অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিবেশ নিয়ে বলছেন রোজিনা ইসলাম
শামীমা নাসরিন ঢাকা
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিবেশ, সীমাবদ্ধতা, নিজের কাজ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম৷
বিজ্ঞাপন
তার বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে৷ নিজের প্রতিবেদন নিয়ে তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছেন বিদেশে৷ পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার (২০১১), কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সসেলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিজম (২০১১), ডয়চে ভেলের দুর্নীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কার, টিআইবি-র অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৫), পিআইবি ও দুদকের উদ্যোগে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম পুরস্কার বাংলাদেশ'(২০১৪) সহ অসংখ্য পুরস্কার৷
ডয়চে ভেলে: অনেকের মতে বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেক কমে গেছে৷ আপনিও কী তাই মনে করেন?
রোজিনা ইসলাম: সত্যি বলতে বাংলাদেশে সেল্ফ সেন্সরশিপ এখন অনেক বেড়েছে৷ ওইভাবে কাজ করার পরিবেশও এখন আর নেই৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলতে আমরা যেটা বুঝি বা আপনি যদি বিশ্বের সঙ্গে মেলান সেটা তো বাংলাদেশে হয়ই না৷ একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে একটি টিম দরকার হয়৷ অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়, অর্থের প্রয়োজন হয়৷ অনেক সময় কয়েকটা দেশ মিলে করে৷ সেসব রিপোর্ট পুলিৎজার পুরস্কার পায়৷ তেমন বিশাল পরিসরের রিপোর্ট তো বাংলাদেশে হয় না৷ তবে আমাদের বাংলাদেশে দৈনিক ভিত্তিতে যেটা হতো, সেটাও অনেক কমে গেছে৷ আমি নিজেও আগে যে ধরনের কাজ করতাম এখন সেগুলো করতে পারছি না৷ আবার অনেক কাজ করা গেলেও দেখা যায় নানান কারণে সেগুলো দেওয়া যায় না৷ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরই সেল্ফ সেন্সরশিপ করতে হয়৷ সেই জায়গাটা অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে৷ তারপরও আমি বলবো, এই দেশে থেকে, এত হুমকি, এত ভয়ের পরও আমাদের সাংবাদিকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ তারা যে কোনো কাজই করছেন না, বিষয়টা আসলে তেমন না৷
‘বাংলাদেশে মোটামুটি এমন কেউ নাই, যাদের অনিয়মের খবর আমরা পেয়েছি, কিন্তু লিখিনি’
ডয়চে ভেলে: দর্শক-পাঠক এমনকি এখন অনেক সাংবাদিকও বলছেন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই৷ কিন্তু এই নেই নেই রবের মধ্যেও আপনার বেশ কিছু অনুসন্ধানী খবর দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে৷ ওই খবর প্রকাশের পর প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে৷ আপনি কিভাবে সেসব খবর সংগ্রহ করলেন?
আমি সব সময় চলতি ইস্যুর সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করি৷ পাশাপাশি একটু স্কুপ নিউজ বা এক্সক্লুসিভ নিউজ তুলে আনতে চাই৷ এটা আমার এক ধরনেরই নেশাই হয়ে গেছে৷ এক্ষেত্রে একটা হচ্ছে, নিউজ বের করে আনা৷ তারপর অফিসে সেটা প্রেজেন্ট করা৷ অফিসে নিউজটার প্রেজেন্টেশনটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার৷ অফিসে আমি যখন একটা আইডিয়া জমা দেই তখন অফিস আমাকে ওই স্টোরিটার জন্য নানান কাজ করতে বলে৷ আবার রিপোর্টের ডিসপ্লেটাও কিন্তু অনেক বড় বিষয়৷ নিউজটা কোন পাতায় ছাপা হলো৷ এসব কিছু মিলিয়েই একটি নিউজ ফোকাস পায়৷ আমি সব সময় চেষ্টা করি ভালো কিছু করার জন্য৷ আমি অনেকদিন ধরে কাজ করি বিধায় আমার অনেক সোর্সও তৈরি হয়েছে৷ সাংবাদিকদের নিউজ সেন্সেরও একটা ব্যাপার থাকে৷ এ ক্ষেত্রে আমরা অফিস থেকেও পূর্ণ সহযোগিতা পাই৷ আমরা কিন্তু ৯০ শতাংশ খবরই ছাপাতে পারি৷ আমাদের সম্পাদক অত্যন্ত সাহস নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে খবরগুলো প্রচার করেন৷ অফিস থেকে আমি পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছি৷ আমি যেসব রিপোর্ট করি সেগুলো অফিসের সমর্থন ছাড়া করা খুব কঠিন৷ অফিস আমাদের সব সময় উৎসাহ দেয়৷ আমার মনে হয় অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গেলে অফিসের সহযোগিতা ছাড়া সেটা খুবই কঠিন৷ কারণ ওই সব খবর খুব সেনসেটিভ হয়, কারো না কারো বিরুদ্ধে যায়, তারা সাধারণত প্র্রভাবশালী হন৷ ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তারা জড়িত থাকেন৷ তখন আমাদের নিরাপত্তার সেই গ্যারান্টিটা থাকতে হয়৷ আমার ক্ষেত্রে আমি নিজে চেষ্টা করি প্রোপার ডকুমেন্ট নিজের কাছে রাখতে৷ কিসের ভিত্তিতে আমি নিউজটা করেছি তার প্রমাণ নিজের কাছে রাখতে৷ আমি কোনো ডকুমেন্টের ভিত্তিতে রিপোর্ট করলে চেষ্টা করি সেটা চার-পাঁচ জায়গা থেকে ভেরিফাই করতে৷ আমি মুখের কথায় রিপোর্ট খুব কম করি৷ ডকুমেন্ট ছাড়া এবং বার বার সেটা চেক করা ছাড়া আমি রিপোর্ট করি না৷
