শৈশবে সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে অটিস্টিক মানুষের আবেগ বোঝা ও প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষমতার উন্নতি করা সম্ভব৷ সেইসঙ্গে চাই অশেষ ধৈর্য৷ এই ক্ষমতা আয়ত্ত করতে পারলে তাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে পড়ে৷
বিজ্ঞাপন
শৈশবই মস্তিষ্ক উদ্দীপিত করার আদর্শ সময়৷ সিমোনে কিয়র্স্ট এমন সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যার সাহায্যে অটিস্টিক শিশুদের ভাবের আদানপ্রদান সহজ করে তোলা যায়৷ অন্য যে কোনো মানুষের মতো অটিস্টিক মানুষেরও অনুভূতি রয়েছে৷ শুধু তারা ঠিকমতো তা প্রকাশ করতে পারে না৷
লুৎস নিজের সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য জানালো৷ তার তথাকথিত অ্যাসপারগার সিন্ড্রোম রয়েছে৷ অটিজমের মধ্যেই এ হলো এক বিশেষ ত্রুটি, যা বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়৷ সে এক স্বাভাবিক স্কুলেই যায়, অন্য অনেকের তুলনায় সে বেশি মেধাবী৷ কিন্তু অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করা তার জন্য সহজ নয়৷ লুৎস-এর মা কাটিয়া ভুসভস্কি বলেন, ‘‘ক্লাসে সে ভালোই থাকে, মজা পায়৷ সেখানে কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু বিরতির সময়ে সমস্যা হয়৷ ব্রেক মানেই মাথা খালি হয়ে যাওয়া৷ তখন সে বুঝতে পারে না, কী করা উচিত৷ ফলে সে ক্লাসের মধ্যে ছুটে বেড়ায়, নাড়াচাড়া করে, ঠেলাঠেলি করে৷ অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করে সে বলতে চায়, আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই, কিন্তু আমি সেটা পারি না৷''
অটিজম কি এবং কেনো?
অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়৷ এটি মস্তিস্কের একটি বিকাশগত সমস্যা, যা একটা শিশুর তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায়৷ অটিজম প্রসঙ্গে সরকারি, বেসরকারি নানা উদ্যোগের কথা জানা যাবে এই ছবিঘরে৷
মানসিক রোগ নয়
বাংলাদেশের অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রধান রওনক হাফিজ এর মতে, অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়৷ এটি মস্তিস্কের একটি বিকাশগত সমস্যা, যা একটা শিশুর তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায়৷
ছবি: Getty Images
ছেলে ৪ : মেয়ে ১
মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিস্টিক হবার সম্ভাবনা বেশি৷ অনুপাতটা ৪:১ বলে জানিয়েছেন রওনক হাফিজ৷
ছবি: picture alliance/AP Images
লক্ষণ
রওনক হাফিজ বলেন, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বয়সের তুলনায় পিছিয়ে থাকে৷ তারা একই ধরনের আচার-আচরণ বারবার করে৷ ঘুরে ফিরে একই কথা বার বার বলে৷ উপলব্ধি করার ক্ষমতা এদের মধ্যে ভীষণভাবে কম থাকে৷
ছবি: Rownak Hafiz
কারণ
অটিজমের অন্যতম বড় কারণ বংশগত সমস্যা৷ এর বাইরে পরিবেশ দূষণ, রাসায়নিক মেশানো খাদ্যগ্রহণ – এসবও অটিজমের জন্য দায়ী৷
ছবি: picture alliance/AP Images
ওষুধের ভূমিকা নেই
অটিজম চিকিৎসায় ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই৷ এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ৷ সঠিক পদ্ধতিতে এগোলে প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই উন্নতি করে৷ এমনকি অনেকে সাধারণ স্কুলে যাওয়ার মতোও হয়ে ওঠে৷
সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে মিরপুরে চালু হয়েছে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’৷ আর অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া সহ অন্যান্য প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন’৷ এছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতালে রয়েছে ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’৷
ছবি: picture alliance/landov
অটিজম স্কুল
অটিজম নিয়ে সরকার কাজ শুরু করেছে বেশি দিন হয়নি৷ তবে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক আগে থেকেই অটিজম বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে৷ ইতিমধ্যে ঢাকায় অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা দেয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷ ঢাকার বাইরেও রয়েছে কিছু৷
আজ প্রথমবার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ লুৎস কি অভিনেতাদের অভিব্যক্তি দেখে প্রথমবারই অনুভূতির নাম বলতে পারবে? প্রাপ্তবয়স্কদের কর্মসূচিতে মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি শনাক্ত করতে হয়৷ আশেপাশের মানুষের আবেগ দেখে বাচ্চাদের সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাতে শিখতে হয়৷ বজ্রপাতের কারণে মেয়েটির ভয় লাগছে, লুৎস সেটা শনাক্ত করতে পারলো৷ এমন অবস্থায় কী করা উচিত? লুৎস তাকে বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়ে রাতে থাকার প্রস্তাব দেবে বলে জানালো৷ সে কয়েক বছর ধরে এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে৷ তার অগ্রগতি সত্যি চোখে পড়ার মতো৷ তার মা বলেন, ‘‘লুৎস-কে নিয়ে পরিস্থিতি সহজ ছিল না৷ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়লে সে হেসে ফেলতো, তার খুব আনন্দ ও রোমাঞ্চ হতো৷ আজ আমার চোখে পানি দেখলে সে রুমাল নিয়ে এগিয়ে আসে৷ তার কিছুটা আনন্দ হয় বটে, কিন্তু সে জানে, যে দুঃখের কোনো কারণ ঘটেছে৷ সেই অনুযায়ী সে প্রতিক্রিয়া দেখায়৷''
লুৎস ও রাইনার-এর মতো অটিস্টিক মানুষকে লাগাতার অনুশীলনের মাধ্যমে আবেগ দেখাতে নিজেদের মুখকে প্রস্তুত করতে হয়৷
স্বাভাবিক মানুষও আবেগ অনুশীলন করতে সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারে৷ অন্য মানুষের আবেগ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা সফল জীবনের চাবিকাঠি৷
যাঁরা অনেক বেশি প্রশংসার যোগ্য
আলব্যার্ট আইনস্টাইনকে পদার্থবিদ এবং অঙ্ক বিশারদ হিসেবে তো চেনেন, কিন্তু অটিজম-এর মতো অক্ষমতাকে জয় করার কারণেও যে তিনি অনন্যসাধারণ, তা কি জানেন? ছবিঘরে থাকছে তাঁর এবং এমন আরো কয়েকজন অসাধারণ মানুষের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Warner Bros/Entertainment Inc.
