মহামারির কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৭৫ বছর পূর্তির উদযাপনটি ছিল ছোট আকারে৷ তারপরও জার্মানির প্রেসিডেন্টের সতর্কবার্তা বেশ কিছু বিষয়কেই মনে করিয়ে দিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখা আর আকার ইঙ্গিতে সমাজের প্রতি কিছু দিক নির্দেশনা দেয়া জার্মানির প্রেসিডেন্টের মূল কর্তব্য৷ এরপরও বড় কিছু দায়িত্ব থাকে তার উপরে৷ নিজ দেশ আর বিশ্বের মানুষে ঐক্য বজায় রাখতেও ভূমিকা পালন করেন তিনি৷
ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন৷ তিনি প্রথম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তার মূল থিম ছিল উদ্দীপনা বা সাহসিকতা৷ সেই সময় তার বক্তৃতার মেধা নিয়ে অনেক বিদ্রুপও প্রচলিত ছিল৷ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা (তিনি দুই মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন) সাধারণত বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে আবেগবর্জিত সংযত বক্তৃতাই দিয়ে থাকেন৷
কিন্তু সেখান থেকে তিনি নিজের একটি ‘স্টাইল' রপ্ত করেছেন৷ এক বছরের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাষণ দিয়েছেন স্টাইনমায়ার ৷ বার্লিন দেয়াল পতনের ত্রিশতম বার্ষিকী থেকে শুরু করে, গণহত্যার ৭৫ বছরপূর্তি, হালের সিনাগগে বর্ণবাদী হামলা সবখানেই বাতিঘরের ভূমিকায় হাজির হয়েছেন তিনি৷
নাৎসিদের সিন্টি ও রোমা গণহত্যা স্মরণ
ইউরোপে ৬০০ বছর ধরে বাস করছে সিন্টি ও রোমা সম্প্রদায়৷ নাৎসি আমলে গণহত্যার শিকার হয় এরা৷ অনেককে কোণঠাসা করা হয়, জোর করে করা হয় বন্ধ্যা৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও তাদের ওপর পরিচালিত নিপীড়নের স্বীকৃতি দেয়নি জার্মান সমাজ৷
ছবি: Dokumentations- und Kulturzentrum Deutscher Sinti und Roma
দেশের জন্য নিবেদন
অনেক জার্মান সিন্টিই দেশের জন্য অস্ত্র হাতে লড়েছেন৷ শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই নয়, ১৯৩৯ সাল থেকেই তারা এ দেশের সশ্বস্ত্র বাহিনীতে ভূমিকা রেখেছেন৷ ১৯৪১ সালে জার্মান হাইকমান্ড ‘জাতিগত ও রাজনৈতিক’ কারণ দেখিয়ে সব ‘জিপসি ও তাদের ঔরসদের’ সক্রিয় সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দেয়৷ আলফনস ল্যামপের্ট ও তার স্ত্রী এলসাকে বন্দি শিবির আউশভিৎসে পাঠানো হয় এবং পরে সেখানে তাদের হত্যা করা হয়৷
ছবি: Dokumentations- und Kulturzentrum Deutscher Sinti und Roma
তালিকা তৈরি
সিন্টি ও রোমাদের আস্থা অর্জনের জন্য রোমানি ভাষা শিখেছিলেন এভা জাস্টিন নামের একজন নার্স ও নৃতাত্ত্বিক৷ কথিত সায়েন্টিফিক রেসিজম স্পেশালিস্ট হিসেবে তিনি এই দুই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সম্পর্কে ধারণা পেতে জার্মানিজুড়ে ঘোরেন এবং জিপসি ও জিপসি বাবা বা মায়ের সন্তানদের তালিকা তৈরি করেন৷ সেই তালিকা ধরেই গণহত্যা চালিয়েছিল নাৎসিরা৷
ছবি: Bundesarchiv
বন্দিত্ব
তিরিশের দশকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সিন্টি ও রোমাদের জোর করে ধরে এনে শহরের বাইরের শিবিরগুলোতে রাখা হয়৷ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা এ সব শিবিরের বাইরে পাহারা বসানো হতো কেউ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে৷ তেমনই একটি বন্দি শিবির জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেভেনসবুর্গ৷ শিবিরের বাসিন্দাদের গৃহপালিত সব পশু মেরে ফেলা হয়েছিল৷ দাসের মতো করে তাদের দিয়ে কাজ করানো হত৷ অনেককে জোর করে বন্ধ্যা করে দেওয়া হয়েছিল৷