প্রেসিডেন্টের পদত্যাগে ভূমিকা রাখা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা ‘ওয়াটারগেট কেলেংকারি’৷ ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার দুই সাংবাদিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগে ভূমিকা রেখেছিল৷
ছবি: Simon & Schuster
ঘটনার শুরু
১৯৭২ সালের ১৭ জুন ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট ভবনে ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় কমিটির সদরদপ্তরে পাঁচ ব্যক্তি অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷ তাদের মধ্যে একজন সিআইএ-র সাবেক কর্মকর্তা জেমস ম্যাকর্ড৷ ঘটনার সময় তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনি প্রচারণার জন্য গঠিত সংস্থায় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন বলে ১৯ জুন জানায় ওয়াশিংটন পোস্ট৷ তবে নিক্সনের রি-ইলেকশন ক্যাম্পেন প্রধান জন মিচেল তা অস্বীকার করেন৷
ছবি: Paul J. Richard/AFP/GettyImages
চোরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিক্সন ক্যাম্পেনের টাকা
ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টিন ১৯৭২ সালের ১ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানান, ডেমোক্রেটিক পার্টির অফিসে ঢোকার চেষ্টা করা এক ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার ডলারের ক্যাশিয়ার্স চেক পাওয়া গেছে৷ চেকটি আপাতদৃষ্টিতে নিক্সনের রি-ইলেকশন ক্যাম্পেনের বলে জানায় পত্রিকাটি৷
ছবি: washingtonpost.com
ডেমোক্রেটদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ
বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টিন ১৯৭২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে জানান, অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জন মিচেল নিক্সনের রিপাবলিকান দলের একটি গোপন তহবিল নিয়ন্ত্রণ করতেন, যেটা ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য জোগাড়ে ব্যবহার করা হতো৷
ছবি: washingtonpost.com
ওয়াটারগেট ঘটনার সঙ্গে নিক্সন ক্যাম্পেনের সম্পৃক্ততা
বব উডওয়ার্ড (ডানে) ও কার্ল বার্নস্টিন (বামে) ১০ অক্টোবর জানান, ওয়াটারগেটের ব্রেক-ইন ছিল নিক্সনের রি-ইলেকশন ক্যাম্পেনের পক্ষ থেকে চালানো রাজনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি ও ডেমোক্রেটদের নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা তৈরির চেষ্টার অংশ৷ অর্থাৎ ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনি প্রচারণা সম্পর্কে তথ্য পেতে তাদের অফিসের টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র বসাতে ঐ পাঁচ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন নিক্সন ক্যাম্পেনের কর্মকর্তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘ডিপ থ্রোট’
বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টিন তাদের কয়েকটি প্রতিবেদনে সূত্রের নাম উল্লেখ করেননি৷ পরে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাদের ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ বইতে ‘ডিপ থ্রোট’ নামে একটি সূত্রের কথা জানানো হয়৷ সব সূত্রের মধ্যে এই সূত্রটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলা জানা যায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কিন্তু কে ছিলেন ‘ডিপ থ্রোট’?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উডওয়ার্ডকে তথ্য দিয়েছিলেন ‘ডিপ থ্রোট’৷ তাই উডওয়ার্ডও ডিপ থ্রোটের পরিচয় গোপন রেখেছিলেন৷ তবে প্রতিবেদনগুলোতে গোপন সব তথ্যের উপস্থিতি দেখে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা ডিপ থ্রোটের পরিচয় জানতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন৷ কিন্তু পারেননি৷ অবশেষে নিক্সনের পদত্যাগের ৩১ বছর পর ২০০৫ সালে জানা যায় এফবিআই-এর সেই সময়কার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্ক ফেল্ট ছিলেন সেই ডিপ থ্রোট৷ ফেল্টের বয়স তখন ৯১৷
ছবি: picture-alliance/FBI Collection at NARA
কেন ডিপ থ্রোট তথ্য ফাঁস করেছিলেন?
