খাপ পঞ্চায়েত, অনারকিলিং ইত্যাদি বিষয়গুলিকে বন্ধ করার জন্য যুগান্তকারী রায় দিল ভারতের শীর্ষ আদালত৷ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে নাগরিক সমাজ৷
বিজ্ঞাপন
বর্তমান ভারতের সামাজিক প্রেক্ষিতে যুগান্তকারী রায়৷ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দিলো, দেশের সাবালক পুরুষ এবং মহিলারা তাঁদের পছন্দের যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন৷ সমাজ, পরিবার কিংবা খাপ পঞ্চায়েতের সে বিষয়ে নাক গলানোর কোনও অধিকার নেই৷
উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের বহু অঞ্চলে ‘খাপ পঞ্চায়েত’ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রামের মুরুব্বিদের নিয়ে তৈরি হয় এই খাপ পঞ্চায়েত৷ গ্রামের সেই মুরুব্বি বা মাতব্বরেরা নিজস্ব আইনকানুন তৈরি করেন৷ তাঁদের দাপটে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা ইচ্ছেমতো যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন না৷ জাতি-বর্ণ-গোত্র-ধর্ম এই সমস্ত বিষয় খতিয়ে দেখে মুরুব্বিরা সবুজ সংকেত দিলে তবেই বিয়ে হয় গ্রামে৷
অনার কিলিং: পরিবারের সম্মানের নামে হত্যা
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে প্রতি বছর সারা বিশ্বে কত কিশোরী, তরুণী ও মহিলাকে অংশত শারীরিক নির্যাতনের পর নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ সংখ্যাটা ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: DW
প্রতিবছর কতজন অনার কিলিংয়ের শিকার?
২০০০ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সংগৃহীত ও প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৫,০০০ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে৷ এই সংখ্যা জাতিসংঘের বিবৃতির সঙ্গেও মেলে৷ যেহেতু বহু অনার কিলিংয়ের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, সেহেতু বাস্তব পরিসংখ্যান এর চারগুণ হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যাদের হত্যা করা হয়
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের গড় বয়স ২৩ ও তাদের ৯৩ শতাংশই মেয়ে৷ দুই-তৃতীয়াংশ প্রাণ হারায় পরিবারের সদস্যদের হাতে৷ নিহতদের অর্ধেক হত্যাকারীর মেয়ে, নয়তো বোন; নিহতদের এক চতুর্থাংশ হত্যাকারীর স্ত্রী কিংবা বান্ধবী৷ হত্যার কারণ ষাট ভাগ ক্ষেত্রে ‘বড় বেশি পশ্চিমি’ হয়ে পড়া; বাকিদের ক্ষেত্রে পুরুষ বা পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Sarbakhshian
পাকিস্তান: ইজ্জতের নামে হত্যা
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সালে পাকিস্তানে প্রায় ১,১০০ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে৷ পাকিস্তানের গ্রামীণ সমাজে অনার কিলিংয়ের প্রতি জনসাধারণেরও সমর্থন থাকার ফলে, এই কুপ্রথা দূর করার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যহত হয়েছে ও হচ্ছে৷ ইতিপূর্বে নিহতের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিলে সে ছাড় পেতো; এ’বছর আইনের সে ফাঁকটি বন্ধ করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সোশ্যাল মিডিয়া স্টার কান্দিল বেলুচের হত্যা
২০১৩ সালে পাকিস্তানি আইডলের জন্য অডিশন করার পর থেকেই এই পাকিস্তানি তরুণী একজন ইন্টারনেট সেলিব্রিটি হয়ে পড়েছিলেন৷ ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই কান্দিলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাঁর নিজের ভাই ওয়াসিম আজিম৷ আজিম বোনকে খুন করার কথা স্বীকার করে বলেছে, পরিবারের ‘ইজ্জতের’ উপর ‘দুর্নাম’ আনছিলেন কান্দিল, তাই...৷
ছবি: Facebook/Qandeel Baloch via Reuters
পাথর ছুঁড়ে হত্যা
২০১৪ সালের ২৭শে মে৷ পাকিস্তানের লাহোর শহরে পুলিশ মর্গের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে শোয়ানো ফারজানা ইকবালের মৃতদেহকে ঘিরে কাঁদছেন প্রবীণারা৷ প্রেমিককে বিয়ে করার দোষে লাহোর হাইকোর্টের সামনে পাথর ছুঁড়ে ফারজানাকে হত্যা করে তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷
ছবি: Reuters
ভারতে অনার কিলিং
গোটা দেশে বছরে হাজার খানেক অনার কিলিং হয় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে, যদিও বাস্তবিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়৷ উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানাতেই অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে বেশি, দক্ষিণ ভারত বা মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটে সে তুলনায় কম৷ অনার কিলিংয়ের খবর পাওয়া গেছে পাঞ্জাব ও বিহার থেকেও৷ পশ্চিমবঙ্গে অনার কিলিং গত একশ’ বছর ধরেই প্রায় নেই বললেই চলে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saurabh Das
‘বাংলাদেশে অনার কিলিং মানসিকতায়’
বাংলাদেশে অনার কিলিংয়ের খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷ তবে পরিবারের পছন্দে বিয়ে না করার কারণে হত্যার ঘটনা বেশ কিছু ঘটেছে৷ তাই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেনন, ‘‘অনার কিলিংয়ের মানসিক অবস্থা এখানে (বাংলাদেশে) বিদ্যমান৷ পাকিস্তানের মতো এখানে এটা প্রকট নয়৷ তবে যা হচ্ছে তা ব্যক্তি ও পরিবারের অহংবোধ থেকে৷ এখানে সমস্যাটি হলো ধনী-গরীবের ব্যবধান নিয়ে৷''
ছবি: Meya online netwark
অন্য দেশে...
