আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন আইএসএস একাধিক দেশের মহাকাশ সংস্থার সহযোগিতার ফসল৷ তিলে তিলে সেটির অংশবিশেষ গড়ে তোলা হয়েছে৷ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি সেখান থেকে পৃথিবীর অপূর্ব দৃশ্যও বাড়তি আকর্ষণ৷
ছবি: NASA/ZumaWire/Zumapress/picture alliance
বিজ্ঞাপন
আলেক্সান্ড্রার গেয়ার্স্ট দুই বার মহাকাশে গেছেন৷ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন আইএসএস-এ থেকেছেন তিনি৷ সেখান থেকে তিনি পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশ্যে একবার বলেন, ‘‘মানবজাতির তৈরি সবচেয়ে জটিল যন্ত্রের ভেতর থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি৷ তবে শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে এটি মানবজাতির সবচেয়ে মূল্যবান ও অপ্রত্যাশিত সাফল্য৷''
৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় প্রতি ৯০ মিনিটে আইএসএস পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলেছে৷ বিভিন্ন দেশের মহাকাশচারী সেখানে গবেষণা চালান৷ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির গণ্ডির বাইরে তারা এমন পরীক্ষা করেন, যা পৃথিবীর বুকে অসম্ভব হতো৷ বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সহযোগিতার ফল হিসেবে এই মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে৷ কিন্তু ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ সেই সহযোগিতাকে হুমকির মুখে ফেলছে৷
১৯৯৮ সালে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে এই উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল৷ শীতল যুদ্ধের সময় দুই দেশ পরস্পরের শত্রু ছিল৷ তারপর অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিলে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছিল এই দুই শক্তি৷ একক সাধারণ এক স্পেস স্টেশন, যেখানে গোটা বিশ্বের মহাকাশচারীরা একসঙ্গে গবেষণা চালাতে পারেন৷ সেই বছরেই রাশিয়ার এক রকেট প্রথম মডিউল কক্ষপথে নিয়ে আসে৷ এর ঠিক পর অ্যামেরিকাও একটি মডিউল পাঠায়৷
আইএসএস : ৪০০ কিলোমিটার উঁচুতে এক গবেষণাকেন্দ্র
04:34
This browser does not support the video element.
সের্গেই ক্রিকালইয়ভ ও ইয়ুরি গিডসেনকো নামের দুই রুশ মহাকাশচারী বিল শেপার্ড নামের মার্কিন মহাকাশচারীর সঙ্গে ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে মহাকাশে পাড়ি দেন৷ তারাই ছিলেন আইএসএস-এর প্রথম আরোহী৷ তাদের নতুন এই স্টেশনে অনেক কিছু ইনস্টল করতে হয়েছিল৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ক্রিকালইয়ভ বলেন, ‘‘আমাদের স্টেশন খুলে বাতি জ্বালিয়ে টেলিভিশন বসিয়ে প্যানেলের পেছনে সব তার খুঁজে সেগুলি প্রয়োজনমতো যুক্ত করতে হয়৷ স্টেশনটি ছোট ছিল বটে, কিন্তু সেখানে সব রকম প্রয়োজনীয় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ছিল৷ তবে সেগুলি নিষ্ক্রিয় থাকায় আমাদের কয়েকটি যুক্ত করে স্টেশনটি সক্রিয় করে তুলতে হয়েছিল৷''
নভচারীদের বেতন, টয়লেট সম্পর্কে তথ্য
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএসে নভচারীদের জীবন কেমন? কীভাবে তারা টয়লেট করেন? তাদের কি ‘যৌনজীবন’ থাকে? কেমন বেতন পান তারা? এসব প্রশ্নের উত্তর থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: NASA
অ্যালকোহল নিষিদ্ধ
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস-এ নভচারীদের জন্য অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ৷ কারণ অ্যালকোহলের মূল উপাদান ইথানলের কারণে কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ এমনকি অ্যালকোহল আছে এমন মাউথওয়াশ কিংবা আফটারশেভ লোশনও তারা ব্যবহার করতে পারেন না৷ ছবিতে দুজন নভচারীকে ‘ভদকা টিউব’ হাতে দেখা গেলেও তার ভেতরে আসলে আছে বিট স্যুপ৷
ছবি: NASA
মহাকাশে মৃত্যু
১৯৬৭ সালে মার্কিন এক নভচারী ৫০ মাইল উপরে স্পেসপ্লেন চালানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটে মারা যান৷ ১৯৬৭ ও ১৯৭১ সালে মারা যান চার সোভিয়েত নভচারী৷ এরপর ১৯৮৩ সালে চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল উড্ডয়নের ৭৩ সেকেণ্ডের মাথায় বিস্ফোরিত হলে সাতজন মারা গিয়েছিল৷ ২০০৩ সালে কলোম্বিয়া স্পেস শাটল পৃথিবীর অ্যাটমোস্ফিয়ারে ঢোকার পর বিস্ফোরিত হলে তখনও সাতজন মারা গিয়েছিলেন৷
ছবি: Thom Baur/AP/picture alliance
নভচারীরা টয়লেট করেন কীভাবে?
