ঘুমের ওষুধের খুব একটা সুনাম নেই৷ বলা হয় এসব বিপজ্জনক ও আসক্ত করে৷ কিন্তু অনিদ্রা যাঁদের নিত্যসঙ্গী তাঁদের কাছে ঘুমের ওষুধের দিকে হাত বাড়ানো ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না৷ আর এরকম ঘটনা ঘটছে হামেশাই৷
বিজ্ঞাপন
আনে-মারিও একজন ভুক্তভোগী৷ ১৯ বছর আগে দেখা দেয় এই যন্ত্রণা৷ আনা মারির ভাষায়, ‘‘তা ছিল ১৯টি কষ্টকর বছর৷ অনিদ্রা যাঁদের হয়নি, তাঁরা তা বুঝবেন না৷'' মায়ের মৃতদেহ ছোঁয়ার পর থেকেই শুরু হয়৷ স্মরণ করে বলেন আনে মারি৷ ‘‘আমি জানতাম না মানুষের শরীর এত ঠাণ্ডা হয়৷ এটা ছিল একটা শক৷'' সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন আনা মারি৷ তারপর আরো অনেক রাত এইভাবে কাটে৷ ছোটেন ডাক্তারের কাছে৷ সেখানে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি তিনি৷
এখন আনে মারির বয়স ৬৮৷ বাস করেন জার্মানির বন শহরের কাছে লোমার শহরে৷ সেখান থেকে এক ঘন্টার মধ্যেই প্রায় সব ডাক্তারের কাছে পৌঁছাতে পারেন তিনি৷ এইসব চিকিত্সকের কেউ তাঁকে সাহায্য করতে পারেননি৷
অবশেষে এক উপায় বের করেন তিনি৷ প্রতি রাতে চার ভাগের এক ভাগ ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করেন৷ ‘‘বছর দশেক আগে আমার মনে হয়েছিল, হয় এই ওষুধ তুমি খাও, নয় মৃত্যুবরণ করো৷ ঘুম পানাহারের মতই জরুরি'', বলেন আনে-মারি৷
অনিদ্রার কবলে অনেক মানুষ
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, জার্মানির ২৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে অনিদ্রার লক্ষণ দেখা যায়৷ অ্যামেরিকার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ক্রনিক অনিদ্রায় ভোগেন৷ এই তথ্য জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর স্লিপ ডিসওর্ডার রিসার্চ'৷
একটি ক্লিনিকের স্লিপিং সেন্টারের প্রধান হান্স গ্যুনটার ভিস জানান, ‘‘রোগীরা শোবার ঘরে এসেও সব চিন্তাভাবনা দূর করতে পারেন না৷ দৈনন্দিন নানা ঘটনা তাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে৷'' এছাড়া শারীরিক কারণেও অনিদ্রা দেখা দিতে পারে৷ যেমন থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের সমস্যাতেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে৷
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া ঘুমের ওষুধ আছে কী?
গবেষকরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া ঘুমের ওষুধ আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন৷ কয়েক দশক আগে বারবিচুরেট ঘুমের ওষুধ হিসাবে নাম করেছিল৷ কিন্তু এর উপাদান মানুষকে নির্ভরশীল করে৷ একটি দুঃখজনক ঘটনা থেকে ওষুধটির নাম ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী৷ হলিউডের চিত্রতারকা মেরিলিন মনরো বেশি ডোজে এই ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন৷
জার্মানিতে শতকরা ৬ জনকেই ঘুমের ওষুধ খেতে হয়
প্রায়ই শোনা যায়, ‘কিছুতেই ঘুম আসছিল না, পরে ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয়েছে’৷ তবে ঘুম না হওয়ার কারণ নিয়ে কিন্তু কেউ তেমন কিছু বলেনা৷ চলুন, এবার সেদিকে তাকানো যাক৷
ছবি: BMVBS
ঘুমের কি প্রয়োজন আছে?
