অনন্ত জলিল, বাংলাদেশের চিত্রনায়ক, ব্যবসায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তারকা৷তার মতো একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এমন বক্তব্য আসা খুব দুর্ভাগ্যের৷
বিজ্ঞাপন
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মঙ্গলবার অধ্যাদেশ জারি হতে যাচ্ছে৷ কিন্তু এর মধ্যেও একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে৷ রবিবার রাতে রাজধানীতে ঘটেছে আরো একটি গণধর্ষণের ঘটনা৷ধর্ষণের শিকার ১৩ বছরের কিশোরী৷ দেশজুড়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে৷
এর মধ্যে বাংলাদেশের চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল হাজির হলেন ‘ধর্ষণবিরোধী' একটি ভিডিও নিয়ে৷ ভিডিওটি পোস্ট করা হলো তার স্ত্রী বর্ষার ফেসবুক পেজ থেকে৷
অনন্ত জলিলের মূল বক্তব্য ধর্ষণ বন্ধ করতে হবে, কিন্তু নারীদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য শালীন পোশাক পরতে হবে৷ অন্তত জলিল কি আসলেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে এই ভিডিওটি প্রচার করেছেন, নাকি সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য? কেননা এই উপমহাদেশে কিছু লোক মনে করেন, ধর্ষণের জন্য ধর্ষণের শিকার নারীই দায়ী৷ হয় তার পোশাক, মানসিকতা, চাল-চলন, শিক্ষা এসব উঠে আসে অভিযোগের তালিকায়৷ সেই নারীর ওপর দোষ চাপানোর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষদের দলে নাম লেখালেন অনন্ত৷
তারপর এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হতেই বদলে ফেললেন বক্তব্য৷ ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেললেন আগের ভিডিওটি৷ নতুন ভিডিওতে বললেন, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে৷ কিন্তু যে মানসিকতা থেকে তিনি প্রথম ভিডিওটি পোস্ট করেছিলেন, সমালোচনা না হলে কি তার মানসিকতায় বদল ঘটতো? অবশ্য ভিডিও সরিয়ে নিলেও মানসিকতা আদৌ বদলেছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে৷
‘অনন্ত জলিলরা' ভুলে যান, তারা সাধারণ মানুষ নন, তাদের অনুসারী লাখ লাখ৷ সেই লাখ লাখ মানুষ তার প্রথম ভিডিওটার মর্মার্থ মস্তিষ্কে বসিয়ে নিয়েছে, সেটা আর বদল হওয়ার নয়৷ যারা মনে করতেন ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাকই দায়ী, তাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়েছে৷ আর এর দায় আপনাকে নিতে হবে মিস্টার অন্তত জলিল৷
ফেসবুকে আপনার ১৪ লাখ ফলোয়ার৷ আর বর্ষার ১০ লাখেরও বেশি৷ কারখানার শ্রমিকদের কাছে আপনি প্রিয়, অনেক সময় দরিদ্র মানুষকে সহায়তার কারণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘রিয়েল হিরো' হয়ে উঠেছিলেন৷ কিন্তু আপনার সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রমাণ করলো বাংলাদেশের একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের কাছেই হিরো হতে চান আপনি৷
আপনি ভুলে গেলেন, ধর্ষক বয়স দেখে না৷ ভুলে গেলেন, গত তিন মাসে যেসব নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের বয়স ৪ মাস থেকে ৭২ বছর পর্যন্ত৷ তাদের বেশিরভাগই অতি সাধারণ পরিবারের মানুষ, যারা আপনার ভাষ্যমতে ‘শালীন' পোশাক পরেই ছিলেন৷ আমার মনে হয়, শুধু ধর্ষণ নয়, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে যে-কোনো অপরাধ থেকেই মানুষ বিরত থাকবে৷ আপনি আপনার সন্তানকে শেখান যেন পুরুষ না হয়ে মানুষ হয়, সে যেন মেয়েদের সম্মান করে৷ দেশের প্রতিটি পরিবারে যদি এই শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে কোনো মেয়েই আর ধর্ষণের শিকার হবে না৷ মেয়েদের ‘শালীন পোশাক' পরতে না বলে ছেলেদেরই বরং ‘চোখের পর্দা' করার শিক্ষা দেয়া উচিত প্রতিটি পরিবারে৷
যৌন লালসার বিকৃত রূপ
পাঁচ-ছয় বছরের শিশু থেকে শত বছরের বৃদ্ধা, কেউ বাদ যাননি ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে৷ ঘর, গণপরিবহন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতেই ঘটেছে এসব ঘটনা৷ ছবিঘরে দেখে নিন যৌন লালসার এমন বিকৃত রূপের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
লালসার শিকার ছয় বছরের সায়মা
রাজধানীর ওয়ারীতে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ছয় বছরের শিশু আফরিন সায়মা৷ সম্প্রতি এই ঘটনা ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে৷ ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর তার বাবার আবেগধর্মী বক্তব্যে আলোড়িত হয়েছেন সবাই৷
এমন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, নিজের প্রতিবেশও কতোটা অনিরাপদ নারী ও শিশুর জন্য৷
ছবি: bdnews24.com
১২ ছাত্রীর ধর্ষক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ
নারায়ণগঞ্জে ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আল আমিন৷ গ্রেপ্তার আল আমিন ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
শত বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ!
মে মাসে টাঙ্গাইলে শত বছর বয়সি অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরের বিরুদ্ধে৷ ওই কিশোর বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে মুখ বেঁধে তাঁকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায় পুলিশ৷ গ্রেফতার কিশোর সোহেল ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
আগুনে পুড়ল নুসরাত
ফেনীতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জেরে আগুনে পুড়তে হলো নুসরাত জাহান রাফিকে৷ অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন ওই কাণ্ড ঘটায়৷ নুসরাতকে হত্যার আগে নিপীড়ক অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে মানববন্ধনও হতে দেখা গেছে৷ নারায়ণগঞ্জ আর ফেনীর ঘটনা প্রকাশ করছে, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনিরাপদ নারীরা৷
ছবি: picture-alliance/M. Rashid
রাজনীতির বিরোধে ধর্ষণ!
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়৷ এরপর নোয়াখালীতেই আরেকটি ভোট কেন্দ্র করে ছয় সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ ধর্ষণে রাজনীতির সংযোগ নারীর জন্য সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণই করছে৷ এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ছয় মাসে ভিকটিম ৩৯৯ শিশু
মানবাধিকার সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে আটজন ছেলে শিশু রয়েছে৷ ধর্ষণের পর ১৫জন মেয়ে শিশু ও এক ছেলে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ছয় মাসে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য৷
ছবি: Bilderbox
পাঁচ মাসে ৩০০ মামলা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-এর কিছু বেশি৷ আর গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
কিনারা হয়নি তনু হত্যার
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি৷ তনুর পরিবারের অভিযোগ, স্থবির হয়ে আছে তদন্তকাজ৷ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ তনুর পরিবারের৷
ছবি: Twitter
আলোচিত রূপা হত্যা
২০১৭ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ওই মামলায় চারজনকে ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
ক্রসফায়ার কি সমাধান?
ধর্ষককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে৷ ধর্ষককে ক্রসফায়ারে পক্ষে রাস্তায় দাঁড়াতেও দেখা গেছে৷ এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার ধর্ষককে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার কথা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ৷ আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রমাণ হিসাবে দেখা দিয়েছে এসব ঘটনা৷