ফেল্টের পরিবারের দাবি, নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের কারণে ফেল্ট তথ্য ফাঁস করেন৷ এদিকে, উডওয়ার্ড তার ‘দ্য সিক্রেট ম্যান’ বইয়ে জানান, ১৯৭২ সালের মে মাসে এডগার হুভারের মৃত্যুর পর ফেল্ট মনে করেছিলেন, ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকায় এবার তাকে এফবিআই প্রধান করা হবে৷ কিন্তু তা না করে আইন প্রয়োগের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা নৌ কর্মকর্তা প্যাট্রিক গ্রে’কে প্রধান করা হয়েছিল৷ এতে ফেল্ট অসন্তুষ্ট ছিলেন৷
ছবি: FBI Collection at NARA/Consolidated/picture alliance
ফেল্টের সঙ্গে উডওয়ার্ডের যোগাযোগ পদ্ধতি
গোপনে কথা বলতে তারা দুটি পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন৷ ফেল্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে উডওয়ার্ড নিজের ব্যালকনিতে টবে লাল পতাকা ঝুলিয়ে দিতেন, যা দেখে ফেল্ট বুঝতেন, উডওয়ার্ড কথা বলতে চান৷ আর ফেল্ট কথা বলতে চাইলে উডওয়ার্ডের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের রিসিপশনে উডওয়ার্ডের নামে থাকা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার ২০ নম্বর পাতায় ‘২০’ লেখাটি গোল করে সেখানে দাগ কেটে সময়টা বলে দিতেন৷ মাঝেমধ্যে ফেল্টের বাসায়ও ফোন করতেন উডওয়ার্ড৷
ছবি: AP
হোয়াইট হাউসের তোপের মুখে ওয়াশিংটন পোস্ট
ওয়াশিংটন পোস্টে একের পর এক প্রতিবেদন নিয়ে খুশি ছিল না নিক্সন প্রশাসন৷ নিক্সনের এক মুখপাত্র বলেছিলেন, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত যুদ্ধ শুরু করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট৷ এসব প্রতিবেদন মিথ্যা তথ্যে পরিপূর্ণ বলেও দাবি করা হয়েছিল৷ এছাড়া ওয়াটারগেট নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস ও টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে কিছু না বললেও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের সমালোচনায় মুখর ছিল হোয়াইট হাউস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ওয়াশিংটন পোস্ট নিয়ে অন্যান্য গণমাধ্যমের সন্দেহ
ওয়াটারগেট নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে শুরুর দিকে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছিল তার গুরুত্ব অন্যান্য গণমাধ্যম বুঝতে পারেনি৷ শুধু তাই নয়, ‘লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস’ ও ‘ওয়াশিংটন স্টার-নিউজ’ ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনগুলো সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রতিবেদন করেছিল৷ এছাড়া পোস্টের একটি প্রতিবেদনের তথ্য না ছাপিয়ে হোয়াইট হাউসের ঐ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যানের সংবাদ ছেপেছিল ‘শিকাগো ট্রিবিউন’ ও ‘ফিলাডেলফিয়া ইনক্যোয়ারার’৷
ছবি: AP
তথ্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা
ওয়াটারগেটে অবৈধ প্রবেশের পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্ভবত জানতেন না নিক্সন৷ তবে এফবিআই এক চোরের খাতায় হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তার নাম পেলে চিন্তিত হয়ে ওঠেন নিক্সন৷ তিনি এফবিআই-এর তদন্ত বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন বলে ‘স্মোকিং গান’ শীর্ষক অডিও টেপগুলো থেকে জানা যায়৷ এসব টেপে নিক্সন ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কথা রেকর্ড করা ছিল৷
ছবি: picture alliance/dpa/Everett Collection
নিক্সনের পদত্যাগ
ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, এফবিআই-এর তদন্ত ইত্যাদি কারণে নিক্সন প্রশাসনের উপর চাপ বাড়ছিল৷ এই ঘটনা তদন্তে সেনেটে একটি কমিটিও গঠন করা হয়৷ শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, নিক্সন ইম্পিচমেন্টের শিকার হতেন৷ সেটা আঁচ করতে পেরেই ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন তিনি৷ ফলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে মাত্র দেড় বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি৷
