টিআইবি মনে করে, তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায়৷ তাই ৫৭ ধারা বাতিল ও অনলাইন নীতিমালা সবার মতামতের ভিত্তিতে সংশোধনের দাবি জানিয়েছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭(১) উপধারা, ৮০ ও ৮৬ ধারা এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪-এর ৫ (১.৩), ৫ (১.৫) ও ৫ (১.৯) বিতর্কিত ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় অনলাইন গণমাধ্যমসহ অন্যান্য গণমাধ্যমকেও তা মেনে চলতে হবে, যা গণমাধ্যমের সুষ্ঠু বিকাশের অন্তরায় এবং সংবিধান স্বীকৃত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার পরিপন্থি৷'
নীতিমালা অনুযায়ী, অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রস্তাবিত কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত করার যে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে, তা গণমাধ্যমের স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার বাধাগ্রস্ত করতে পারে৷
এ নীতিমালায় অনলাইন গণমাধ্যমকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়৷ বাংলাদেশে নিবন্ধিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা এবং এর মাধ্যমে এ সব সংস্থাকে গণমাধ্যম নীতিমালার আওতাভুক্ত করা অযৌক্তিক৷
ইফতেখারুজ্জামান
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালাটি যুগোপযোগী করতে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্টরা যে মতামত ও সুপারিশ করেছে – তা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি৷ ফলে অনলাইন গণমাধ্যমসহ অন্যান্য গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ক্ষেত্রবিশেষে বাধাগ্রস্ত হতে পারে৷
তাই টিআইবি অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট খাতে যোগ্যতাসম্পন্ন, গ্রহণযোগ্য ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে৷ পাশাপাশি ভয়ভীতি ও পক্ষপাতহীনভাবে যেন সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাও নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে৷
এ বিষয়ে টিআইবি-র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা সর্বজন ও সংবিধান স্বীকৃত মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থি৷ সেটা অনলাইন নীতিমালার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷ এই নীতিমালা করার সময় নাগরিকদের মতামত নেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু সেই মতামতের প্রতিফলন নীতিমালায় নাই৷''
তিনি বলেনন, ‘‘অনলাইন গণমাধ্যম কী, তা নীতিমালায় স্পষ্ট নয়৷ যার কারণে বাংলাদেশের যে কোনো অনলাইনকেও এই নীতিমালার আওতায় আনা যাবে, যা কেনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ কারণ একটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটও এই নীতিমালার আওতায় এসে যাবে৷ এছাড়া অনেক সংজ্ঞা এবং শব্দও পরিষ্কার করা নাই৷ এই অস্বচ্ছতাই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দেয়৷''
গণমাধ্যমের ভ্রান্তি ও উপস্থাপনের নীতিমালা
গণমাধ্যমে কোন খবর কীভাবে প্রকাশ করা হবে, কী ছবি বা ভিডিও যাবে সেই প্রতিবেদনের সাথে – এ নিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব সতর্ক৷ জটিলতা রয়েছে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে৷ দেখা যাক গণমাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু ভুল এবং অসঙ্গতি৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
মানবিকতা না পেশাদারিত্ব?
