবুর্গের মিনিয়েচার ওয়ান্ডারল্যান্ড
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘মডেল রেললাইন’ এটি৷ ভিডিও দেখতে উপরে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Miniatur Wunderland Hamburg
10 ছবি1 | 10
তৃতীয়ত, স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ হলো এমন একটি বিষয়, যেখানে সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই, উভয়পক্ষই এ বিষয়ে পুরোপুরি উদ্বুদ্ধ, এমনকি জনসাধারণের মধ্যে যারা বিত্তশালী নন, তারাও৷ হয়ত এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠক্রমে এমন কিছু আছে, যা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেয় যে, তোমার অতীত তোমার সত্তার অঙ্গ, অতীত ছাড়া তুমি নেই, তোমার জাতি নেই, পরিচয় নেই৷
দশ লাখ ‘ডেঙ্কমাল'
তাই জার্মানিতে সরকারিভাবে স্বীকৃত ও নথিভুক্ত ‘ডেঙ্কমাল' বা স্মৃতিসৌধের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ৷ এর মধ্যে পড়ে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, অসংখ্য গির্জা – অন্যদিকে চাষবাসের খামারবাড়ি থেকে শুরু করে কারখানার শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা; সেই সঙ্গে দুর্গ-প্রসাদ, উদ্যান বা বাগান, শিল্পকারখানা বা সরকারি ভবন: এ সবই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ৷
এই সব স্মৃতিসৌধের মধ্যে বেশ কিছু স্মৃতিসৌধ কিন্তু বেসরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে – তার মধ্যে কিছু পুরনো বাড়ি হয়ত ভাড়া দেওয়া হয়েছে: কিন্তু সেগুলোরও তো মেরামতি, রক্ষণাবেক্ষণের দরকার৷ বাইরে থেকে সে সব বাড়ি বদলানো চলবে না; ভেতরে রদবদল করতে গেলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে৷
কোলনকে ভালোবাসার দশ কারণ
শিল্প, সংস্কৃতি এবং কার্নেভাল – তবে এ সবের বাইরেও আরো অনেক ব্যাপার আছে কোলনে৷ আছে দু’হাজার বছরেরও পুরোনো, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা সব ভবন৷ আছে বাণিজ্য মেলা, নাইট লাইফ....কিছুরই যেন কমতি নেই এ শহরে৷
ছবি: Dieter Jacobi/KölnTourismus GmbH
কোলন ক্যাথিড্রাল – সত্যিকার অর্থেই এক বিশাল ল্যান্ডমার্ক
পর্যটকদের কাছে জার্মানির অন্যতম সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য হচ্ছে কোলন ক্যাথিড্রাল৷ প্রতিদিন ২০ হাজারের মতো মানুষ এই গির্জা দেখতে যান৷ সাত’শ বছরের বেশি পুরনো কোলন ডোম তৈরিতেও প্রায় একইরকম সময় লেগেছে৷ ১৯৯৬ সালে এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে৷
ছবি: Udo Haake/KölnTourismus GmbH
ওল্ড টাউন সেন্টার – একটি আধুনিক ঐতিহাসিক জায়গা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কোলনের ওল্ড টাউন সেন্টার৷ পরবর্তীতে গতশতকের ষাটের দশকে অনেক ভবনের সামনের অংশ ব্যবহারের উপযোগী করে সংস্কার করা হয়৷ বর্তমানে সেখানে অনেক আরামদায়ক ক্যাফে, রেস্তোরাঁ আর পানশালা রয়েছে৷
ছবি: Jens Korte/KölnTourismus GmbH
ঐতিহ্যবাহী ক্যোলশ বিয়ারের উৎপত্তি যেখানে
যেখানে তৈরি সেখানেই সেটির স্বাদ নেয়ার সুযোগ নিতে চাইলে কোলনে গিয়ে ক্যোলশ বিয়ার পান করতে হবে৷ শূণ্য দশমিক দুই লিটারের সরু গ্লাসে করে এই বিয়ার পরিবেশন করা হয়৷
ছবি: Privatbrauerei Gaffel
প্রাচীন থেকে বর্তমান সময়ের মিউজিয়াম
শিল্প এবং সংস্কৃতি প্রেমীদের জন্য এক আদর্শ স্থান কোলন৷ সেখানে অসংখ্য মিউজিয়ামে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ইভেন্ট চলতে থাকে৷ রোমান সময় থেকে নতুন প্রযুক্তি এমনকি চকলেট – সব ধরনের মিউজিয়ামই পাবেন কোলনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
চার্চ – অতীতের মহিমার সাক্ষী