ছবি: Everett Collection/imago images
‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’
ওয়াটারগেট কেলেংকারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিস্তারিত ১৯৭৪ সালে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন’ নামে প্রকাশিত এক বইয়ে তুলে ধরেছিলেন বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টিন৷ বইয়ে ওয়াটারগেট কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত নিক্সন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও নিক্সনের নির্বাচনি প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের ‘প্রেসিডেন্ট’স মেন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷ ঐ ঘটনায় নিক্সন ক্ষমা পেলেও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছিল৷
ছবি: Simon & Schuster
13 ছবি1 | 13
ডয়চে ভেলে: সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নাম নিলেই যে রিপোর্টটার কথা সবার আগে মনে পড়ে সেটা হলো বিদেশি বন্ধুদের মুক্তিযু্দ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টের স্বর্ণ জালিয়াতির খবর৷ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও যেটা আলোড়ন তুলেছিল৷ পেয়েছিলেন ডয়চে ভেলে দুর্নীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কার৷ ওই প্রতিবেদন তৈরির পেছনের গল্পটা যদি বলতেন৷
এটা একটি পুরাতন প্রতিবেদন৷ প্রায় সাত বছর আগের৷ কিন্তু এখনো কোথাও গিয়ে যদি আমার নিজেকে পরিচয় দিতে হয় তখন এই প্রতিবেদনটির কথা বললে সাধারণ মানুষ বা বাইরের মানুষ খুব দ্রুত আমাকে চিনে যান৷ আমার আরেকটা স্টোরি হলো, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের জন্য ছয় সচিবের চাকরি চলে যাওয়া৷ প্রশাসনের লোকজন এই প্রতিবেদনের জন্য আমাকে চিনে ফেলেন৷
এই প্রতিবেদন দুটি পেতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল৷ আমি আসলে ছয় সচিবের প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছিলাম৷ ওই ছয় সচিব অবসরে যাওয়ার আগে আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছিলেন৷ ওই সময় অফিসার্স ক্লাবে একটি নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছিল৷ সেখানে প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজউদ্দীন৷ একজন আমাকে বললেন, ওনার তো মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে, ওনার তো এরকম নাই৷ নিউজ কিন্তু এভাবেই আসে৷ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ থেকে নিউজ বের হয়৷ তখন আমি বললাম, ওনার যে সনদ নাই আমি এটা কিভাবে প্রমাণ করবো৷ তখন তিনি বললেন, সরকারি দপ্তরে সব কাগজই থাকে৷ সেখানে লেখা থাকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন কিনা৷ এবং আপনি মন্ত্রণালয়েও খোঁজ নিতে পারেন, এটা কিভাবে নিয়েছে৷ সেখান থেকেই আমি প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করলাম৷ এরপর ওই প্রতিবেদন যখন ছাপা হলো এবং দুদকে তদন্ত শুরু হলো এবং দুদকে প্রমাণ হলো; ওই সচিবদের সনদ বাতিল হলো৷ তখন আসলে আমার উপর অনেক সোর্সের আস্থা তৈরি হয়৷ যারা দুর্নীতির খবরগুলো দিতে চান৷ আমাকে তখন নানান জায়গা থেকে নানা রকম তথ্য দেওয়া শুরু হলো৷ আমাকে বলা হলো আপনি এ কাজগুলো করতে পারেন৷ তখন একজন আমাকে ক্রেস্টের কথা বললেন৷ বললেন, এই যে বিদেশি বন্ধুদের ক্রেস্ট দেওয়া হচ্ছে এটা নিয়ে কিন্তু অনেক গোলমাল আছে৷ আপনি খোঁজখবর নেন৷ আমি চেষ্টা করলাম খোঁজ খবর নিতে৷ তো ওই সময় আমি একদিন অফিসে এসে দেখি কেউ একজন আমার নামে একটা চিঠি দিয়ে গেছেন৷ চিঠিটা খুলে দেখি ক্রেস্ট জালিয়াতি নিয়ে বিএসটিআই তে যে পরীক্ষা হয় সে বিষয়ের একটি কাগজ৷ আমি প্রথমে খুব একটা বিশ্বাস করিনি৷ যেকোনো কাগজ কে তো আর বিশ্বাস করতে পারি না৷ কিন্তু বিশ্বাস না করলেও আমি কাগজটি ফেলে দেইনি৷ আমি বিষয়টা নিয়ে