ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যখন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রেখে তথ্য প্রকাশের উপায় খুঁজছেন, ‘দ্য বব্স’ তখন সন্ধান করে চলেছে অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের সেরা প্রকল্পগুলোর৷ এই প্রতিযোগিতায় মনোনয়ন জমা দেয়া যাবে ৫ মার্চ পর্যন্ত৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের ‘দ্য বব্স' প্রতিযোগিতার শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ বাক স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামরত বিভিন্ন সমষ্টিগত বা ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিতে তখন থেকেই সচেষ্ট এই প্রতিযোগিতা৷ দ্য বব্স-এর সাবেক বিচারক এবং স্পেনের নাভারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক খোসে লুইস ওরিহুয়েলা বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ এবং ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে যে যুগ শুরু হয়েছে, তার আগে কিন্তু বাক স্বাধীনতার বিষয়টি অধিকাংশক্ষেত্রেই সেই সব মানুষের দখলে ছিল, যাঁরা কোনো না কোনোভাবে মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ব্লগিং জগতে বিপ্লবের পর অবশ্য বাক স্বাধীনতা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারে পরিণত হয়েছে, কেননা ইন্টারনেট সংযোগযুক্ত ফোন যে কাউকে বিশ্ব মিডিয়ার অংশ হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে এখন৷''
এক ধরনের ইঁদুর-বেড়াল খেলা
তবে মানুষের বাক স্বাধীনতার ব্যাপারটি অঞ্চল ভেদে ভিন্ন৷ বিশ্বের বহু দেশে এখন ইন্টারনেটে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ বিপজ্জনক ব্যাপার৷ অনেকক্ষেত্রে ইন্টারনেট স্বাধীনতা ক্রমশ পড়তির দিকে বলে জানিয়েছে নজরদারি সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস'৷
রিপোর্টাস উইদাআউট বর্ডার্স জার্মানির মুক্ত ইন্টারনেট ডেস্কের হাউকে গিরো এ বিষয়ে বলেন, ‘‘সাংবাদিক এবং ব্লগারদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সহিংসতার খবর আমরা পাচ্ছি৷ গোটা বিশ্বের এ দিকে নজর দেয়া উচিত৷''
১০ বছর আগে ইন্টারনেট নজরদারি চীন, ইরান এবং অন্যান্য দমনমূলক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল৷ অ্যাক্টিভিস্ট এবং সরকার বিরোধীরা এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং নিজেদের পরিচয় যথাসম্ভব গোপন রেখে ‘সেন্সরশিপ' কাটিয়ে চলার চেষ্টা করতেন৷ এই যেমন, চীনা সরকার প্রথম থেকেই যে কোনো ওয়েবসাইট এবং অনলাইন সেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে এসেছে৷ তাই এ সব বিধিনিষেধ কাটাতে বিভিন্ন প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন অ্যাক্টিভিস্টরা৷ ফলে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং নজরদারি সংস্থাগুলোর মধ্যে ‘ইঁদুর-বেড়াল' খেলা চলছেই৷
নজরদারি বাড়ছে
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসএ-র একসময়কার চুক্তিবদ্ধ কর্মী এডোয়ার্ড স্নোডেন সবার সামনে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন৷ নজরদারি আর চীন বা ইরানোর মতো দেশে সীমাবদ্ধ নেই৷ বরং স্নোডেনের প্রকাশ করা গোপন নথি অনুযায়ী, এনএসএ গণহারে মানুষের ফোন কল, টেক্সট ম্যাসেজ, এমনকি ই-মেল এবং ওয়েব ব্রাউজিং-এর ইতিহাসের দিকেও নজর রাখছে৷
গুয়াতেমালার মানবাধিকার কর্মী এবং ‘দ্য বব্স'-এর বিচারক রেনাটা আভালা বলেন, ‘‘স্নোডেনের প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমাদের উচিত যারা সরকারকে গোয়েন্দাগিরিতে সহায়তা করে পুরো ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলছে এবং ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা৷''
