অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে সরকার টিকে আছে: বিএনপি মহাসচিব
১৯ নভেম্বর ২০২২
শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় সিলেটে সমাবেশ শুরু করে বিএনপি৷ পরিবহণের ধর্মঘটের পাশাপাশি মোবাইল ইন্টারেনেট না থাকায় ভোগান্তিতে নগরবাসীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষ৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার পরিবহণ ধর্মঘট থাকায় এক দিন আগেই সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা৷ দলের চেয়ারপার্সনও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সম্মানে একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়৷
জেলাবিএনপিরসভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর সভাপতিত্ব করেন এই সমাবেশে৷ স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহানগর মহিলা দলের সভাপতি রোকসানা বেগম শাহনাজও৷ সমাবেশে মোট ৫৬ জন বক্তব্য রাখেন৷ সম্প্রতি দেশে বিভিন্ন সমাবেশ ও বিক্ষোভে নিহত পাঁচ নেতা-কর্মীর ছবি রাখা ছিল সিলেট নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের গণসমাবেশে৷
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবারের সভায় বক্তব্য রাখার সময় বলেন, এই আন্দোলনে ‘বিজয়’ ছাড়া মানুষ ঘরে ফিরবে না। তিনি বলেন, “আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।”
তার কথা., “হুমকি দেয় যে, খেলাফতে মজলিশের মতো অবস্থা হবে, হেফাজতের মতো অবস্থা হবে। হুমকি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী যে, আমরা যদি কোথাও আন্দোলন করতে যাই তাহলে হেফাজতের মতো অবস্থা হবে। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, এবার মানুষ জেগে উঠেছে, এবার ওই সব হুমকি-ধমকি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। এই মানুষ এই যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর ঘরে ফিরবে না।”
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ কিন্তু সেই চালের দাম এখন ৭০ টাকা, ৮০ টাকা৷ তিন কোটি মানুষ বেকার হয়েছে৷ অত্যাচার, নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে সরকার টিকে আছে বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘গত ১৪ বছর ধরে এই দেশে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকার বাংলাদেশকে একটা তলাবিহীন ঝুড়িতে আবারও পরিণত করেছে৷’’ আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচিত নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘এই সরকারের বিচার হবে জনতার আদালতে৷... দেশের স্বাধীনতাকে হরণ করার জন্য হাসিনা সরকারের বিচার হবে জনগণের আদালতে৷’’
বিএনপি মহাসচিবের কথায়, ‘‘এই যে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে আর তারা ঘরে ফিরবে না৷ আমাদের লক্ষ্য একটাই আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া অধিকারকে ফিরিয়ে নিব৷ আমাদের ভোটের অধিকারকে আমরা ফিরিয়ে নিব৷ আমাদের সরকার আমরা তৈরি করতে চাই, জনগণ তৈরি করতে চায়৷ আমার ভোট আমি দেব৷’’
বিএনপিরনেতাদের অভিযোগ, পরিবহণ ধর্মঘটের মতো ইন্টারনেটের গতিও সরকারের নির্দেশে কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ফেসবুক পেজসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাতে বিএনপির সমাবেশ সরাসরি সম্প্রচার করা না যায় এবং যোগাযোগের অ্যাপগুলো ব্যবহার করা না যায় সেজন্য এমনটা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তারা৷ যদিও তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘‘আমরা বিএনপিকে দমন করার নীতি অবলম্বন করিনি৷ আমরা যখন ক্ষমতায়, তখন তারা (বিএনপি) যেন সুন্দরভাবে সমাবেশ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাই সরকার সব সময় নিয়েছে৷''
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছিল, ‘‘শনিবার সকাল থেকে কোনো বাস সিলেট থেকে ছেড়ে যায়নি এবং সিলেটে আসতে পারেনি; ধর্মঘট চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত৷ ধর্মঘটের ভোগান্তির মধ্যেই সকাল থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেননি নগরীর গ্রাহকরা৷’’
মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ জানান, সমাবেশকে ঘিরে কড়া নজর রেখেছিল পুলিশ৷ মাঠে ১৯টি চেকপোস্ট বসানো ছিল৷ চারটি ভ্রাম্যমাণ দলসহ পুলিশের একাধিক দল সুরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখতে কাজ করছে৷
সিলেটে বিএনপির গণসমাবেশের দিন পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে অল্প সংখ্যক যান চলাচল করায় ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ জানান নিত্যযাত্রীরাও৷
আরকেসি/এফএস (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, প্রথম আলো,সমকাল)
বিএনপির চার দশক
৪৫ বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া৷ যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত আছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ এত বছরে কী ছিল দলটির পথচলা?
ছবি: Getty Images/Keystone
প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের গুলিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন৷ এরপর প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে ছিল অনির্বাচিত সরকার৷ সে সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ পরে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে রাজনৈতিক দল গঠন করেন৷
ছবি: imago/Belga
প্রতিষ্ঠা
বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছিল৷ পরে তা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে দলের যাত্রা করেন জিয়াউর রহমান৷
ছবি: imago/United Archives International
নির্বাচন ও মৃত্যু
জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে৷ তখন মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জেতে৷ নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন৷
ছবি: Getty Images/Keystone
খালেদার রাজনীতিতে আসা
জিয়ার মৃত্যুর পর নেতাকর্মীদের আহ্ববানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন৷ ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন৷ ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথম বক্তৃতা করেন৷ ১৯৮৪ সালের ১০মে পার্টির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন৷
ছবি: AP
এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও খালেদা জিয়া
জিয়ার মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন৷ তবে তাঁকে হটিয়ে ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন৷ বিএনপি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এই আন্দোলনে বেগম জিয়া ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দু’জনই ছিলেন, যদিও আপোষহীনতার কারণে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
সরকার গঠন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদে মাত্র ৪৫ দিন টিকতে পারে সেই সরকার৷
ছবি: AP
শেষবার সরকারে
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জিতে আবারো সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট৷এই সরকারই ছিল বিএনপির শেষ সরকার৷ এই সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পর নানা বিতর্ক ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় দুই বছর৷ সে সময় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়কেই জেলে যেতেও হয়েছিল৷ পরে অবশ্য দু’জনই ছাড়া পান৷
ছবি: Getty Images
জোটের রাজনীতি
বিএনপি এ পর্যন্ত বারবার জোট করেছে৷ প্রথম সাতদলীয় জোট করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে৷ এরপর জামায়াতে ইসলামীসহ গড়ে চারদলীয় জোট৷ পরবর্তীতে জোটে দলের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ সেটি ঠেকে বিশ দলীয় জোটে৷
ছবি: bdnews24.com
রাজনৈতিক ভুল ও কারাগারে খালেদা
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট৷ এই নির্বাচনে অংশ না নেয়াকে অনেকেই রাজনৈতিক ভুল বলে মনে করেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে থাকা নানা মামলার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত তাঁকে কারাদণ্ড দেয়৷ আরো কয়েকটি মামলা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
বিদেশে তারেক রহমান
মানি লন্ডারিংসহ নানা মামলায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন জিয়াপুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ নানা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না৷ এসব সংকট নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় আছে বলে মনে করেন অনেকেই৷