অফিসে আলাপ করলাম৷ আমাকে বলা হলো, আপনি এটা নিয়ে কাজ করেন; দেখেন কী পাওয়া যায়৷ তারপর আমি খুঁজতে খুঁজতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে গেলাম৷ সেখান থেকে বিএসটিআইর অফিসে গিয়ে খোঁজ শুরু করলাম৷ যেকোনো অফিসিয়াল চিঠির দুইটি কপি থাকে৷ একটা অফিসে, একটা বাইরে৷ আমি চিঠির সিরিয়াল ধরে স্মারক নম্বরটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম এবং পেয়েও গেলাম৷ দেখলাম স্মারক নম্বরটা সত্যি৷ সেখানেই লেখা ছিল সোনার পরিমাণ যতটা বলা হয়েছে ততটা ছিল না৷ তার ভিত্তিতেই আমি নিউজের হেড করেছিলাম ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে'৷ আমি বার বার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করলাম৷ এই প্রতিবদেনটা তৈরি করতে আমার তিনমাস সময় লেগেছে৷ রিপোর্টটা জমা দেওয়ার পর আমরা আরো একমাস সময় নেই, আরো পরীক্ষা করা হয়৷ রিপোর্টটা রেডি করে যখন আমি জমা দেব তখন দেখা গেলে ২৬ মার্চ এসে গেছে৷ তো তখন অফিস থেকে চিন্তা করা হলো এমন একটা প্রতিবেদন ২৬ মার্চের আগে দেওয়া ঠিক হবে না৷ তাই আমরা আরো কয়েকদিন সময় নিলাম৷ এপ্রিলে রিপোর্টটি প্রকাশ পায়৷
সেরা ১১ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
পুলিৎজার পুরস্কারকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার বলে ধারণা করা হয়৷ গত ১১ বছরে কারা পেয়েছেন এ পুরস্কার জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Heidi Levine
২০০৬ সাল
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’-র সাংবাদিক সুজান স্মিড, জেমস ভি গ্রিমাল্ডি এবং আর. জেফরি স্মিথ সে বছর পেয়েছিলেন এই পুরস্কার৷ সংস্কারের নামে মার্কিন কংগ্রেসে ওয়াশিংটন লবিস্ট জ্যাক আব্রামোফের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷
ছবি: AP
২০০৭ সাল
‘দ্য বার্মিংহ্যাম নিউজ’-এর ব্রেট ব্ল্যাকলেজ পেয়েছিলেন এই পুরস্কার৷ একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দেন তিনি৷ যার ফলে ঐ চ্যান্সেলরকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০০৮ সাল
এ বছর দু’টি পত্রিকা এ পুরস্কার পায়৷ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার ওয়াল্ট বোগদানিচ এবং জেক হুকার পেয়েছিলেন এ পুরস্কার৷ চীন থেকে আমদানিকৃত ওষুধ ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷ এছাড়া ‘শিকাগো ট্রিবিউন’-এর এক প্রতিনিধি জিতেছিলেন এই পুরস্কার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০৯ সাল
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর ডেভিড বার্সতো পেয়েছিলেন এ পুরস্কার৷ কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রেডিও ও টেলিভিশনে বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পেন্টাগনের সমর্থনে ইরাক যুদ্ধকে প্রভাবিত করছে৷ তাদের এসব বক্তব্যের কারণে কত কোম্পানি সুবিধাভোগ করছে তাও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Emmert
২০১০ সাল
‘দ্য ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ’-এর বারবারা ল্যাকার ও ওয়েনডি রুডারম্যান এবং ‘নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন’-এর প্র-পাবলিকার শেরি ফিঙ্ক যৌথভাবে এ পুরস্কার জিতেছিলেন৷ একটি অসৎ পুলিশ দলের মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি উদঘাটন করেন ল্যাকার ও রুডারম্যান৷ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ হয়েছিল৷ ফিঙ্ক ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা আঘাত হানার পর রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Ngan
২০১১ সাল
‘সারাসোতা হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর পেইজি সেন্ট জন সে বছর পুলিৎজার পেয়েছিলেন৷ ফ্লোরিডার বাড়ি মালিকদের সম্পদের ইনস্যুরেন্সে দুর্বলতা সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তাঁকে এ পুরস্কার এনে দিয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১২ সাল
‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর ম্যাট অ্যাপুৎসো, অ্যাডাম গোল্ডম্যান, এইলিন সুলিভান এবং ক্রিস হাওলি সে বছর এই পুরস্কার জিতেছিলেন৷ নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ‘ক্ল্যানডেস্টাইন গুপ্তচর কর্মসূচি’র আওতায় শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রতি নজর রাখা হচ্ছিল, যা প্রকাশ পায় এপি-র ঐ প্রতিবেদনে৷ প্রতিবেদন প্রকাশের পর কংগ্রেস থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত দাবি করা হয়৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১৩ সাল
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর ডেভিড বার্সতো এবং আলেহান্দ্রা ইয়ানিক ফন বেরত্রাব এই বছর পুরস্কারটি পান৷ মেক্সিকোতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কীভাবে ওয়াল-মার্ট ঘুষ দেয়, সেটা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷
ছবি: AP
২০১৪ সাল
ওয়াশিংটর ডিসির ‘দ্য সেন্টার ফর পাবলিক ইনটিগ্রিটি’-র ক্রিস হামবি জেতেন এই পুরস্কার৷ কয়লা খনির শ্রমিকদের ফুসফুসের রোগ নিয়ে কয়েকজন আইনজীবী ও চিকিৎসকের প্রতারণার চিত্র তুলে ধরেছিলেন তার প্রতিবেদনে৷ যার ফলে ঐ আইনজীবী ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১৫ সাল
এ বছর দুইজন জিতেছেন এই পুরস্কার৷ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর এরিক লিপটন কংগ্রেস নেতা ও অ্যাটর্নি জেনারেলদের লবিস্টরা তাদের কতটা প্রভাবিত করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর এক প্রতিনিধির স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের জন্য৷
ছবি: Imago/Rüdiger Wölk
২০১৬ সাল
চলতি বছরে ‘ট্যাম্পা বে টাইমস’-এর লিওনোরা লাপিটার ও অ্যান্থনি কর্মিয়ার এবং ‘দ্য সারাসোতা হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর মাইকেল ব্রাগা জিতেছেন এই পুরস্কার৷ ফ্লোরিডা মানসিক হাসপাতালের অবহেলার অমানবিক চিত্র ফুটে উঠেছিল তাদের প্রতিবেদনে৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
11 ছবি1 | 11
ওই সময়ে খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা আমার মনে আছে৷ একজন অতিরিক্ত সচিব যিনি ক্রেস্ট বিষয়ক কমিটিতে ছিলেন তার সঙ্গে আমি দেখা করতে তার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ আমি তাকে ফোন করে বলি, একটু কথা বলতে চাই৷ উনি বললেন, আমি তো রুমে নাই৷ তখন আমি তার রুমে ঢুকে গিয়ে বলি আপনি তো আছেন, কেন বললেন নাই৷
এ ধরনের ঘটনায় আমি একটা ব্যাপার দেখেছি৷ যারা দোষী তাদের চেহারা দেখলে বা তাদের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্ট বোঝা যায় এখানে একটা অনিয়ম হয়েছে৷ তাছাড়া, আমার কাছে তো কাগজ ছিল, তাই আমার শক্তির জায়গা ছিল৷ আর ওই কাগজটা যে ঠিক আমি সেটা নানান ভাবে যাচাই করেছি, প্রমাণ করেছি৷ তো শেষ পর্যন্ত প্রতিবেদনটি ছাপা হলো৷ যদিও ছাপা হওয়ার সময় আমি বুঝি নাই এটা আসলে কত বড় প্রতিবেদন৷
কিন্তু প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার সাথে সাথে সাড়া পড়ে গেল৷ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত সেটা দুদকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো৷ দুদকের তদন্ত শুরু হলো৷ একইসঙ্গে মন্ত্রী ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি করলেন৷ এটা খতিয়ে দেখার জন্য কমিটিকে খুব কম সময় বেঁধে দেওয়া হলো৷
আমি নিজে পরীক্ষার জন্য ক্রেস্ট হাতে পাইনি৷ কিন্তু কমিটি চার/পাঁচ জায়গায় ক্রেস্ট পরীক্ষা করালো৷ আমার প্রতিবেদনে ছিল কিছু স্বর্ণ আছে৷ কিন্তু তাদের পরীক্ষায় দেখা গেল কোনো স্বর্ণই নাই৷ এই রিপোর্ট আসলে একটা মাইলফলক৷ কিন্তু দুঃখর বিষয় সাত বছর কেটে গেলেও এই ঘটনার পেছনে দায়ী মূল ব্যক্তিদের সাজা হয়নি৷
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে কখনো জীবননাশের হুমকি বা নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছেন কিনা?