ছবি: Stadtarchiv Ravensburg
প্রকাশ্য দিবালোকে দেশান্তর
১৯৪০ সালের মে মাসে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জার্মানির এরপার্জ শহরের রাস্তা ধরে বহু সিন্টি ও রোমা পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হতa ট্রেন স্টেশনে এবং সেখান থেকে তাদের সরাসরি নাৎসি অধিকৃত পোল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হত৷ ‘‘ঝামেলা ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে তাদের পাঠানো সম্পন্ন হয়েছে,’’ বলা হয় একটি পুলিশ প্রতিবেদনে৷ এভাবে দেশান্তরিতদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয় তাদের কাজের জায়গা ও ইহুদি ঘাঁটিগুলোতে৷
ছবি: Bundesarchiv
স্কুল থেকে আউশভিৎসে
১৯৩০ দশকের শেষের দিকে কার্লসরুয়ে শহরের একটি ক্লাসরুমের ছবিতে দেখা যায় কার্ল ক্লিংকে৷ ১৯৪৩ সালের বসন্তে স্কুল থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়৷ এরপর তাকে পাঠানো হয় আউশভিৎস-বিরকেনাউয়ের ‘জিপসি ক্যাম্পে’৷ সেখানেই গণহত্যার বলি হয় শিশুটি৷ সেখান থেকে যারা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন তাদের ভাষ্য মতে, সেখানে পাঠানোর আগেই তাদের আলাদা করে ফেলা হয়, রাখা হয় চাপের মধ্যে, কখনও কখনও ক্লাসেও অংশ নিতে দেওয়া হতো না৷
ভয়ানক মিথ্যা দিয়ে অভ্যর্থনা
১৯৪৩ সালে পরিবারের সঙ্গে পশুবাহী গাড়িতে করে আউশভিৎসে পৌঁছানোর সময় নয় বছরের হুগো হ্যোলেনরাইনার মনে মনে বলছিল, আমি কাজ করতে পারি৷ সেখানে গিয়ে ফটকের উপরে ‘কাজ তোমাকে মুক্তি দেবে’ লেখা দেখেই এই ভাবনা এসেছিল শিশুটির মনে৷ সে তার বাবার কাজে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল৷ ওই মৃত্যুকূপে যাদের নেওয়া হয় তাদের প্রতি ১০ জনে একজন ফিরে আসতে পেরেছিল, তাদেরই একজন হ্যোলেনরাইনার৷
ছবি: DW/A. Grunau
‘মৃত্যুদূত’ থেকে নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা
আউশভিৎসে নিয়োজিত ছিলেন কুখ্যাত এসএস ড. জোসেফ মেঙ্গেলে৷ তিনি ও তার সহকর্মীরা অসংখ্য বন্দিকে নির্যাতন করেন৷ তারা শিশুদের বিকলাঙ্গ করতেন, তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দিতেন জীবাণু, যমজদের নিয়ে বর্বরোচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন৷ বন্দিদের চোখ ও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে বার্লিনে পাঠাতেন৷ ১৯৪৪ সালের জুন মাসে ১২ বছরের একটি শিশুর মাথা পাঠিয়েছিলেন তিনি৷ বিশ্বযুদ্ধের পর আর বিচারের মুখোমুখি হননি তিনি৷
ছবি: Staatliches Museum Auschwitz-Birkenau
বিলম্বে মুক্তি
১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি যখন আউসভিৎসে রাশিয়ার লালফৌজ এলো তখন বন্দিদের মধ্যে শিশুরাও ছিল৷ কিন্তু সিন্টি ও রোমাদের জন্য মুক্তি এসেছিল দেরিতে৷ ১৯৪৪ সালের ২-৩ আগস্ট রাতে আউসভিৎশের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ‘জিপসি ক্যাম্পের’ জীবিতদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন৷ পরদিন সকালে কাঁদতে কাঁদতে ব্যারাকের বাইরে আসা দু’টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: DW/A. Grunau
জাতিগত বিদ্বেষের ক্ষত
