অনেক সাংবাদিক নৈতিকতায় কম্প্রোমাইজ করছেন
৮ নভেম্বর ২০১৯প্রবীণ সাংবাদিক নেতা ও ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, সব ক্ষেত্রেই অবক্ষয় হয়েছে৷ অবক্ষয় হয়েছে সাংবাদিকতারও৷ প্রাপ্তির আশায় অনেকেই নৈতিকতায় কম্প্রোমাইজ করছেন৷ ফলে সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে৷
ডয়চে ভেলে : আপনারা যখন শুরু করেছেন তখন সাংবাদিকতা কেমন ছিল, আর এখন কেমন?
ইকবাল সোবহান চৌধুরী : আমরা যখন শুরু করেছি, তখন আমাদের যারা পূর্বসূরি ছিলেন তারা ছিলেন আমাদের আদর্শ৷ বর্তমানে সেই সুযোগটা কমে গেছে৷ এখন মিডিয়ার বিস্তৃতি ঘটেছে৷ সাংবাদিকদের পরিবার অনেক বড় হয়েছে৷ এখন প্রযুক্তির কারণে অত বেশি তথ্য রাখতে হয় না৷ আগে তথ্য নিতে যেতে হতো৷ আর এখন আপনি চাইলে গুগলে গিয়ে বা ইন্টারনেটে গিয়ে সব তথ্যই পাচ্ছেন৷ সেটা শুধু দেশি না, বিদেশী রেফারেন্সও আপনি পাচ্ছেন৷ ফলে সাংবাদিকতায় এখন পরিশ্রমের প্রবণতা কমে গেছে৷ নীতি নৈতিকতা বা বস্তুনিষ্ঠতাও এখন সংখ্যার কারণে কমে যাচ্ছে৷ আগে মালিকেরা একটা ভিশন নিয়ে সংবাদপত্র বের করতেন৷ এখন কর্পোরেট কালচারের কারণে এটা পেশার মতো না হয়ে চাকরির মতো হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে নীতি নৈতিকতায়ও একটা কম্প্রোমাইজের ভাব চলে এসেছে৷ এসব কারণে সাংবাদিকতাও এক ব্যবসায়িক জায়গায় চলে গেছে৷
সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সাংবাদিকেরা আগে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতেন, রাজনীতিবিদ ও সরকারের নীতি নির্ধারকদের কাছেও সাংবাদিকদের গুরুত্ব ছিল, এখন এটা নেই কেন?
এর দু'টি কারণ৷ আমাদের যারা পূর্বসূরি ছিলেন তাদের একটা নীতি আদর্শ ছিল৷ এ কারণে তাদের অনেক সাহস ছিল৷ আদর্শ বা ভিশন বাস্তবায়নে তারা সাংবাদিকতা করতেন৷ রাষ্ট্রের কাছে কোন স্বার্থের জন্য বা পাওনার জন্য তারা লালাইতো ছিলেন না৷ সব জায়গায়ই তো অবক্ষয়৷ তাই অন্যান্য পেশার মতো আমাদের মধ্যেও প্রাপ্তির আকাঙ্খা জেগে উঠেছে৷ প্রাপ্তির জন্য তাই অনেকেই কম্প্রোমাইজ করছে সরকার বলুন আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বলুন বা অন্য কোন স্বার্থের কাছে৷ এই কারণে সাংবাদিকদের প্রতি আগে যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল এখন সেটার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ আরেকটি বিষয়, সেটা হল আগে আমাদের যে ইউনিয়ন ছিল সেটা ছিল দল মত নির্বিশেষে সবাই মিলে৷ ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসকের পতনের পর সাংবাদিকরাও রাজনীতিকভাবে বিভক্ত হয়ে যান৷ ফলে সরকার বা কর্পোরেট হাউজগুলোও সাংবাদিকদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন৷ পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দাতাদের কাছেও মিডিয়া অনেক সময় দূর্বল হয়ে পড়ে৷ তাদের সঙ্গে কম্প্রোমাইজও করতে হচ্ছে৷
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? রাষ্ট্র ব্যবস্থা সাংবাদিকরা না সংবাদপত্রের মালিকরা?