সুদানে মৃতপ্রায় একটি শিশু মাঠে পড়ে রয়েছে আর তার ঠিক কয়েক হাত দূরেই একটি শকুন তাকিয়ে রয়েছে –১৯৯৩ সালে বিশ্ব তোলপাড় করা এই ছবিটি তুলেছিলেন বিখ্যাত ফোটো জার্নালিস্ট কেভিন কার্টার৷ পুলিত্জার পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল শিশুটির মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে তিনি কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন না? আর এ কারণেই হয়ত আত্মহত্যা করেছিলেন কেভিন৷
ছবি: DW/C. Wanjoyi
ধর্ষিতার ছবি ও পরিচয় প্রকাশ নয়
সংবাদ নীতিমালা বলে, ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়নের শিকারের নাম প্রকাশ করা যাবে না৷ কিন্তু অনেকক্ষেত্রে গণমাধ্যম ধর্ষিতার এলাকার নাম বা তাঁর কোনো আত্মীয়ের পরিচয় প্রকাশ করে৷ এ যুগেও সাংবাদিকতার এমন ভুল সত্যিই মর্মান্তিক৷
ছবি: Fotolia/DW
অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগে ছবি প্রকাশ নয়
সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী, অপরাধ করেছে সন্দেহে পুলিশ ধরার পরই তার ছবি সাংবাদিকরা প্রকাশ করতে পারেন না, কেননা, অপরাধ তো তখনো প্রমাণিত হয়নি৷ কিন্তু বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগেই ছবি প্রকাশ করার ঘটনা ঘটে৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের একটি প্রধান দৈনিক হিন্দু নারীদের ছবি প্রকাশ করে, যারা ভোট কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ক্যাপশনে যে স্থানের উল্লেখ ছিল, ছবিটি সেই স্থানের ছিল না৷ ফটোশপের সহায়তায় কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছিল ছবিটিতে৷ ছবিটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল তখন৷
ছবি: DW/S. Kumar Day
একতরফা বক্তব্য নয়
বড় বড় ইস্যুতে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এক তরফা বক্তব্য প্রচার করে৷ কিন্তু সাংবাদিকতার প্রথম নীতিই হলো নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন৷ অর্থাৎ কোনো ঘটনায় উভয় পক্ষের বক্তব্য থাকতে হবে৷ না হলে জন্ম নেবে বিতর্কের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উদ্ধার কাজে সমস্যা বা আহতদের প্রশ্ন
দুর্ঘটনা স্থলে অতিরিক্ত সাংবাদিকের উপস্থিতি কাজে বাধার সৃষ্টি করে৷ একইভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ বা নিহতদের স্বজনদের ঘটনা ঘটার মুহূর্তে প্রশ্ন করাটা একেবারেই অমানবিক৷ এতে নৈতিকতার চেয়েও মানবিকতার প্রশ্ন এসে যায়৷ বিশ্বের অনেক দেশের সাংবাদিকরা এমন পরিস্থিতিতে ঐ আহত বা নিহতদের স্বজনদের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
ভুল ছবি, ভুল সংবাদ পরিবেশন
যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের দুটি দৈনিক পত্রিকা কাবা শরীফের ছবি ব্যবহার করে মিথ্যা সংবাদ ছাপাতেও পিছপা হয়নি৷ ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন’ শিরোনামে তারা একটি সংবাদ পরিবেশন করে, যেটা কিনা ১৮ অক্টোবর ২০১২ তে প্রকাশিত কাবার গিলাফ পরানোর সময় তোলা৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়া
গত দুই বছরে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট আইএস বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে জবাই করে হত্যা করেছে এবং সেই হত্যাদৃশ্যের ভিডিও প্রচার করেছে৷ অনেক সংবাদ মাধ্যমও নিজেদের টিআরপি বাড়াতে সেই ভিডিও প্রচার করেছে৷ কিন্তু একদিকে এই ভয়াবহ দৃশ্য মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে জঙ্গিবাদকে উসকে দেয় না কি!