মধ্যযুগে কোলন ছিল জার্মান ভাষী বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহর এবং গির্জাসম্পর্কিত এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র৷ এখনো অনেক গির্জা সেই সময়ের চিহ্ন বহন করে চলেছে৷
ছবি: Jens Korte/KölnTourismus GmbH
রাইনপার্ক – একটি বড় খেলার মাঠ
ক্যাথিড্রালের অপর পাশে রাইনের তীরে ৪০ হেক্টর জমির উপর রাইনপার্ক অবস্থিত৷ ১৯১২ সালে তৈরি পার্কটিকে ২০০৭ সালে জার্মানির সেরা পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ পার্কটিতে ফুটবল খেলার, এবং বার্বিকিউর ব্যবস্থা রয়েছে৷ আর কোলনের চিড়িয়াখানা থেকে ক্যাবল কারে রাইন পার হয়ে পার্কে যাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
কার্নিভাল – কোলনের পঞ্চম মৌসুম
প্রতিবছরের একটি সপ্তাহ কোলন এক অসাধারণ স্থানে পরিণত হয়৷ বলছি কোলন কার্নিভালের কথা৷ গোটা বিশ্বে কোলন ডোম আর কার্নিভালের জন্য কোলন বিশেষভাবে পরিচিত৷ কার্নিভালের সময় সেখানে গেলে যে শব্দটি মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে ‘আলাফ’৷ কার্নিভালের শুভেচ্ছা জানাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
বাণিজ্যমেলা – গেমসকম থেকে আর্ট কোলন
বাণিজ্য মেলার শহর হিসেবেও কোলনের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে৷ বিশ্বের অন্যতম বড় ভিডিও গেমের মেলা ‘গেমসকম’ এই শহরেই আয়োজন করা হয়৷ পাশাপাশি, শিল্প মেলা আর পোশাক খাতের মেলা তো আছেই৷
ছবি: Koelnmesse GmbH
উদারমনা এবং স্বাগতপূর্ণ
মেট্রোপলিটন এবং টলারেন্ট – কোলনের ভিত্তি এই দু’টোর উপর৷ শহরটিতে সমকামীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে৷ প্রতিবছর সমকামী এবং হিজড়াদের অধিকার নিয়ে বছরে দুই সপ্তাহের ‘কোলনপ্রাইড’ আয়োজন করা হয় কোলনে৷ আয়োজন করা হয় তিন দিনব্যাপী ‘ক্রিস্টোফার স্ট্রিট ডে’-রও৷
ছবি: picture alliance/R. Goldmann
রাইন – বাণিজ্য রুট এবং চিত্তবিনোদনের জায়গা
জার্মানির সবচেয়ে দীর্ঘ নদী রাইনের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এক চমৎকার স্থান কোলন৷ আর কোলনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে নৌভ্রমণ করতে পারেন রাইনে৷ নদী থেকে শহরটি দেখতে অসাধারণ মনে হয়৷
ছবি: Dieter Jacobi/KölnTourismus GmbH
10 ছবি1 | 10
বাড়ির মালিকরা যাতে তাদের ‘স্মৃতিসৌধগুলোর' ঠিকমতো দেখাশোনা করেন, সেজন্য তাদের কর ছাড় দেওয়া হয়: স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ আইনে সুরক্ষিত বাড়িগুলির দেখাশোনায় যা খরচা হবে, তার একাংশ আয়কর হিসেবের সময় বাদ দেওয়া চলবে৷
ইউনেস্কোর তালিকায়
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টে যে ৮৯০টি ‘মনুমেন্ট' বা স্মৃতিসৌধ আছে তার মধ্যে ৩৩টি হল জার্মানিতে৷ অর্থাৎ যে ১৮৬টি দেশ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছে, স্বীকৃত হেরিটেজ সাইটের সংখ্যার বিচারে প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে পড়ে জার্মানি৷
বিখ্যাত, সমাদৃত ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের কথা উঠলে বলতে হবে যে, এক্ষেত্রে জার্মানি ইটালি বা ফ্রান্সের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে; কিন্তু জার্মানির মতো এত বেশি স্বীকৃত ও সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ আর কোনো দেশে নেই৷ এবং এই সংখ্যার আসল গুরুত্ব হলো এই যে, এই সংখ্যা থেকে দেশের সামগ্রিক সচেতনতার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়: অর্থাৎ দেশের মানুষরা তাদের নিজেদের ইতিহাস, সেই ইতিহাসের বিভিন্ন নীরব সাক্ষী ও সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে ঠিক কতটা সচেতন৷