তথ্যকল্যাণী, শিক্ষক ডটকমসহ বিজয়ী যারা
ডয়চে ভেলের সেরা অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড দ্য বব্স-এর ২০১৩ সালের বিজয়ীদের নিয়ে বিশেষ ছবিঘর এটি৷ এই আসরে বাংলাদেশের তথ্যকল্যাণী প্রকল্প জিতেছে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’, শিক্ষক ডট কম পেয়েছে ‘ইউজার প্রাইজ’৷
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
সেরা ব্লগ: লি চেনপেং
চীনা লেখক ও সাংবাদিক লি চেনপেং সেরা ব্লগ পুরস্কার জিতে নিলেন৷ ‘গোটা বিশ্ব জানে’ নামের একটি বই লিখে চীনা কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়েছেন তিনি৷ বইয়ের প্রচারের সময় মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল তাঁকে৷ প্রতিবাদে তিনি নিজের লেখা থেকে অংশবিশেষ পাঠের সময়ে পরে নিলেন একটি অক্সিজেন মুখোশ৷ ‘নীরব পাঠ’-এর সেই অনুষ্ঠানে তাঁর পরনে ছিল একটি টি-শার্ট, যাতে লেখা ‘আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি’৷
ছবি: Li Ruihe
সেরা উদ্ভাবন: ফ্রিওয়াইবো ডট কম
‘ফ্রিওয়াইবো ডট কম’ নামের মাইক্রোব্লগিং সাইট চীনের সরকারের সেন্সরশিপ প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা দিচ্ছে৷ এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চীনের অন্যতম প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ‘সিনাওইবো ডটকম’-এর সেন্সরমুক্ত সংস্করণে ঢুঁ মারা যায়৷ ফলে ব্যবহারকারীরা জানতে পারেন, কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিবেদন মুছে ফেলে৷
ছবি: freeweibo.com
সেরা উদ্ভাবন: শিক্ষক ডটকম
বাংলাভাষার পক্ষে শিক্ষক ডটকম এই বিভাগে ‘ইউজার প্রাইজ’ জয় করেছে৷ মূলত বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বাংলায় অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে শিক্ষক ডট কম৷ এই সাইটটি গড়ে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ রাগিব হাসান৷ ডয়চে ভেলের প্রতিযোগিতা চলাকালে শিক্ষক ডটকমের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ৷
সেরা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম: ৪৭৫
মরক্কোর তরুণ প্রজন্মের এক উদ্যোগের নাম ‘৪৭৫’৷ মরক্কোর আইনের ৪৭৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করলেই শাস্তি এড়াতে পারে৷ এই ধারার কারণে ২০১২ সালে ১৬ বছরের কিশোরী আমিনা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল৷ সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ‘৪৭৫’ নামের একটি চলচ্চিত্র এবং ফেসবুক ও ফ্লিকার-এ সোশ্যাল মিডিয়া অভিযান৷
ছবি: Naji Tbel
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স: ফাবি কুয়াসি
প্রতি বছরের মতো এবারও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এমন এক প্রতিযোগীকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যিনি বা যাঁরা মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন৷ এ বছর সেই পুরস্কার পাচ্ছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ টোগো-র মানবাধিকার কর্মী ফাবি কুয়াসি৷ দেশের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় পুলিশ সাংবাদিকদের উপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, ফাবি সেই সব ঘটনা তুলে ধরছেন তাঁর ওয়েবসাইটে৷
ছবি: fabbikouassi.wordpress.com
গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম পুরস্কার: তথ্যকল্যাণী
