বড় কোনো ঘটনার পর আমি মন দিয়ে অনলাইনে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য পড়ার চেষ্টা করি৷ বলা বাহুল্য, বেশিক্ষণ সম্ভব হয়ে ওঠে না৷ অসুস্থ বোধ করি৷ বিপুল সংখ্যক মানুষ কী পরিমাণ ঘৃণা আর হিংসা প্রকাশ করেন, সেটা দেখলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা৷
বিজ্ঞাপন
মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আক্রমণ করা হয়েছে– এই খবরের নীচে পাবেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেন মারা গেলেন না সেটা নিয়ে আফসোস৷ তাঁর নামে বিষোদগার, গালাগালি৷ নেপালে আমাদের একটি উড়োজাহাজ ক্র্যাশ করেছে, সেটাকে ঘিরে পাবেন নারীরা কেন উড়োজাহাজ চালায়, সেটা নিয়ে নারীদের বিরুদ্ধে গালাগালি, কুৎসিত যৌনরসাত্মক মন্তব্য৷ ক্রিকেট দল কোনো একটি ম্যাচে পরাজিত হয়েছে, সেই দলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খেলোয়াড়টিকে তাঁর ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ– এসব আকছার ঘটছে৷
মনোবিকারগ্রস্ত এই হাজার হাজার মানুষ আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে– এটি ভাবলেই মনটা বিষন্ন হয়ে উঠে৷ অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না৷ এই ভূখণ্ডের মানুষ সবসময়ই সহমর্মী, মমতাময়ী, পরষ্পরের বিপদে-আপদে উড়ে এসে সহায়তা করা মানুষ৷ এদের একটি বড় অংশ কেন হিংসাত্মক হয়ে উঠছে এর কারণ বের করা জরুরি৷
ঐতিহাসিক হেট স্পিচ
পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক নেতারা হেট স্পিচে মেতেছেন৷ তবে রাজনৈতিক ইতিহাসে হেট স্পিচ নতুন কিছু নয়৷ নানা সময়ে নানা নামে নানা কায়দায় হেট স্পিচ চালু ছিল৷ ছবিঘরে তারই কিছু উদাহরণ দেওয়া গেল৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
ডোনাল্ড ট্রাম্প
বিশ্ব রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি হেট স্পিচের জন্য নাম কিনেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ একবার নয়, বার বার হেট স্পিচ দিয়েছেন৷ তাঁর টার্গেট হয়েছেন কখনো মুসলিমরা আবার কখনো আফ্রিকার মানুষেরা৷ একদা তিনি বলেছিলেন, মুসলিমদের দেশে ঢোকা বন্ধ করে দেবেন তিনি৷ আর আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মানুষদের বিষয়ে বলেছিলেন, তাঁরা ‘শিটহোল’ দেশ থেকে এসেছেন৷ যা নিয়ে প্রভূত সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Harnik
খেয়ার্ট ভিল্ডার্স
গোটা ইউরোপেই এখন অতি দক্ষিণপন্থিদের বারবাড়ন্ত৷ হল্যান্ডে এখনো দক্ষিণপন্থিরা সেভাবে থাবা বসাতে না পারলেও ডাচ নেতা খেয়ার্ট ভিল্ডার্স সংসদে দাঁড়িয়ে যে বক্তৃতা করেছিলেন তা ডাচ ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের দিন৷ ভিল্ডার্স বলেছিলেন, ইসলাম একটি খারাপ বিষয়৷ ইসলামের জন্য হল্যান্ডের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে৷ সংসদেই ভিল্ডার্সকে এরপর চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অন্যান্য সংসদেরা৷
ছবি: Imago/Hollandse Hoogte
যোগী আদিত্যনাথ
ভারতে বর্তমান শাসকদল বিজেপি এবং তার সহযোগীরা হেট স্পিচের জন্য বিখ্যাত৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি অভিযুক্ত গুজরাট দাঙ্গার জন্য৷ হেট স্পিচও দিয়েছেন তিনি একসময়৷ তবে সমসময়ে তাঁর শিষ্য এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হেট স্পিচের জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত হয়েছেন৷ উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একাধিক হেট স্পিচ দিয়েছেন তিনি প্রকাশ্যে৷ দাঙ্গাও বাঁধিয়েছেন৷
ছবি: Imago/Zumapress
প্রবীণ তোগাড়িয়া
বিশ্বহিন্দু পরিষদ বিজেপিরই অন্যতম শাখা সংগঠন৷ সেই সংগঠনের প্রধান প্রবীণ তোগাড়িয়া একটি জনসভায় মুসলিমদের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন৷ এরপর তাঁর বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়েছে৷ সে সব মামলা এখনো চলছে৷
ছবি: UNI
জর্জ ডাব্লিউ বুশ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগেও বহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেট স্পিচের জন্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন৷ ট্রাম্পের সমকক্ষ না হলেও জর্জ ডাব্লিউ বুশ তাঁর অন্যতম৷ বর্ণবিদ্বেষমূলক নীতি গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে৷ বিশেষত স্কুলের ছাত্রদের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/S. Wenig
