শেলা নদীতে আবারও জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে৷ ফলে ঐ পথ দিয়ে সবধরণের নৌ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এর পরিবর্তে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ রুট ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার বিকালে ১,২০০ মেট্রিক টনের বেশি কয়লা বহন করা একটি জাহাজ শেলা নদীতে ডুবে যায়৷ জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর যশোর যাওয়ার পথে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ডুবে যায়৷ যে এলাকায় জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে সেটি ডলফিনের অভয়ারণ্য বলে পরিচিত৷ এছাড়া কয়লায় যদি সালফারের পরিমাণ বেশি থাকে এবং কয়লা যদি পানি মিশে যায় তাহলে সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন বন সংরক্ষক জহির উদ্দীন আহমেদ৷
বিশ্বের বিরলতম প্রাণী বাংলাদেশের শুশুক
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খুবই বিরল
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বিপন্ন প্রাণী
২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের নদীগুলোতে অনেক শুশুক বা ডলফিন দেখা যেত৷ কিন্তু এখন আর সেটা যাচ্ছে না৷ তাই ১৯৯৬ সাল থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম উঠে গেছে শুশুকের৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
মাছ ধরতে শুশুকের তেল
শুশুকের তেল মাছ ধরার জন্য বেশ কার্যকর৷ তাই জেলেরা গণহারে শুশুক ধরছে৷ এছাড়া জাটকা ধরার জন্য যে কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন জেলেরা, তাতেও মারা পড়ছে শুশুকের দল৷ ছবিতে এমনই একটি মৃত শুশুক দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে
নদীতে বাঁধ দেয়া, সেতু তৈরি ইত্যাদি কারণে নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শুশুকের আবাস ও প্রজননস্থল৷ এছাড়া যেখানে সেখানে ফেলে রাখা পলিথিন নদীর পানিতে মিশে গিয়েও নষ্ট করছে শুশুকের আবাস৷ শিল্প-কারখানা দূষিত বর্জ্যও শুশুকের শত্রু৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
অভয়ারণ্য ঘোষণা
শুশুক রক্ষায় সরকার দেড় বছর আগে সুন্দরবনের অন্তর্গত ৩১ কিলোমিটার জলজ এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে৷ তবে বাস্তবায়নের কাজ এখনো শুরু হয় নি৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিসিডিপি-র উদ্যোগ
বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ সেটাসিয়ান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট’ বা বিসিডিপি সরকারের বন বিভাগের সহায়তায় অভয়ারণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
ছবি: shushuk.org
শুশুক মেলা
বিসিডিপি-র উদ্যোগে সুন্দরবন এলাকায় গত চার বছর ধরে শুশুক মেলা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে শুশুক রক্ষায় জনসাধারণকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে৷ গত ফেব্রুয়ারিতে মংলায় হয়ে গেলো মাসব্যাপী চতুর্থ শুশুক মেলা৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
শুশুকপ্রেমী রুবাইয়াত মনসুর
তিনি বিসিডিপি’র প্রধান গবেষক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, জুলাই মাস থেকে অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকার আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে৷ বিশেষ করে জেলেদের বলা হবে তারা যেন মাছ ধরতে এমন জাল ব্যবহার করেন যেটা শুশুকের জন্য ক্ষতিকর হবে না৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব
রুবাইয়াত মনসুর বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডলফিনের খেলা দেখিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে৷ বাংলাদেশও চাইলে শুশুক দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
ঐ ঘটনার পর সোমবার থেকে শেলা নদী দিয়ে সবধরণের নৌযান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান নৌপরিবহণ সচিব অশোক মাধব রায়৷
এর আগে ২০১৪ সালে শেলা নদীতে তেলবাহী একটি জাহাজ ডুবে গেলে অনেকটা অংশ জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল৷ ঐ ঘটনার পরও শেলা নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু পরে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আবার সেই রুট খুলে দেয়া হয়৷ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য খাবার ও শিল্পজাত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে শেলা নদী দিয়েই নৌযান চলাচল করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছিল ব্যবসায়ীরা৷
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কি ধ্বংস হয়ে যাবে?
‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের অয়েল ট্যাংকারটির তলদেশ ফেটে যাওয়ায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল শেলা নদী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ এদিকে স্থানীয় পদ্ধতিতে এ যাবৎ সামান্য পরিমাণ তেল অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
শ্বাসমূলীয় বন ও পশুপাখির জীবন বিপন্ন
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে৷ এর ফলে সুন্দরবনের গাছপালা, মাছ ও পশুপাখির প্রাণ বিপন্ন হতে পারে৷ এছাড়া তেল সরানোর কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া গেলে দীর্ঘ মেয়াদে শ্বাসমূলীয় বন ও বনের পশুপাখির জীবনে বিপর্যয় বয়ে আসতে পারে৷ অথচ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান দাবি করেছেন যে, তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
যে দুটি কাজ করা উচিত ছিল
সুন্দরবনে জাহাজ ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়ার পর অন্তত দুটি কাজ দ্রুত করা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ প্রথমত, নদীতে ফ্লোটিং বুমের সাহায্যে ভাসমান তেল যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা করা৷ দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণে আনা ভাসমান তেল তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
মন্ত্রণালয়ের নীতি লঙ্ঘন
সাম্প্রতিক কালে ফার্নেস তেল আমদানি অন্তত ২০ গুণ বেড়েছে বাংলাদেশে৷ এ সব বিপজ্জনক পদার্থকে বলা হয় ‘হ্যাজম্যাট’ (হ্যাজারডাস ম্যাটেরিয়াল বা ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ) এবং এর পরিবহনে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেওয়া সাধারণ রীতি৷ মন্ত্রণালয় এই রীতি লঙ্ঘন করেছে৷ কোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি তাদের ছিল না৷
ছবি: DW/M, Mamun
জাহাজ চলাচলের অনুমোদন কেন
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক যান চলা দেশের ও আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন৷ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন কেন দেওয়া হলো, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷
ছবি: DW/M, Mamun
ডলফিনের মৃত্যু
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন এলাকা ঘুরে এসেছেন৷ তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কাঁকড়া, কচ্ছপ, ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মরতে শুরু করেছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
জেলেদের কর্ম বিপর্যয়
সুন্দরবনে শেলা নদীতে তেল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের পর সেখানকার কয়েক হাজারেরও বেশি জেলে পরিবারের দিন কাটছে অলস৷ নদী ও খালে তেল ভেসে থাকায় এসব জেলেরা জাল পেতে মাছ শিকার করতে পারছেন না৷ এর ফলে তাঁদের সংসার চালাতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনা
৯ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ভোরের দিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের ফার্নেল ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর, ছড়িয়ে পড়েছে তেল৷ সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
এদিকে, শেলা নদীর বিকল্প রুট তৈরি করতে সরকার ২০১৪ সালের জুনে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খননের উদ্যোগ নেয়৷ একবছর কাজ শেষে গত বছরের জুনে চ্যানেলটি চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল৷ কিন্তু এখনও সেই কাজ শেষ হয়নি৷
তবে এপ্রিল মাসের মধ্যেই এই কাজ শেষ হবে বলে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাংবাদিকদের জানান নৌ-পরিবহণ সচিব মাধব রায়৷ মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-রুটের সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘‘২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতিমধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ কিউবিক মিটার মাটি খনন করা হয়েছে৷ খননকাজ শেষ হলে এই রুট দিয়ে ১২ ফুট ড্রাফটের বড় বড় নৌযান চলাচল করতে পারবে৷''