২০১৩ সালে ডয়চে ভেলে আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের বিষয় হলো ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ’৷ বব্স প্রতিযোগিতায়ও বিষয়টিকে আলাদা বিভাগের মর্যাদা দিচ্ছে৷ বাংলাদেশের ‘তথ্যকল্যাণী’ প্রকল্প এবার এই বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছে৷ জুরিমণ্ডলীর কাছে এটা এমন এক ‘বৈপ্লবিক প্রকল্প যার মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাংলাদেশের অতি দরিদ্র মানুষের নাগালে চলে আসছে৷’
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
সবচেয়ে সৃজনশীল ও মৌলিক উদ্যোগ: আমি ও আমার ছায়া
ইন্টারনেটে আমাদের গতিবিধির চিহ্ন কতটা থেকে যায়? এই প্রশ্ন নিয়েই কাজ করছে ‘মি অ্যান্ড মাই শ্যাডো’ বা ‘আমি ও আমার ছায়া’৷ ইন্টারনেটে কীভাবে নিরাপদে বিচরণ করা যায় ও তা করতে কী কী জানতে হয়, খেলাচ্ছলে ব্রাউজারের সেটিং বদলানোর মতো সেই সব পথ বাতলে দিচ্ছে এই ওয়েবসাইট৷ এই উদ্যোগের পিছনে রয়েছে ‘ট্যাকটিক্যাল টেকনোলজি কালেক্টিভ’ নামের এক আন্তর্জাতিক সংগঠন৷
ছবি: myshadow.org
সেরা বাংলা ব্লগ: শৈলী
সেরা বাংলা ব্লগ বিভাগে ইউজার প্রাইজ জয় করেছে শৈলী ব্লগ৷ এই জয়ের পর ডয়চে ভেলেকে জানানো প্রতিক্রিয়ায় শৈলী ব্লগের কর্ণধার রিপন কুমার দে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘এটা শুধু আমি না, সকল শৈলার এবং শৈলীর পাঠকদের জন্য খুব আনন্দের খবর৷ শৈলার এবং পাঠকদের ভালোবাসা ছাড়া এই স্বীকৃতি কোনোভাবেই আসত না৷ তাই তাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা৷ সকলের ভালোবাসা নিয়ে শৈলী আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে এটাই আমার প্রত্যাশা৷’’
ছবি: http://shoily.com/
বাংলা সেরা অনুসরণযোগ্য: সাইফ সামির
‘বাংলা: সেরা অনুসরণযোগ্য’ বিভাগে বিজয়ী সাইফ সামির৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার কর্তৃক লেখক-ব্লগার-সাংবাদিকদের ওপর যে দমন-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে ডয়চে ভেলের মাধ্যমে আমি তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷ একজন লেখককে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশের জন্য আটক করা হবে, রিমান্ডে নেয়া হবে – এটা কি ধরনের কথা?’’
ছবি: Twitter
9 ছবি1 | 9
বিশ্বাস ভঙ্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ যখন ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে, তখন ‘দ্য বব্স' বিচারক আরাশ আবাদপুরের ভাষায়, ‘‘ইরানিরা নিজেরাই নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷''
আবাদপুর বলেন, ‘‘স্নোডেন যেটা দেখিয়েছেন, তা হচ্ছে রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করাটা অনেকক্ষেত্রেই একটা বড় ভুল৷ আমি নিজেই অনেক সময় চিন্তা করি যে, বিশ্বাসের বাস্তব ভিত্তি আদতে কী হতে পারে?''
তবে বিশ্বাসের বাস্তব ভিত্তি তৈরির আগ পর্যন্ত ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্টদের তথ্য প্রকাশের এমন উপায়ের ওপর ভরসা করতে হবে, যাতে তাঁদের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, বলেন আভিলা৷ তাঁর কথায়, ‘‘মূলধারার গণমাধ্যম যে সময় চুপ থাকে, সে সময় ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় সক্ষম ব্লগ প্ল্যাটফর্ম সেন্সরশিপ প্রতিরোধের মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়৷''
উল্লেখ্য, বুধবার (০৫.০২.২০১৪) থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাক স্বাধীনতা এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের সেরা এবং আকর্ষণীয় প্রকল্পগুলো সম্পর্কে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মতামত জানতে চায় দ্য বব্স৷ ১৪টি ভাষায় অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেয়া যাবে www.thebobs.com/bengali ঠিকানায়৷