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো মুক্ত হওয়ার পর জার্মান কর্তৃপক্ষ সেখানকার জীবিতদের জাতিগত নিপীড়নের শিকার ও বন্দিত্ববরণের সনদ দেয়৷ পরে অনেকে বলতে শুরু করে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যই তাদের সাজা ভোগ করতে হয়৷ ক্ষতিপূরণ চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয় তারা৷ আউশভিৎসে শিশু তিন মেয়েকে হারিয়েছিলেন হিল্ডগার্ড রাইনহার্ডট৷
ছবি: Dokumentations- und Kulturzentrum Deutscher Sinti und Roma
স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন
সিন্টি ও রোমা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা আশির দশকের শুরুর দিকে ডাকাউ কনেসনট্রেশন ক্যাম্পের ফটকে অনশন করেন৷ জাতিগত বিদ্বেষের প্রতিবাদ এবং নাৎসি নিপীড়নের স্বীকৃতি দাবি করেন তারা৷ ১৯৮২ সালে তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিড্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সিন্টি ও রোমাদের নাৎসি গণহত্যার শিকার হওয়ার স্বীকৃতি দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিসৌধ
সিন্টি ও রোমাদের ওপর নাৎসি গণহত্যার স্মরণে ২০১২ সালে বার্লিনের বুন্দেসটাগের কাছে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়৷ বিশ্বজুড়ে এই দুই সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই স্মৃতিসৌধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
11 ছবি1 | 11
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেয়া ভাষণে তিনি বাস্তবতা আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বের করার উপর সবার প্রতি আহবান জানান৷ এরপরও হিংসাত্মক বক্তব্য, অপরাধীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভুয়া তথ্য ঠিকই ছড়িয়েছে৷ রাজনীতি আর সমাজকে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত সর্বাগ্রে অস্থির করে তুলেছে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭৫ বছর পূর্তিতে বার্লিনের অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে স্টাইনমায়ার বলেছেন: কোন কিছুই চিরকালের জন্য নিরাপদ নয়৷ তার এই বক্তব্য বর্তমান প্রেক্ষাপট, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এবং জার্মান রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ৷ সব জার্মানদেরকে নিজেদের পরিবার, দেশের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর আহবান ছিল তার বক্তব্যে৷ যে ইতিহাসের অপরাধী আর ক্ষতিগ্রস্ত দুই পক্ষেই রয়েছেন তারা৷ তবে একদিক থেকে বলতে গেলে আহবান জানানোর সময়টা দেরি হয়ে গেছে৷ কেননা (যুদ্ধের) শেষ প্রত্যক্ষদর্শীরাই শুধু নন, তাদের পরের প্রজন্মের অনেকেই এরইমধ্যে মারা গেছেন৷ তারপরও তার এই বক্তব্যের গুরুত্ব এখনও শেষ হয়ে যায়নি৷
স্টাইনমায়ার তার বক্তব্যে বেশ কিছু সতর্কবার্তাও দিয়ে আসছেন৷ গত জানুয়ারির শেষ দিকে গণহত্যার স্মরণে সংসদে দেয়া ভাষণে তিনি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট রুভেন রিভলিনের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘‘যা এখানে ঘটতে পারে তা যেকোন জায়াগায় ঘটতে পারে৷’’ এর সঙ্গে আউসভিৎজের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী লেখক প্রিমো লেভির একটি উক্তির মিল পাওয়া যাবে৷ তিনি বলেছিলেন , ‘‘যা একবার ঘটেছিল তা বারবার ঘটতে পারে৷’’
জাতীয়তাবাদের নতুন প্রলোভন, কতৃত্ববাদী প্রবণতা, গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ এসবই সমাজের জন্য ভয়ংকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্টাইনমায়ার৷ তার এই বক্তব্য আমাদের জন্য সাবধানবাণী৷