আচ্ছা আমরা ঘুমাই কেন? ঘুমের কি তেমন কোনো প্রয়োজন আছে? এ নিয়ে গবেষণা হলেও এখনো তার ফলাফল সেভাবে পাওয়া যায়নি, আসল কারণ অনেকটা অন্ধকারেই রয়ে গেছে৷ একথা বলেন ডাক্তার হান্স গ্যুন্টার ভেস, যিনি এক স্লিপিং ল্যাবোরেটরির প্রধান৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘তবে যা আমরা সবাই জানি সেটা হলো, রাতে কারো ঘুম না হলে তার মধ্যে পরদিন সকালে ক্লান্ত ভাব, কাজে অমনোযোগী ও অল্পতে রেগে যাওয়া, এসব লক্ষণ দেখা দেয়৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ঠিক যেন ব্যাটারি
ড. ভেস বলেন, ‘‘সকালে ক্লান্ত লাগলে বোঝা যায় মানুষের রাতের ঘুম কতটা প্রয়োজন৷ কারণ মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ মস্তিষ্কের কোষগুলো কাজ করে৷ মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ব্যাটারির সাথে তুলনা করা যেতে পারে৷ ব্যাটারি চার্জ দিয়ে ব্যবহার করার পর যেমন আবার নতুন করে চার্জ দিতে হয়, ঠিক তেমনি ঘুমের মধ্য দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের সেলগুলো চার্জ হয়৷ তখন সকালে নতুন ব্যাটারির মতো মানুষও নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারে৷
ছবি: Vedomyr Aremikh
এই রোগ অনেকের
কিন্তু যদি কারো ঘুম না আসে তখন? হ্যাঁ এই সমস্যার সাথে অনেকেই পরিচিত৷ ঘুম হয় না বা ঘুম আসেনা, এই অভিযোগ নিয়ে যে কত মানুষ ডাক্তারের কাছে আসেন তার শেষ নেই৷ একথা বলেন রেগেন্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিকের ঘুম গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. অধ্যাপক মিশায়েল আরৎস্ট৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
শতকরা ৬ জনকেই ঘুমের ওষুধ খেতে হয়
একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, জার্মানিতে শতকরা ৫০ জন মহিলারই ঘুমের সমস্যা রয়েছে৷ তবে পুরুষদের বেলায় এই হিসেব তার অর্ধেক অর্থাৎ শতকরা ২৫ জন৷ ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারণে জার্মানিতে শতকরা ৬ জনেরই চিকিৎসা নিতে হয় বা ওষুধ খেতে হয়৷ বিভিন্ন অসুখের কারণও কিন্তু ভালো ঘুম না হওয়া বা একেবারেই ঘুমোতে না পারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মূল কারণ তিনটি
ঘুম কেড়ে নেওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, অস্থিরতা অর্থাৎ অকারণে এলোমেলো চিন্তা করা, স্ট্রেস – শারীরিক বা মানসিক চাপ এবং বাস্তব কিছু সমস্যা৷ এ সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে সম্ভব? চলুন জানা যাক৷
ছবি: BilderBox
এলোমেলো চিন্তা
যাদের অযথা এলোমেলো চিন্তা বা যেসব চিন্তার কোনো যৌক্তিকতা নেই, সেরকম চিন্তা করার অভ্যাস আছে এবং তারা যদি এই অভ্যাস ছাড়তে না চান – তাদেরকে ঘুম পাড়ানো খুবই কঠিন৷ একথা বলেন মিউনিখের মাক্স প্লাংক ইন্সটিটিউটের মনোরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আক্সেল স্টাইগার৷ যারা এলোমেলো চিন্তা করেন, তারা সবকিছুর নেতিবাচক দিকটাই দেখেন৷ সেই অনুভূতিই তাদের ভেতরে সারাক্ষণ কাজ করে৷ এই অকারণ উদ্বেগই ঘুমের মহাশত্রু৷
ছবি: Gina Sanders - Fotolia.com
মনকে শান্ত আর হাসিখুশি রাখুন