ছবি: SITE Intel Group/Handout via Reuters
শিশুদের ছবি প্রকাশ না করা
কোনো শিশুর বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে৷ মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে অনেক সংবাদমাধ্যম তখন শিশুটিকে নিয়ে নানা প্রতিবেদন তৈরি করে৷ এতে যে শিশুটির উপর মানসিক চাপ তৈরি হয়, এটা সাংবাদিকদের বোঝা উচিত এবং এটা নীতিবিরুদ্ধ৷
ছবি: DW
শিশু অপরাধী এবং শিশু নির্যাতনের শিকার
অনেক দেশেই শিশু অপরাধীদের ছবি প্রকাশ করা হয় না৷ পাশাপাশি কোনো শিশুর ছবি তুলতে হলে অভিভাবকদের অনুমতি লাগে৷ এছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে শিশুদের নিরাপত্তার স্বার্থেও অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাদের ছবি প্রকাশ করা উচিত নয়৷ কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নীতি মেনে চলা হয় না৷ বাংলাদেশে নির্যাতিত শিশুর ছবিও হরহামেশাই প্রকাশ করা হয়৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
10 ছবি1 | 10
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘অনলাইন গণমাধ্যমকে কমিশনের কাছ থেকে তাদের সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার যে বিধান রাখা হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য৷ এটা কণ্ঠরোধের একটি কৌশল৷ সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রতিষ্ঠান ঠিক করবে৷ এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার কোনো বিষয় নয়৷ চাপিয়ে দিলে কোনো ভালো ফলও আসবে না৷ এটা বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাধারণভাবে সংবাদমাধ্যমের জন্য গাইড লাইন ও আচরণ বিধি থাকে, যা তারা অনুরণন করেন৷ এর বাইরে কোনো বাধ্যবাধকতার মধ্যে যায় না৷''
ইফতেখারুজ্জামানের কথায়, ‘‘এখনো সময় আছে জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৭ কার্যকর না করে, বরং অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা করা, যাতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়৷''
ফিরে দেখা: ২০১৬ সাংবাদিকদের জন্য যেমন ছিল
সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)-র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাংবাদিকরা ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ এ বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংবাদিককে কারাবন্দি করা হন৷
ছবি: picture-alliance/AP/M. Ugarte
যারা তালিকা বানিয়েছে
সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক বেসরকারী এবং অলাভজনক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) যাত্রা শুরু করে ১৯৮১ সালে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাকস্বাধীনতার পরিস্থিতি এবং সাংবাদিকদের উপরে হামলার তথ্যাদি বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরে সংগঠনটি৷
কারাবন্দি ২৫৯ সাংবাদিক
সিপিজে-র বাৎসরিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে কমপক্ষে ২৫৯ সাংবাদিককে কারাবন্দি করা হয়৷ আগের বছর এই সংখ্যাটি ছিল ১৯৯৷
ছবি: AFP/Getty Images/K. Desouki
শীর্ষে তুরস্ক
সাংবাদিকদের কারাবন্দি করা দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান এক নম্বরে রয়েছে৷ গতবছরের এক ডিসেম্বর অবধি এক বছরে ৮১ সাংবাদিককে আটক করেছে দেশটি৷ গত জুলাইয়ে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনার পর সন্দেহের বশে সাংবাদিকদের আটকসহ বেশ কিছু গণমাধ্যম বন্ধও করে দিয়েছে সেই দেশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দ্বিতীয় অবস্থানে চীন
তুরস্কের পরই রয়েছে চীন৷ ২০১৬ সালে কমপক্ষে ৩৮ সাংবাদিককে কারাবন্দি করেছে সেদেশ৷ দেশটিতে সরকারবিরোধী যে কোনো আন্দোলনের প্রতিবেদন প্রকাশে কড়াকড়ি রয়েছে৷ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোও চাপা দেয়ার চেষ্টা করে দেশটি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Apple Daily
তৃতীয় স্থানে মিশর
গতবছর ২৫ সাংবাদিককে আটক করেছে মিশর৷ কিছুক্ষেত্রে সাংবাদিকতা নয় বরং অবৈধ কর্মকাণ্ডে সম্প্রক্ত থাকার দায়ে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সে’দেশের সরকার৷
ছবি: Reuters/A.A.Dalsh
প্রথম পাঁচে নেই ইরান
তবে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের তালিকায় প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে নেই ইরান৷ বরং অতীতে কারাবন্দি সাংবাদিকদের কয়েকজন রেহাই পেয়েছে বছরটিতে৷
ছবি: Ilna
বাংলাদেশের দুই সাংবাদিক কারাবন্দি
বাংলাদেশের দু’জন সাংবাদিক এখনো কারাবন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছে সিপিজে৷ সাপ্তাহিক ব্লিটস পত্রিকার সম্পাদক সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জেলে রয়েছেন৷ অন্যদিকে, একুশে টেলিভিশনের মালিক আব্দুস সালাম জেলে আছেন ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে৷