আইনস্টাইনের ‘অক্ষমতা’
অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম নামের এক ধরণের অটিজম, অর্থাৎ মানসিক সমস্যায় ভুগতেন আলব্যার্ট আইনস্টাইন৷ এই সমস্যা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ খুব জটিল বিষয় নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে এবং সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনেও সমস্যা হয় তাদের৷ আইনস্টাইনেরও এ সব সমস্যা ছিল৷ বিবিসি-র এক অনুসন্ধান বলছে, অ্যাসপারজার্স সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের মতো তাঁরও একই কথা বারবার বলার অভ্যেস ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মোৎসার্ট খুব বেশি হাত-পা নাড়তেন!
সংগীতজ্ঞ মোৎসার্টের মধ্যেও নাকি চোখে পড়ার মতো কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল৷ খুব কম বয়সেই তাঁর মধ্যে নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়৷ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে খুব দ্রুত সুর রচনাও শুরু করেন৷ কিন্তু লিখতে সমস্যা হতো৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যাটার কারণ অটিজম৷ মোৎসার্টের শ্রুতিতেও সংবেদনশীলতা ছিল৷ আরেকটা অস্বাভাবিকতা ছিল অস্ট্রীয় এই সংগীতজ্ঞের – সবসময় খুব বেশি হাত-পা নাড়াতেন!
ছবি: picture-alliance/akg-images/Erich Lessing
ভয় থেকে সুপারস্টার!
‘ঘোস্টবাস্টার্স’ মুভির জন্য সুপরিচিত ড্যান অ্যাক্রয়েডের নাকি ‘দ্য ব্লু ব্রাদার্স’-এ কাজ করার সময় অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম ধরা পড়েছিল৷ ঘোস্টবাস্টার্স-এ চমৎকার অভিনয়ের কৃতিত্ব অ্যাসপারজার্স সিনড্রোমকেই দিয়েছেন তিনি৷ ক্যানাডিয়ান এই অভিনেতা ডেইলি মেল-কে বলেছেন, অ্যাসপারজার্স সিনড্রোমের যেসব বৈশষ্ট্য ছিল তার মধ্যে একটি হলো, ভূত এবং পুলিশে ভয়৷ ছবিতে অভিনয়ের সময় তা নাকি খুব কাজে লেগেছে৷
ছবি: Getty Images for AFI/F. Harrison
১২ হাজার বই মুখস্থ ছিল যাঁর
কিম পিক নামের কাউকে হয়ত আপনি চেনেন না৷ তাঁকে নিয়ে একটি ছবি হয়েছে, ছবির নাম ‘রেন ম্যান’৷ আশির দশকের এই ক্লাসিক মুভির কাহিনি চার্লি ব্যাবিট এবং তাঁর অটিস্টিক ভাই রেমন্ডকে ঘিরে৷ সেখানে রেমন্ড, অর্থাৎ বাস্তব জীবনের কিম পিকের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন ডাস্টিন হফম্যান৷ ২০০৯ সালে মারা যান পিক৷ ১২ হাজার বই একদম মুখস্থ ছিল বলে কিম পিক-কে এক বাক্যে পণ্ডিত মানতেন সবাই৷
ছবি: cc-by-Dmadeo
যিনি এক জায়গায় বসতে ভালোবাসতেন
চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশিষ্ট নাম ড. শেল্ডন কুপার৷ ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ – ছবি দেখে থাকলে নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন৷ ছবিতে কুপার হয়েছিলেন জিম পারসন্স৷ পারসন্সের ধারণা, কুপারেরও অ্যাসপারজার্স সিনড্রেম ছিল৷ বলা হয়ে থাকে, কুপার শ্লেষাত্মক কথা একেবারেই বুঝতেন না, সপ্তাহে এক দিন খুব ঘটা করে খেতে বসতেন এবং সব সময় এক জায়গাতেই বসতেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Warner Bros/Entertainment Inc.