জন ক্যালভিন কোলড্রিজ
১৯২৩ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন কোলড্রিজ৷ ১৯২৭ সালে হয় ভয়াবহ মিসিসিপি বন্যা৷ অভিযোগ, শ্বেতাঙ্গদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেও কোলড্রিজ কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থাই করেননি৷ বহু কৃষ্ণাঙ্গ সে সময় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন৷ পৃথিবী জুড়ে কোলড্রিজের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছিল৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
উড্রো উইলসন
১৯১৩ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন উড্রো উইলসন৷ বহু ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত হলেও অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো তিনিও হেট স্পিচ দিয়েছেন৷ ক্ষমতায় এসে ফেডারেল শ্রমিকদের কাজের পুনর্নবিকরণ করেছিলেন৷ সে সময় অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গকে চাকরিচ্যূত করেছিলেন৷ যাঁদের কাজ বেঁচে গিয়েছিল, তাঁদের জন্য আলাদা খাওয়ার ঘর, কাজের পরিসরের ব্যবস্থা হয়েছিল৷ শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কাজ করার অধিকার ছিল না তাঁদের৷
ছবি: Getty Images
আডল্ফ হিটলার
কমিউনিস্ট, মুসলিম এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে তিনি যা বলেছেন, সবই হেট স্পিচ৷ শুধু বলেছেন না, ইহুদিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছেন৷ বিশ শতকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি হেট স্পিচের রেকর্ড আডল্ফ হিটলারের মুকুটেই৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
বেনিটো মুসোলিনি
তাঁর শাসনকালেই ‘ফাশিস্ত’ শব্দটির উদ্ভব৷ বিরোধীদের প্রসঙ্গে যে ধরনের মন্তব্য তিনি করতেন, তা এক কথায় হেট স্পিচ৷
ছবি: picture alliance/AP
ইদি আমিন
১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত উগান্ডার স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন ইদি আমিন৷ তাঁর আগের শাসক আবোটের অনুগামীদের বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্য করে তিনি নিজের সমর্থকদের তাতিয়ে দিতেন৷ অভিযোগ, আকোলি এবং ল্যাঙ্গো উপজাতির বিরুদ্ধেও একইরকম মন্তব্য করতেন তিনি৷ এবং শেষ পর্যন্ত ওই দুই উপজাতির মানুষদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল তাঁর দলবল৷ উগান্ডার ইতিহাসে এখনো যা সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়৷
ছবি: Getty Images
জোসেফ স্ট্যালিন
সোভিয়েত রাশিয়ার এই কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধেও হেট স্পিচের অভিযোগ আছে৷ কেবল অ্যামেরিকা নয়, তাঁর নিজের দেশের বিরোধীদের সম্পর্কেও বহু হেট স্পিচ দিয়েছেন তিনি৷ মানুষ উসকেছেন বিরোধীদের একঘরে করার জন্য৷ বস্তুত আয়রন ক্যাম্পও তাঁরই সৃষ্টি৷
ছবি: AFP/Getty Images
আশিন উইরাথু
তিনি ‘মিয়ানমারের বিন লাদেন’ হিসেবেও পরিচিত৷ এই কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু ফেসবুকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট দিয়ে ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন৷ তার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এতটাই প্রভাব বিস্তার করছিল যে ফেসবুক তাঁর পেজটি মুছে ফেলতে বাধ্য হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
জুলফিকার আলী ভুট্টো
বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণ পাকিস্তানের শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা করায় এ নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর খুবই মনোকষ্ট ছিল৷ তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি যে, এদেশের মানুষ তাঁর কথার বিরোধিতা করেছে৷ এমনকি প্রকাশ্যে তিনি জনসভাতেই বলে ফেলেছিলেন৷ ঢাকায় এক জনসভায় তিনি বলেই ফেলেছিলেন যে, ‘‘মঞ্জুর হ্যায় তো ঠিক হ্যায়, নেহি মঞ্জুর হ্যায় তো শুয়োর কে বাচ্চে, জাহান্নাম মে যায়ে৷’’