সবকিছু মিলিয়েই৷ সাংবাদিকতা তো বিচ্ছিন্ন কোন অংশ না৷ সমাজেরই একটা প্রতিচ্ছবি৷ টোটাল ব্যবস্থার একটি পার্ট হলাম আমরা৷ আয়না যদি ভালো না হয় তাহলে প্রতিচ্ছবি ভালো হবে না৷ সমাজ, রাষ্ট্র যদি আয়না হয় তাহলে সাংবাদিকরা প্রতিচ্ছবি৷ কর্পোরেট কালচারে মালিকেরা অনেক সময় সাংবাদিকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন৷
সাংবাদিকতার ভবিষ্যত কেমন দেখেন আপনি?
আমি যে অবক্ষয়ের কথা বলেছি, সেটার শিকার কিছু সংখ্যক সাংবাদিক হতে পারেন৷ কিন্তু এই পেশার শাশ্বত একটা চরিত্র আছে৷ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে৷ প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ, কর্পোরেট চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে৷ তারপরও কিন্তু সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের উপর নির্ভর করতে চান৷ এটাই সাংবাদিকতার বড় শক্তি৷
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অবস্থা এখন কেমন?
এটা আসলে আপেক্ষিক৷ আপনার কাছে যেটা বস্তুনিষ্ঠ, সেটা আরেকজনের কাছে বস্তুনিষ্ঠ নাও হতে পারে৷ এটা হল দৃষ্টিকোণ৷ আপনি কিভাবে দেখেন৷ যেটা কর্পোরেট মিডিয়া তারা বস্তুনিষ্ঠতা একভাবে দেখবে, আবার যারা রাজনৈতিক মুখপাত্র তারা বস্তুনিষ্ঠতা আরেকভাবে দেখবে৷ আরেকটা হল প্রফেশনাল মিডিয়া৷ শাশ্বত যেটা সত্য তারা সেটাই লিখবে, তাদের কাছে এটা বস্তুনিষ্ঠতা৷ মিডিয়ার বিচারক কারা? দর্শক বা পাঠক৷ বস্তুনিষ্ঠতা না থাকলে আপনি কিছু চমক দিতে পারেন কিন্তু দিনশেষে টিকে থাকতে পারবেন না৷
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ কমে যাচ্ছে? এর কারণ কি সরকারের বিধি নিষেধ নাকি সেলফ সেন্সরশিপ?
সব মিলিয়েই কিন্তু৷ সরকারই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি না৷ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও কিন্তু এখানে বিষয়৷ তবে আগের তুলনায় রাজনীতিবিদদের কাছে সাংবাদিকদের নিয়ে চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে৷ পাশাপাশি মিডিয়াতে যে কর্পোরেট পুজির অনুপ্রবেশ হচ্ছে সেটা ভালো টাকাও হতে পারে, কালো টাকাও হতে পারে৷ পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দাতারাও মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে৷ এসবের ফলে কোন কোন সময় মিডিয়ার সাহসী ভূমিকায় টানাপোড়েন দেখা দেয়৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কী সাংবাদিকতার গতি কমিয়ে দিয়েছে? আমি মনে করি না৷ কারণ প্রযুক্তি যেমন আমাদের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে, আবার অন্যদিকে প্রযুক্তি অনেক সময় ঝুঁকিও তৈরী করে৷ অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় দেখা যায় অবক্ষয় দেখা দিয়েছে৷ অনেক সময় তাদের উদ্দেশ্যমূলক এজেন্ডা থাকে, দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভূমিকা দেখা যায়৷ এর ফলে অনেক সময় সমাজে রাষ্ট্রে বা ব্যক্তিজীবনেও সমস্যার সৃষ্টি হয়৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