২০০০ সালে একটি স্পেস টয়লেটের নকশা করা হয়েছিল৷ সেখানে টয়লেট সিটে বসার পর ফিতা দিয়ে উরু বাঁধার ব্যবস্থা ছিল৷ কিন্তু সেটা তেমন ভালো কাজ করেনি৷ এরপর ২০১৮ সালে নাসা ভ্যাকুয়াম স্টাইলের এক টয়লেট বের করে যেখানে বসার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য টেনে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়৷ বাথরুমের বেশিরভাগ বর্জ্যই পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ তবে প্রস্রাব রিসাইকেল করে খাওয়ার পানিতে পরিণত করা হয়৷ ভিডিও দেখতে উপরের + চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Long Wei/Costfoto/picture alliance
নভচারীদের বেতন কত?
১৯৬৯ সালে চাঁদে যাওয়া অ্যাপোলো ১১ মিশনের সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন নীল আর্মস্ট্রং৷ তার বেতন ছিল বছরে ২৭ হাজার ৪০১ ডলার - বর্তমানের হিসেবে সেটা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ নয় হাজার ১২২ ডলারে৷ বাংলাদেশি টাকায় সেটা বছরে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা৷ বর্তমানে যারা নাসায় নভচারী হিসেবে আছেন তাদের বেতন বছরে ৫৭ লাখ থেকে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকার মতো৷ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বেতন ঠিক করা হয়৷
ছবি: NASA
নভচারীরা কি আগে মরেন?
মাথায় তরল জমা, রক্ত কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে বলে আইএসএস থেকে ফেরার পরপর নভচারীদের চেহারা কিছুটা মলিন দেখায়৷ তবে মহাকাশ ভ্রমণের কারণে শরীরের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে কিনা সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ অবশ্য এটা জানা গেছে যে, আপেক্ষিকতার কারণে নভচারীরা পৃথিবীতে কয়েক মিলিসেকেণ্ড তরুণ হয়ে ফেরেন৷
ছবি: Bill Ingalls/NASA/epa/dpa/picture-alliance
মহাকাশে যৌনমিলন?
নাসা বলছে, মহাকাশে এখনও কোনো মানুষ যৌন মিলন করেনি৷ মার্কিন নভচারীরাও এই বিষয়ে কথা বলেননি৷ তবে ১৯৯২ সালে নাসার স্পেস শাটল ‘এন্ডেভার’-এ চড়ে মার্ক লি ও জ্যান ডেভিস দম্পতি আইএসএস-এ গিয়েছিলেন৷ সেটা তাদের হানিমুন ছিল৷ যদিও তাদের অভিজ্ঞতার তথ্য পাওয়া যায় না৷ মাইক্রোগ্র্যাভিটির কারণে নভচারীরা ওজনহীনতা অনুভব করায় তাদের এস্ট্রোজন হরমোন কমে যায়৷ আর এস্ট্রোজন কমের সঙ্গে যৌন মিলনের আকাঙ্খা কমার সম্পর্ক রয়েছে৷
ছবি: Bruce Weaver/AFP/Getty Images
নভচারীরা ঘুমান কীভাবে?
জার্মান নভচারী মাটিয়াস মাওরার দেখাচ্ছেন কীভাবে আইএসএস-এ নভচারীরা ঘুমান৷ দেয়ালের সঙ্গে লেগে থাকা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে ঘুমাতে হয় তাদের৷ ফলে ঘুমানোর সময় ভেসে বেড়ানো কিংবা কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা৷
ছবি: Zhang Yirong/Xinhua/picture alliance
7 ছবি1 | 7
তারপরেও আইএসএস আরো বড় হতে থাকে৷ ১৬টি দেশ একাধিক মডিউল তৈরি করে, যেগুলি একে একে যুক্ত করা হয়৷ ২০১১ সালে নাসা আনুষ্ঠানিকভাবে আইএসএস নির্মাণের কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে৷
আজ আইএসএস প্রায় এক ফুটবল স্টেডিয়ামের মতো বড় এবং প্রায় ৪২০ টন ভারি হয়ে উঠেছে৷ সাত জন মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে থাকতে এবং কাজ করতে পারে৷ এক ভিউয়িং প্ল্যাটফর্ম থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করা যায়৷ এমনকি জিমের সরঞ্জামও সেখানে রয়েছে৷ মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশে পেশির মাত্রারিক্ত ক্ষয় এড়াতে মহাকাশচারীদের দিনে দুই ঘণ্টা খেলাধুলা করতে হয়৷
ইতোমধ্যে ২৪০ জনেরও বেশি মহাকাশচারী আইএসএস-এ বাস করে মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশের স্বাদ পেয়েছেন৷ সামান্থা ক্রিস্টোফারেটি তাদেরই একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘মানুষ এই নতুন জগতে আসে৷ আমার মনে হয়েছিল, স্পেস স্টেশনে এসে নতুন এক জীবনযাত্রার স্বাদ পাবো৷ মহাকাশে অগ্রসর হবার নতুন এই কায়দা আমাকে রপ্ত করতে হবে, সবকিছু নতুন করে শিখতে হবে৷''
মহাকাশচারীরা ৩,০০০-এরও বেশি পরীক্ষা চালিয়েছেন এবং মহাকাশে বাস করার বিষয়ে অনেক নতুন জ্ঞান অর্জন করেছেন৷