ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমানে ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে' মিসাইল ছুড়েছিল ইরান৷ যার আঘাতে বিমানটি ভূপাতিত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে দেশটি৷ এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেশটির সেনাবিহিনীকে উদ্ধৃত করে বলা হয় বিমানটি ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ডের স্থাপনার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা এটিকে শত্রুপক্ষ ভেবে ভুলবশত মিসাইল ছুড়ে ভূপাতিত করে৷
ইরানের সেনাবাহিনী জানায় এঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে৷ নিজেদের মনিটরিং সিস্টেম আরো শক্তিশালী করার কথাও জানানো হয় বিবৃতিতে৷
গত বুধবার রাতে ইউক্রেনের কিয়েভগামী বিমানটি ইরানের ইমাম খোমেনি বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছক্ষণ পরেই কাছাকাছি স্থানে আছড়ে পড়ে৷ এ ঘটনায় ১৭৬ জন আরোহীর সবাই নিহত হন৷
নিহতদের মধ্যে ৮২ জন ইরানের, ৫৭ জন ক্যানাডার এবং ইউক্রেনের ১১ জন নাগরিক ছিলেন৷
ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার জেরে ইরান ও অ্যামেরিকার মধ্যে তখন উত্তেজনা বিরাজ করছিল৷ হত্যার জবাবে সেই রাতে ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালায় ইরান৷
বিবৃতিতে দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সেসময় যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত ছিল৷ ‘‘এমন অবস্থায় ভুলবশত এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে বিমানটিতে আঘাত হানা হয়৷''
তবে বিমানটি মিসাইলের আঘাতে ভূপাতিত হয়ে থাকতে পারে বলে আগে থেকে সন্দেহ করছিল ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন৷
এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল ইরান৷
বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন ‘‘ইরানের পক্ষ থেকে আমি এ ঘটনায় গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি৷'' এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশও দেন তিনি৷
পূর্ণ তদন্ত চায় ইউক্রেন
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা স্বীকারের পর, ইরানের কাছে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত, দোষীদের বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস চেয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমিয়ের জিয়েলইয়েনস্কি, জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো৷
বিমান ভূপাতিত করার কথা স্বীকার করার ফলেই ঘটনাটি শেষ হয়ে যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী অলেক্সি হোনচারুক৷ এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন ‘‘ঘটনা স্বীকার করে নেওয়া তদন্ত কাজের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষপ৷ ঘটনার বিস্তারিত ও প্রকৃত কারণ জানতে আমাদের বিশেষজ্ঞরা কাজ করে যাচ্ছেন৷''
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Taherkenareh
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