মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফরে পোপ ফ্রান্সিস ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান জানাবেন৷ ডয়চে ভেলের আসট্রিড প্রাঙে পোপের এই সফরকে খুবই ‘ডেলিকেট মিশন’ মনে করছেন৷
বিজ্ঞাপন
পোপের মিয়ানমার সফর শুধুই নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের আরেকটি অংশ নয়৷ বরং এটি ধর্মীয় মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মরিয়া এক সংগ্রামও৷ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ধর্মের অপব্যবহারের কারণে শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো বিশ্বেই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ছে৷
মিয়ানমারের মতো দেশ, যেটি ৫০ বছরেরও বেশি সময় সামরিক শাসনের অধীনে ছিল, সেখানেও ধর্মের এমন ব্যবহারের ঘটনা শ্লেষপূর্ণ৷
মাত্র বছর দশেক আগেও মিয়ানমারের বৌদ্ধ পুরোহিতরা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে৷ আর এখন তাঁদের অনেকে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করছেন৷ উ থুসাইত্তা নামের এক পুরোহিত সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘সামরিক বাহিনী যখন বলে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে আগুন জ্বালাচ্ছে তখন আমি সেটা বিশ্বাস করি৷’’
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
পোপের চাওয়া
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পোপ ফ্রান্সিস ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী নেতাদের বিবেককে জাগ্রত করতে চান৷ তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলতে চান৷ এই ধর্মান্ধতা প্রায়ই রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে যায়৷ বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারেও এখন সেটা হচ্ছে৷ মিয়ানমারে আরেকটি ধর্মীয় সংঘাত ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করতে চান পোপ ফ্রান্সিস৷
আঠার শতকে মিয়ানমারের বৌদ্ধ মৌলবাদীরা দাবি করেছিলেন, তাদের শিক্ষাপদ্ধতি বিদেশি প্রভাবমুক্ত৷ আর এখন তাঁরা তাঁদের দেশকে ‘ইসলামি অনুপ্রবেশ’ থেকে বাঁচাতে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন৷ এই কাজে তাঁরা থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সমর্থন পাচ্ছেন৷
এদিকে, ইসলামি মৌলবাদীরাও রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনকে কাজে লাগিয়ে তাদের দল ভারির চেষ্টা করছে৷ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক জরিপ বলছে, সৌদি আরব থেকে পাওয়া নির্দেশের পর মুসলিম জঙ্গিরা মিয়ামারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছেন৷ প্রতিবেদন বলছে, জঙ্গিরা মিয়ানমারের ইসলামিক স্টেটের মতাদর্শ ছড়ানোর চেষ্টা করছে৷
মিয়ানমারের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়
পোপ কীভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছেন যে, তাঁর সফরের প্রতি অনেকে নজর দেবেন? বৌদ্ধ অধ্যুষিত একটি দেশের মানুষ কেন ক্যাথলিক গির্জার প্রধানের কথায় আকৃষ্ট হবেন?