ছবি: STF/AFP/GettyImages
13 ছবি1 | 13
অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে, এই হিংস্র ও কদর্য মন্তব্যকারীদেরকে আইনের আওতায় আনলেই এই বাড়াবাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে৷ আমি খানিক দ্বিমত পোষন করি৷ প্রথম কথা হচ্ছে, এরা সংখ্যায় অগুনতি, এদেরকে আইনের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা আইনশৃংখলা বাহিনীর নেই৷ দ্বিতীয়টি আসলে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ৷ আপনি আইনের শক্তিতে এদেরকে হয়তো ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারবেন, কিন্তু এদের মনের যে ঘৃণা, সেটিকে নির্মূল করা হবে না৷ এই সম্মিলিত ঘৃণার একটি প্রকাশ সমাজের উপর রয়েই যাবে৷
তাই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মানসিক বিকৃতির কারণ খুঁজে বের করা এবং সেই কারণগুলো নির্মূল করা৷ আমার মনে হয়, শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এখন এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা দিচ্ছে৷ আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকালীন সময়টিও মিডিয়ায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করেছি৷ সেখানে হোয়াইট সুপ্রিমেসি'র বর্ণবাদ এবং ইমিগ্র্যান্ট মানুষদের প্রতি বিরূপ মনোভাব একটি বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে৷ একই কাণ্ড হয়েছে ইংল্যান্ডে৷ ব্রেক্সিট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অনেক মানুষকে আমি প্রকাশ্যেই ইমিগ্র্যান্টদের প্রতি প্রবল ঘৃণা উগড়ে দিতে দেখেছি৷
আশা করি মনোবিজ্ঞানীরা এর সঠিক কারণ গবেষণা করে বের করবেন৷ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে আমি সাদামাটাভাবে কিছু কারণ ভেবে বের করেছি৷ একটি বড় কারণ হতে পারে মানুষের জীবনযাত্রায় নিয়ত অস্থিরতা৷ মানুষ জীবনের চাপ অত্যধিক করে ফেলেছে৷ প্রতিমুহূর্তে চাহিদা বাড়ছে, প্রতিক্ষণ প্রতিযোগিতা বাড়ছে৷ এই চাপ নেয়ার জন্য আমাদের মানসিক গড়ন প্রস্তুত নয়৷ সুতরাং মন বিদ্রোহ করছে, এই চাপ ও চাহিদার নিয়ত যুদ্ধে পড়ে যাওয়ার কারণে আশেপাশের সবকিছুর বিরুদ্ধেই একটি বিরূপ মানসিকতার জন্ম হচ্ছে৷
বাংলাদেশের মতো দেশে এর ছাপ আরো অনেক বেশি কারণ, এই দেশে আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি৷ সমাজে এক শ্রেণির লোক নানান ছলচাতুরি করে সব দখল করে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিশাল একটি গোষ্ঠী পিছিয়ে পড়েছে৷ এরা যথেষ্ট শিক্ষা পায় না, বিনোদন পায় না, সমাজের মূল নেতৃত্বে আসতে পারে না৷ না পারার এই ব্যর্থতার জন্য তারা বাকি সবাইকে দায়ী করছে৷ পিছিয়ে পড়ার কারণে এরা মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে৷ সেই মানসিক পঙ্গুত্বের কারণেই তারা বাকি মানুষদেরকে বিচার করছে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের মতো ক্ষুদ্র মানদণ্ডে৷
মানুষের মব মেন্টালিটি উগরে দেয়ার যে অবারিত দ্বার ইন্টারনেটের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে, সেই খোলা পথে তাই এরা উগরে দিচ্ছে মনের ভেতর চেপে থাকা সকল ঘৃণা৷ যে নারী তার চাইতে এগিয়ে, সেই নারীকে সে সহজেই সেক্সিস্ট মন্তব্য করতে পারছে, যে মানুষ তার চাইতে বেশি আলোকিত, তাঁকে হত্যা করতে চাইছে৷ মানুষের মনের ঘৃণা বন্ধ করতে হলে এই বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে সিরিয়াসলি কাজ করা দরকার৷ নৈতিক, উদারমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সবার জন্য নিশ্চিত করা জরুরি৷ সামাজিকভাবে ভালোবাসা ও সহমর্মিতাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন৷ এটি একদিনের কাজ নয়, কিন্তু এই কাজটি গুরুত্বের সাথে শুরু করার এখনই সময়৷
আমরা যদি মানুষকে মানুষ বানাতে না পারি, তাহলে এই সম্মিলিত ঘৃণা একদিন আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ঘায়েল করে ফেলবে৷ সভ্যতার পথে পৃথিবী অনেক হাজার বছর হেঁটে এসেছে, এখনই যদি আমরা পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক পৃথিবী বানাতে না পারি, তাহলে আর কবে পারবো?
লেখকের সাথে আপনি কি একমত? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