দুই মাস ধরে কারাগারে আছেন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। মুক্তি না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা হতাশ। বারবার আবেদন করেও জামিন মিলছে না। কারাগারে তার শারীরিক অবস্থারও অবনতি হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত ২ মে রাতে যশোরের বেনাপোলে পাওয়া যায় ফটো সাংবাদিক কাজলকে। বেনাপোলের ভারতীয় সীমান্ত সাদিপুর হয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই দিন যাশোরের আদালত অনুপ্রবেশের মামলায় জামিন দিলেও ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে তার বিরুদ্ধে আগেই ডিজিটাল আইনে মামলা ছিল। ওই দিন আদালতে ডিজিটাল মামলার কাগজপত্র উপস্থাপন করা হয়নি।
কাজলকে প্রথমে যশোর কারাগারে রাখা হলেও ২২ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
এরই মধ্যে কাজলকে ডিজিটাল আইনের দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একটি মামলায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। তার জামিনের আবেদন নাকচ হয়েছে। করোনার কারণে এই আইনি প্রক্রিয়াগুলো ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে হচ্ছে। কাজলকে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হচেছ না।
রিপন কুমার বড়ুয়া
২৩ জুন তাকে শেরেবাংলা নগর থানায় সংসদ সদস্য (মাগুরা-১) সাইফুজ্জামান শিখরের দায়ের করা ডিজিটাল আইনের মামলায় ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তার দেখায়। ওই দিন তার জামিনের আবেদনও করা হয়। কিন্তু তিনি জামিন পাননি। ২৮ জুন হাজারীবাগ থানায় দায়ের করা আরো একটি ডিজিটাল মামলায় ট্রাইব্যুনাল তাকে গ্রেপ্তার দেখায় । তার ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হলে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয় আর জামিন আবেদন নাকচ করা হয়। এই মামলার বাদী ওসমিন আরা বেলি। তার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর অভিযোগ একই রকম। যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত একটি খবর ফেসবুকে শেয়ার করার অভিযোগ।
কাজলের আইনজীবী রিপন কুমার বড়ুয়া জানান, ‘‘মামলাগুলো জামিন অযোগ্য। কিন্তু কাজলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। তাই তার জামিন প্রাপ্য। কারণ, তিনি ফেসবুকে দৈনিক মানবজমিনের যে প্রতিবেদন শেয়ার করেছেন তাতে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের নাম নেই। মাগুরায় দুইটি সংসদীয় আসন আছে। কোন আসনের এমপি তাও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। আর পাপিয়া যে অপরাধী তা তো প্রমাণিত। তাই যদি না হবে তাহলে তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হবে কেন?”
শেরেবাংলা নগর থানায় সংসদ সদস্যের মামলায় কাজল এবং মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ মোট ৩২জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে কাজল গ্রেপ্তার হলেও মতিউর রহমান চৌধুরী উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
কাজলের পরিবার দাবি করছে, কাজলের সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। কারাগারে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তার সুচিকিৎসা প্রয়োজন। তার স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসী বলেন, ‘‘আমরা বারবার তার জামিনের আবেদন করছি। কিন্তু তাকে জামিন দেয়া হচেছ না। তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। কবে জামিন হবে তা নিশ্চিত নয়। আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও কাজলের বিষয় নিয়ে দেখা করেছিলাম।”
ডিজিটাল আইনে ছয় মাসে ২৩ সাংবাদিক গ্রেপ্তার
বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য মতে বাংলাদেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১১টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৩১ টি মামলায় ৫৩ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৩ জন সাংবাদিককে। কয়েকজন সাংবাদিক জামিন পেয়েছেন। কিন্তু ঠিক কত জন সাংবাদিক জামিন পেয়েছেন তার হিসাব নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে।
এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনাকারীদের গ্রেপ্তার বেড়ে গেছে। ডিজিটাল আইনের অপব্যাবহার করে তাদের আটকে রাখা হচ্ছে বলেও মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
ডিজিটাল আইন বাতিল চায় সম্পাদক পরিষদ
বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চেয়ে মঙ্গলবার একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত কয়েক মাসে প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব গ্রেপ্তারের ঘটনা এমন এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে স্বাভাবিক সাংবাদিকতার কাজও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তাই অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ বিনষ্ট ও গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপর পুলিশের ক্রমবর্ধমান পদক্ষেপ নিয়ে সংগঠনটি উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