ব্রিটেনে অভিবাসীদের মধ্যে অনার কিলিং বিরল নয়৷ কুর্দি, পাকিস্তানি ও সিরীয় বাবারা নিজেদের মেয়েদের স্বহস্তে হত্যা করছেন, এমন ঘটনা বারংবার ঘটেছে৷ ২০১০ সালে এক শিখ পিতা তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষিপ্ত হলেও, অভিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একাধিক অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷ জার্মানি ও ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশেও অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. R. Caivano
ক্যানাডায় আফগান বাবার হাতে তিন মেয়ে খুন
ঘটনাটা আলোড়ন তুলেছিল ২০০৯ সালে৷ সে বছর ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের কিংস্টন শহরের খালে একটি গাড়ি ডুবন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ গাড়িতে ছিল ১৯, ১৭ ও ১৩ বছর বয়সের তিনটি মেয়ে ও তাদের মায়ের লাশ৷ ২০১২ সালের ছবিতে (ওপরে) মেয়ে তিনটির বাবা মোহম্মদ শাফিয়া, তাঁর স্ত্রী তুবা মোহম্মদ ইয়াহিয়া ও পুত্র হামেদকে কিংস্টন আদালতে পৌঁছতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters
বার্লিনে হাতুন সুরুচু হত্যাকাণ্ড
হাতুন সুরুচু ছিলেন তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে জার্মানিতে আসা এক কুর্দ দম্পতির সন্তান৷ বার্লিনের তুর্কি-অধ্যুষিত ক্রয়েৎসব্যার্গ অঞ্চলে মানুষ হয়েছেন৷ ১৬ বছর বয়সে তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় তুরস্কে৷ জার্মানিতে ফিরে হাতুন পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ও স্বাধীন জীবন যাপন শুরু করেন৷ একটি কলহের পর হাতুনকে বার্লিনের এক বাস স্টপে মাথায় তিনবার গুলি করে মারেন তাঁর ভাই আইহান সুরুচু৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেই বাস স্টপ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
শুধু তাই নয়, মহিলাদের আচরণ থেকে শুরু করে ভিনধর্মের, ভিনবর্ণের, ভিনজাতের মানুষের প্রতি হিংসামূলক আচরণেরও একাধিক অভিযোগ রয়েছে এই খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে৷ বিজেপি’র শাসনামলে ভারতে এই খাপ পঞ্চায়েতের কাজকর্ম বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই অভিযোগ৷ তাদের হিংসার শিকার হয়েছেন দলিত এবং ভিনধর্মের মানুষেরা৷ অথচ এই খাপ পঞ্চায়েতের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই৷ দেশের আইন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এদের কোনো উল্লেখ নেই৷ স্রেফ ঐতিহ্যের উল্লেখ করে ২০১৮ সালের ভারতেও তারা টিকে রয়েছে এবং নিজেদের বিদ্বেষমূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে৷
সুপ্রিম কোর্ট এর আগেও খাপ পঞ্চায়েতের কাজকর্মের সমালোচনা করেছে৷ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে৷ বিয়ে সংক্রান্ত রায় বিষয়ে আলোচনার সময় প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বেঞ্চ আরও একবার খাপ পঞ্চায়েতের বিষয়ে মন্তব্য করে৷ বলা হয়, প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আদালত বাধ্য হবে সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খাপ পঞ্চায়েতের পাশাপাশি ‘অনার কিলিং’ বা ‘সম্মানরক্ষার্থে’ খুনের ঘটনাও উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ মিশ্রবর্ণের বিয়ের পর নিজের মেয়ে এবং জামাইকে সর্বসমক্ষে খুন করার বহু অভিযোগ উঠেছে কোনো কোনো এলাকায়৷ বস্তুত, বছরকয়েক আগে এই বিষয়ে ‘এনএইচ টেন’ নামে একটি ফিল্মও তৈরি হয়েছিল৷ সেখানে দেখানো হয়েছিল একটি অনার কিলিংয়ের ঘটনা৷ ভারত জুড়ে সেই ছবি সাড়া ফেলে দিয়েছিল৷ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ‘সমাজ’ এবং ‘পরিবার’ শব্দটির উল্লেখ করে শীর্ষ আদালত ‘অনার কিলিং’-এর বিষয়টিকেও সামনে আনতে চেয়েছে৷
স্বভাবতই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে দেশের নাগরিক এবং বিশিষ্ট সমাজ৷ তাঁদের দাবি, খাপ পঞ্চায়েতকে রোখার জন্য আরও পদক্ষেপ করুক সুপ্রিম কোর্ট৷ প্রশাসনও আইন মোতাবেক খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক৷