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে গেলে নিরাপত্তার অভাব বোধ করি, এটা ঠিক৷ তবে কেউ আমাকে সেই ভাবে এই নিউজ করলে মেরে ফেলব বা এই ধরনের কিছু বলেনি৷ আমি সাধারণত যার বিষয়ে রিপোর্ট করি তার সঙ্গে এত কথা বলি যে তিনি জেনে যান আমি তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করছি৷ তারা বিভিন্নজনকে দিয়ে ফোন করানোর চেষ্টা করেন৷ হয়তো আমাকে সরাসরি করলেন না কিন্তু সম্পাদকের কাছে বা অন্যদের কাছে ফোন করে নানান ভাবে নিউজ বন্ধ করারও চেষ্টা করেন৷
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭৩ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী মারা গেছেন৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: Getty Images/C. McGrath
ভিক্টোরিয়া মারিনোভা, বুলগেরিয়া
৩০ বছর বয়সি এই টিভি উপস্থাপক সম্প্রতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত করছিলেন ঐ সাংবাদিকরা৷ সম্প্রতি মারিনোভাকে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: BGNES
জামাল খাশগজি, সৌদি আরব
আল-আরব নিউজ চ্যানেলের সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট খাশগজি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ৷ নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি সৌদি কর্তৃপক্ষ তাঁকে মেরে ফেলতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Reuters/Middle East Monitor
ইয়ান কুচিয়াক, স্লোভাকিয়া
সরকারের সঙ্গে ইটালির মাফিয়াদের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করছিলেন স্লোভাকিয়ার এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷ গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে তাঁর বান্ধবীসহ হত্যা করা হয়৷ সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে৷ কুচিয়াক হত্যার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে পদত্যাগে বাধ্য হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Voijnovic
মারিয়ো গোমেজ, মেক্সিকো
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কাজ শুরুর পর থেকেই হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন গোমেজ৷ সেপ্টেম্বরে নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর সশস্ত্রদের গুলিতে প্রাণ হারান ৩৫ বছর বয়সি এই সাংবাদিক৷ চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মেক্সিকোয় ১০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Cortez
সামিম ফারামারাজ ও রমিজ আহমাদি, আফগানিস্তান
সেপ্টেম্বরে কাবুলে একটি বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে লাইভ করছিলেন সামিম ফারামারাজ৷ ক্যামেরায় ছিলেন রমিজ আহমাদি৷ লাইভ শেষ করছিলেন এমন সময় কয়েক মিটার দূরে আরেকটি বিস্ফোরণ হলে প্রাণ হারান এই দুই গণমাধ্যমকর্মী৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Marai
মার্লোন ডি কারভালু আরায়ুজু, ব্রাজিল
দেশটির বাহিয়া আঞ্চলিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি প্রকাশ করেছিলেন এই সাংবাদিক৷ গত আগস্টের এক ভোরে তাঁর বাড়িতে সশস্ত্র কয়েকজন ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Sa
সুজাত বুখারি, কাশ্মীর
জুনে শ্রীনগরে তাঁর সংবাদপত্র অফিসের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইতেন ডয়চে ভেলের এই কন্ট্রিবিউটর৷
ছবি: twitter.com/bukharishujaat
দ্য ক্যাপিটাল, যুক্তরাষ্ট্র
গত জুনে এই সংবাদপত্র অফিসে গুলি করে সম্পাদক ওয়েন্ডি উইন্টার্স, তাঁর সহকারী রবার্ট হিয়াসেন, লেখক জেরাল্ড ফিশম্যান, সাংবাদিক জন ম্যাকনামারা ও বিক্রয় সহকারী রেবেকা স্মিথকে হত্যা করা হয়৷ হত্যার দায়ে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ব্যক্তি ঐ পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Ngan
8 ছবি1 | 8