শরীর এবং মন পুরোপুরি শান্ত থাকলেই কেবল ভালোভাবে, নিশ্চিন্তে ঘুমানো সম্ভব৷ ড. ভেস তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, রোগীদের তিনি ফ্যান্টাসি ভ্রমণে পাঠিয়ে দেন অর্থাৎ বিছানায় শুয়ে সুন্দর কিছু ভাবতে থাকেন৷ তখন মস্তিষ্ক ব্যস্ত হয়ে যায় সুন্দর কল্পনা নিয়ে এবং এক ফাঁকে ঘুম এসে যায়৷ তবে ভালো, শান্ত, সুন্দর কল্পনা থেকেই ঘুম আসতে পারে, কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা থেকে নয়৷
ছবি: Gina Sanders - Fotolia.com
বই পড়া, গানশোনা বা হাঁটা
সারাদিন প্রচণ্ড কাজের চাপে যারা থাকেন তাদের শরীর-মন শান্ত হতে খানিকটা সময় লাগে বৈকি! তারা ঘুমানোর আগে খানিকটা ভালো বই পড়া, পছন্দের কোনো গান শুনতে পারেন৷ কিংবা পারেন সঙ্গীর সাথে শোবার অল্পক্ষণ আগে বাইরে হাঁটতে যেতে, পরামর্শ ড. ভেস এর৷ দেরি করে না খাওয়া এবং মদ্যপান না করার পরামর্শ তাঁর৷
ছবি: Fotolia/W. Heiber Fotostudio
বেডরুমের পরিবেশ
বেডরুমের পরিবেশকেও খানিকটা সুন্দর করতে হবে৷ যথেষ্ট আলো-বাতাস যেন ঢুকতে পারে সেদিকেও নজর দিতে হবে৷ প্রতিদিন একই সময় বিছানায় যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে৷ শোবার ঘরে টেলিভিশন না থাকাই ভালো ,বলেন ড.ভেস৷ তিনি যোগ দেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুম কিছুটা কমে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক৷ তাছাড়া শরীরে কোনো ব্যথা থাকলেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে৷
ছবি: BMVBS
9 ছবি1 | 9
এরপর বাজারে আসে বেনজোডায়াজোপিন৷ এটাও মস্তিষ্কে এমন সংকেত পাঠায় যাতে ঘুম আসে৷ তবে এর উপাদান মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশকেও প্রভাবিত করে, যেসব মানুষের অনুভূতি, নড়াচড়ার সমন্বয় ও মনমেজাজের জন্য জরুরি৷ এই ওষুধ এখনও পাওয়া যাচ্ছে৷ তবে এর চেয়েও ভালো একটি বিকল্প এসেছে বাজারে৷ এটির নাম জেড-ড্রাগ বলা হয়৷ এতে কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলির নাম জেড দিয়ে শুরু৷ এই ওষুধও ঘুম পাড়ায়, তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম৷ এখন অনিদ্রার চিকিত্সায় সাধারণত এই ওষুধও দেওয়া হয়ে থাকে৷
ভেষজ ওষুধও কাজে লাগতে পারে
এছাড়া বালড্রিয়ান বা ভ্যালেরিয়ানার মতো ভেষজ ওষুধও ঘুমের ব্যাঘাত হলে সাহায্য করতে পারে৷ তবে সমস্যাটা হালকা হলেই কেবল এই ওষুধ কাজে লাগে৷ অনিদ্রা জেঁকে বসলে উদ্ভিজ ওষুধ তেমন কাজে লাগে না৷
আধুনিক ঘুমের ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম থাকলেও পুরোপুরি মুক্ত নয়৷ অনেক সময় রোগীরা পরদিন সকালে ক্লান্তি বোধ করেন৷ গাড়ি চালাতে পারেন না৷ এই ধরনের ওষুধ দুই সপ্তাহের বেশি নিলে পরে ওষুধ ছাড়া আর ঘুমই আসে না৷ অনেকদিন পর হয়ত কাজই করে না ঘুমের ওষুধ৷
আনে মারি জানান, তিনি ঘুমানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি৷ এজন্য ‘সেল্ফ হেল্প গ্রুপ'-ও গড়ে তুলেছিলেন৷ কিন্তু কিছুদিন পর অংশগ্রহণকারীরা আর আসতে পারেননি৷ ‘‘দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে সন্ধ্যার সময় খুব ক্লান্ত থাকতেন তারা৷ তাই এই আসরে আসা সম্ভব হয়নি,'' জানান আনে-মারি৷
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, ঘুমের ট্যাবলেট সাময়িকভাবে নেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু স্থায়ী সমাধান হতে পারেনা৷ ওষুধ দিয়ে লক্ষণটা কমানো যায় কিন্তু অনিদ্রার আসল কারণ দূর করা যায় না৷