‘অনৈতিকতা দিয়ে ভালো চিকিৎসক হওয়া যায় না'
১৮ আগস্ট ২০২৩কিন্তু কিভাবে বন্ধ করা যাবে প্রশ্ন ফাঁস, কী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন-এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আবদুল আজিজ৷
ডয়চে ভেলে: প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, কিন্তু এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
অধ্যাপক ডা. আবদুল আজিজ: মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস কিন্তু এখন বন্ধ হয়েছে৷ কারণ, এর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ মূলত ২০০১ সালে শুরু হয়েছিল এই প্রশ্ন ফাঁস৷ পরে বর্তমান সরকার (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় আসার পরও কয়েকবার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে৷ এরপর সরকার শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার কারণে এটা বন্ধ হয়েছে৷
মোহাম্মদ নাসিম যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মতামত নিয়েছেন৷ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন৷ তিনি যে টেকনিক্যাল কমিটি করেছিলেন, সেখানে সাংবাদিকদেরও রাখা হয়েছে৷ বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও ছিলেন ওই কমিটিতে৷
এখন যে প্রেসে প্রশ্ন ছাপা হয় সেখানে একটা বিশেষ টিম থাকে৷ শরীরের থাকা পোশাক ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় না৷ তারা পুরো সময়টা তত্ত্বাবধানে থাকে৷ এই প্রশ্ন যখন কোনো সেন্টারে পাঠানো হয়, সেখানে একটা বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা থাকে৷ পরীক্ষার রুমে যখন প্যাকেট খোলা হয়, তখন একটা অ্যালার্ম সিস্টেম বেজে ওঠে৷ আগে খুললেও অ্যালার্ম বেজে ওঠে৷ ফলে এটা ধরা পড়বেই৷ গত সাত বা আট বছর ধরে আর শুনি না প্রশ্ন ফাঁসের কথা৷ এখন সিআইডি যেটা ধরেছে, সেটা কিন্তু কয়েক বছর আগের৷
সিআইডি বলেছে, ফাঁস করা প্রশ্নে যারা চিকিৎসক হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করা হবে৷ সেটা কী সম্ভব?
যারা এই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত তারা কিন্তু সবাই জানে, এই ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত৷ তারা জানে, এই ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে কারা ভর্তি হয়েছে এবং শেষমেষ ডাক্তার হয়েছে৷ গোয়েন্দা সংস্থা চাইলে এটা বের করতে পারবে৷ তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে, সেটা আদালতের ব্যাপার৷ ওই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না৷ তবে আমি মনে করি, বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতের জন্য ৩২টি আইন, অর্ডিন্যান্স করেছে৷ দুর্নীতিমুক্ত ডিজিটাল হেলথ সেক্টর করার জন্য এটা করা হয়েছে৷
বর্তমানে যে ব্যবস্থা আছে, তাতে প্রশ্ন ফাঁসের কোন সুযোগ নেই৷ আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাকা-পয়সা দিয়ে ভর্তি হওয়া যেত৷ এখন কিন্তু সেই সুযোগও নেই৷ একই প্রশ্নপত্রে মেডিকেল পরীক্ষা হয়৷ সিরিয়াল অনুযায়ী সরকারির পরে বেসরকারি ৬৬টি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা৷ আর এবার অটোমেশন করার পর সব ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে৷ পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেলের শিক্ষকদেরও একটা পেশাদারত্বের আওতায় আনা হয়েছে৷ ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একটা মর্যাদার জায়গায় এসেছেন৷
প্রশ্ন ফাঁসকারী এবং সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই কী এই সমস্যার সমাধান হবে?
মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় যে ডিজিটাল প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়, তাতে এখন আর কোনভাবেই ফাঁসের সুযোগ নেই৷ এখন পুরো বিষয়টি অ্যালার্ম সিস্টেমের মাধ্যমে মনিটরিং করা হয়৷ এটা সর্বশেষ প্রযুক্তি দিয়ে করা৷ এই প্রক্রিয়া যদি সব ধরনের পরীক্ষায় ব্যবহার করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের কোন পরীক্ষাতেই আর প্রশ্ন ফাঁস হবে না৷ সমাজে সব সময় নীতি নৈতিকতাহীন ও সুযোগসন্ধানী মানুষ থাকে৷ তাদের ব্যাপারে প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে৷ কেউ যদি এমন গন্ধ পায়, তাহলে সংশ্লিষ্টদের জানালে এই সুযোগগুলো বন্ধ হয়ে যাবে৷
ধরুন, একজন প্রশ্ন ফাঁস করে চিকিৎসক হয়েছেন৷ কিন্তু তিনি তো বিভিন্ন পরীক্ষায় ধাপে ধাপে পাশ করেছেন৷ সেক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা কোথায়? তিনি কী মেধাবী নন? মেডিকেল কলেজে পরীক্ষায় আবেদন করার একটা নির্ধারিত যোগ্যতা থাকে৷ যারা আবেদন করেন তারা তো ওই যোগ্যতা সম্পন্ন৷ ফলে ধরে নেয়া যায় তারা মেধাবী৷ এখানে তো একই মেধার কেউ চান্স পায়, কেউ পায় না৷ কিন্তু অবৈধভাবে যিনি ভর্তি হচ্ছেন, তিনি তো পাশ করতে পারবেন না, তা নয়৷ কিন্তু ব্যাপারটা হলো নীতি-নৈতিকতার৷ তার জন্য আরেকজন মেধাবী যার ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল, তিনি তো বঞ্চিত হলেন৷ ফলে তার ক্ষতি হলো৷ ফলে এটা শুধু নীতি-নৈতিকতার বিষয় নয়, এটা অনিয়ম এবং দুর্নীতিও৷ আইনের চোখে তারা অপরাধীও৷
অনৈতিকভাবে যিনি ভর্তি হয়েছেন, তিনি কী ভালো চিকিৎসক হতে পারেন?
চিকিৎসা পেশাটা সেবামূলক৷ যার জীবনটাই শুরু হয়েছে অনৈতিকতা দিয়ে, তিনি চিকিৎসক হলেও তার পেশাটা ভালো হবে, সেটা আমি আশা করি না৷ পেশাতেও তিনি অবৈধ কাজ করবেন৷ এতে পেশার সুনাম নষ্ট হবে৷ আমার মনে হয় না, কোন অবস্থাতেই তিনি একজন ভালো চিকিৎসক হতে পারবেন, ভালো মানুষ হতে পারবেন না৷
বিভিন্ন সময় প্রশ্ন ফাঁসকারীদের অনেককেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷ সম্প্রতি চিকিৎসক দম্পতিসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে৷ এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে৷ এদের কেন কঠোর শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না?
আপনার সঙ্গে আমি অনেকাংশেই একমত৷ এটা হয়ত আইনের দুর্বলতা৷ তারা হয়ত আইনের মারপ্যাঁচে বের হয়ে আসে৷ তিনি যে অন্যায় কাজটা করলেন, তার যে ধারায় বিচার হওয়া উচিত সেখানে হয়ত তার জামিনের সুযোগ থাকে৷ এই কারণে হয়ত জামিনে বের হয়ে আসেন৷ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে গেলে আইনের কিছু বিধিবিধান পরিবর্তন করতে হবে৷
বিভিন্ন পরীক্ষায় এখন যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে, সেখানে আর কী পরিবর্তন আনলে প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়া থেকে বের হওয়া সম্ভব?
গত ৭-৮ বছরে মেডিকেল পরীক্ষায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেটা যদি অন্যরা ফলো করে তাহলে পরির্তন হবে৷ সুযোগ সন্ধানী বা দুর্নীতিবাজরা মেডিকেলের এই ব্যবস্থা কিন্তু এখনও ভাঙতে পারেনি৷ এছাড়া প্রযুক্তিকে যদি আরও কোনোভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে৷ দায়িত্বশীল যারা, তাদেরও সজাগ থাকতে হবে৷ তাহলে সুযোগ সন্ধানীরা আর সুযোগ পাবে না৷