উত্তর হচ্ছে, মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের নিত্যদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্য দিয়েই পোপ তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন৷ বিশেষ করে সামরিক শাসনামলের প্রসঙ্গে তুলে ধরবেন পোপ৷ যখন তিনি ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের কথা বলবেন তখন খ্রিষ্টান সহ অনেক মানুষের কাছেই মনে হবে, পোপ যেন তাঁদের কথাই বলছেন৷
মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ ক্যাথলিক৷ সামরিক শাসনামলের সময় তাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন৷ ১৯৬৫ সালে মিয়ানমারের রেভুলিউশনারি কাউন্সিল গির্জা পরিচালিত স্কুল ও হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল৷ ২০১০ সালে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসার পর গির্জা পরিচালিত সংস্থাগুলোকে আবারও কাজের অনুমতি দেয়া হয়েছে৷
বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে এটা বোধগম্য যে, মিয়ানমারের কার্ডিনাল আর বিশপরা কেন পোপ ফ্রান্সিসকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন৷ পোপ যদি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেন তাহলে তাঁর চলে যাওয়ার পর তাঁদের উপর আবার নিপীড়নের আশংকা করছে মিয়ানমারের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়৷
ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব
পোপ ফ্রান্সিস এই পরামর্শ শুনবেন কিনা তা সময়ই বলে দেবে৷ রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী হিসেবে পোপ আরেকবার শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন৷ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং লায়িং ছাড়াও নোবেলজয়ী অং সান সু চির সঙ্গে কথা বলবেন পোপ৷
আন্তঃধর্মীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি বৌদ্ধ পুরোহিতদের সঙ্গেও কথা বলবেন৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে এই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক৷ কারণ অল্প সময়ের জন্য হলেও ধর্মীয় নেতারা দেখাতে সক্ষম হবেন যে, ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিহত করা তাঁদেরই কাজ৷
আসট্রিড প্রাঙে/জেডএইচ
রোহিঙ্গাদের বর্তমান দিনকাল
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কেয়ার-এর ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ঘুরে এলেন জেনিফার বোস৷ সেখানকার ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দিনযাপনের ছবি তুলে এনেছেন তিনি৷
ছবি: DW/ P. Vishwanathan
উদ্বাস্তু জীবন
এ বছরের আগস্ট থেকে মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে এসেছে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা৷ এর আগে বিভিন্ন সময়ে যারা এসেছিলেন তারাসহ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাস করছে৷
ছবি: CARE/T. Rahman
শিশুদের অসহায়ত্ব
নির্যাতন, সহিংসতার স্মৃতি গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে রোহিঙ্গা শিশুদের চোখে-মুখে৷ প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার জন শিশু রয়েছে এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে৷
ছবি: CARE/J. Bose
টিকে থাকার সংগ্রাম
স্বল্প পুঁজি নিয়ে ক্যাম্প এলাকার মধ্যেই ব্যবসা শুরু করেছেন এক রোহিঙ্গা ৷ এর মধ্যে অনেক রোহিঙ্গাই দিনমজুরের কাজ থেকে শুরু করে ছোটখাট ব্যবসা করে আয়ের পথ সচল রাখছেন৷
ছবি: CARE/J. Bose
ক্যাম্পজীবন
প্লাস্টিক ঢাকা বাঁশের আচ্ছাদনে দিন কাটছে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের৷ কক্সবাজারের নির্ধারিত ক্যাম্পে গাদাগাদি করে বাস করছে রোহিঙ্গারা৷
ছবি: CARE/J. Bose
বনভূমি উজাড়
কক্সবাজারে পাহাড় ও বনভূমি উজাড় করে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বসতি৷ ক্যাম্প এলাকার আশেপাশের অনেক গাছ এরই মধ্যে উজাড় হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন ও জ্বালানির প্রয়োজনে৷
ছবি: CARE/J. Bose
অনিশ্চয়তা
পরিবারের সাথে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা এই রোহিঙ্গাদের সংগ্রাম টিকে থাকার প্রয়োজনে৷ অন্যসব অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চিন্তাই বড় হয়ে দাঁড়ায়৷
ছবি: CARE/J. Bose
ক্যাম্পে শিশুকাল
মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা নারীদের মধ্যে অন্তত ৫৪ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী রয়েছেন৷ অনেকে ক্যাম্পের আসার পথে বা ক্যাম্পেই জন্ম দিয়েছেন শিশুর৷
ছবি: CARE/J. Bose
নিবন্ধিত রোহিঙ্গা
গত দু’ মাসে নিবন্ধিত হয়েছেন অন্তত ৩ লাখ রোহিঙ্গা৷ ক্যাম্প এলাকায় কয়েকটি কেন্দ্রে চলছে এই নিবন্ধন কার্যক্রম৷
ছবি: CARE/T. Haque
টিকাদান কর্মসূচি
শরণার্থী শিবিরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন বয়সের শিশুদের প্রয়োজনীয় টিকা দেয়া হচ্ছে৷ বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধে নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা৷
ছবি: CARE/J. Bose
ত্রাণ সহায়তা
সরকারের আশাবাদ সত্ত্বেও ৬ লাখেরও বেশি নতুন আসা রোহিঙ্গার জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা৷
ছবি: CARE/A. Captain
রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা এতিম শিশুকে পুর্নবাসিত করতে কাজ করছে মনোচিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক ও চিকিৎসক৷