কিন্তু আমি নিজের নীতিতে অটল৷ এটা আমার সোর্সরাও জানে৷ আমি যে রিপোর্টই করি, তারপর যত খাতিরই করুক আমি ওই রিপোর্ট ছাপাবোই৷ আমার সম্পাদকও এটা জানেন৷
তবে কয়েকটি রিপোর্টের ক্ষেত্রে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে৷ যেমন, একবার ডেসটিনির মালিক রফিকুল আমিনকে নিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম, তিনি দিনের পর দিন হাসপাতালে থাকেন৷
ওই রিপোর্টটা করার পর ডেসনিটি গ্রুপের মেম্বাররা নানান ভাবে ফেসবুকে আমাকে আক্রমণ করে৷ আমার, আমার সন্তানের ছবি দিয়ে নানা কিছু লিখে পোস্ট ভাইরাল করে দেয়৷ এরকম করার চেষ্টা অনেকেই করে৷ তবে আমার বেশিরভাগ রিপোর্টেরই পজেটিভ রিঅ্যাকশন হয়৷ তবে সমস্যা হয় যেখানে সেটা হলো, মন্ত্রণালয়ের লোকজন তখন খুব সতর্ক হয়ে যান৷ তারা কথা বলতে চান না, ভয় পান, তথ্য দিতে চান না৷ তারা মনে করেন, আমার সঙ্গে কথা বললে তাদের চাকরি চলে যাবে৷ এটাতে আমি খুবই পাজেল হয়ে যাই৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কমে গেছে?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার এটা বিষয় তো আছেই৷ কিন্তু সমস্যা হয় কি, মামলা যদি সত্য হয় তাও নেয়া যায়৷ কিন্তু মামলার সঙ্গে তো রঙচঙ মেশানো হয়৷
এমন যদি হয় আমি ভুল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট করেছি এবং সেজন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তাহলে আমি মাথা পেতে নেব৷ কিন্তু যদি একজনকে হেনেস্তার জন্য বলা হয়, তিনি অপরাধী, অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত তাহলে তো হয় না৷ এই যেমন, একজন খুব সাধারণ ফটোসাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হলো, তাকে আটকে রাখা হলো৷ তবে আমার কাছে মনে হয়, এই সংখ্যাটা আসলে কম৷ অনেক যে মামলা হচ্ছে, বিষয়টা কিন্তু তা না৷ এক্ষেত্রে আমাদের সাংবাদিকদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে৷ আমরা যখন লিখি বা যেকোনো জিনিস ছাপাই তখন যেন তথ্য প্রমাণ হাতে নিয়ে কাজ করি৷ আমাদের কাছে একটা তো জায়গা আছে, আদালত৷ আদালতে আমি যখন যাব তখন যেন দেখাতে পারি আমি কিসের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট করেছি বা কে আমাকে বলেছিল৷ যদি আমি ভুল করি তবেই না ডিজিটাল আইনে মামলা হবে৷ অফিসেও যাচাই বাছাই থাকতে হবে৷ যেমনটা আমাদের অফিসে আছে৷ আমরা একটা রিপোর্ট দিলেই কিন্তু ছাপিয়ে ফেলা হয় না৷ আরো যাচাই করার পর সেটা ছাপা হয়৷ যার ফলে আমরা সাংবাদিকেরা নিরাপদে থাকি৷
সবশেষে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে বলি৷ অনেকেই বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিবেশ নিয়ে বার বার বলছেন৷ বলছেন, আল জাজিরায় যেমন রিপোর্ট হয়েছে বাংলাদেশে তেমন রিপোর্ট হয় না৷ বাংলাদেশ এমন রিপোর্ট হয় না, বিষয়টা কিন্তু তা না৷
বাংলাদেশেও এমন রিপোর্ট হয়৷ এই জোসেফের বিষয় নিয়েই আমরা অনেক লিখেছি৷ জোসেফের যখন সাজা মওকুফের তোড়জোড় বা সম্রাটকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে৷ এর বাইরে আর কারা আছে বাংলাদেশে৷ বাংলাদেশে মোটামুটি এমন কেউ নাই, যাদের অনিয়মের খবর আমরা পেয়েছি, কিন্তু লিখিনি৷ এখন হয়েছে কি, অন্য দেশে থেকে তো অনেক বেশি প্রকাশ করা সম্ভব হয়৷ নিজের দেশে থেকে সেগুলো করা তো আসলে অতটা সহজ নয়৷ যেহেতু আমার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনেরা আছেন৷
তারপরও আমার মনে হয়, বাংলাদেশে অনেক ভালো সাংবাদিক আছেন৷ যারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন তারা এসব বিষয় একদমই প্রশ্রয় দেন না৷ ভালো রিপোর্ট আসলে সেটা প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাদের ঘুম হবে না৷ তারা সব সময় সেটি প্রকাশের চেষ্টা করে যান৷ না হলে আমার যে রিপোর্টগুলো ছাপা হয়েছে, বা অন্য পত্রিকার সাংবাদিকরা যেসব রিপোর্ট করেছেন সেগুলো কিভাবে ছাপা হলো৷