1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে বুট কিনেছে মারিয়া মান্দা’

নোমান মোহাম্মদ ঢাকা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

গারো পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক জনপদ৷ কলসিন্দুর৷ বাংলাদেশের নারী ফুটবলের আঁতুড়ঘর৷ এই যে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতল বাংলাদেশ, সেই জাতীয় দলের আট জন মেয়ে এখানকার৷

নারী ফুটবলারদের সঙ্গে কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন৷
নারী ফুটবলারদের সঙ্গে কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন৷ছবি: Private

সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, তহুরা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার ও শিউলি আজিম৷ তাদের সবারই ফুটবলে হাতেখড়ি কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিনের মাধ্যমে৷ বছর পাঁচেক হলো সে স্কুলে নেই তিনি৷ প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রণসিংহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে৷ কিন্তু কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্য ছুঁয়ে গেছে তাকেও৷ ডয়েচে ভেলের মুখোমুখি হয়ে মেয়েদের ফুটবলে নিয়ে আসার সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের গল্পই বললেন মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন৷ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নোমান মোহাম্মদ৷

ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশ তো সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে৷ সে দলে কলসিন্দুরের আট জন৷ আপনার কতোটা ভালো লাগছে?

মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন : আমাদের এই মেয়েরা অনেক কিছুই উপহার দিয়েছে৷ সেই সব উপহার ছিল বয়সভিত্তিক দলে৷ এই প্রথম বাংলাদেশ নারী জাতীয় দল সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে৷ এটা অবশ্যই গর্বের এবং আনন্দের৷ এই দলে আমার হাতে গড়া আটজন ফুটবলার আছে৷ এজন্য আমার গর্বটা আরও বেশি৷ আনন্দটাও একটু বেশি৷

প্রশ্ন : বাংলাদেশ এই ট্রফি জয়ের পর কি মেয়েদের কারও সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?

মফিজ উদ্দিন : না, সরাসরি কথা হয়নি৷ ফেসবুকে মত বিনিময় হয়েছে৷ তবে নেপাল যাবার সময় বিমানে বসে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলেছে৷ আমি শুভ কামনা জানিয়েছি৷ দেশে ফিরলে আবার কথা হবে৷

প্রশ্ন : যাবার সময় কী কথা হয়েছিল?

মফিজ উদ্দিন : সানজিদার ফেসবুক স্ট্যাটাস হয়তো আপনি দেখেছেন৷ ওদের সঙ্গে আমার কথা ছিল একটাই৷ তোমরা এখন শুধু কলসিন্দুরের খেলোয়াড় না, তোমরা বাংলাদেশের খেলোয়াড়৷ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ তোমাদের দিকে চেয়ে থাকবে৷ সবসময় মাথায় রাখবে যেন দেশের সুনাম বয়ে আনতে পারো৷ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা খচিত জার্সি তোমাদের কাছে থাকবে৷ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমরা৷ ওদের সঙ্গে এটাই ছিল আমার কথা৷

‘আমাদের মেয়েদের যে শারীরিক গঠন, শক্তিমত্তা-এসব বিবেচনা করলে এত বেশি উচ্ছ্বসিত হওয়া যায় না’

This browser does not support the audio element.

প্রশ্ন : আপনি সানজিদার কথা বলছিলেন৷ ফাইনালের আগে তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাস সবার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল৷ এই সানজিদাকে কিভাবে আপনি ফুটবলে নিয়ে এলেন, সেটা যদি একটু বলেন৷

মফিজ উদ্দিন : আমি একেবারে শুরুর কথা বলি৷ ২০১০ সালে ছেলেদের স্কুল ফুটবলের ফাইনালে পুরষ্কার বিতরণীর সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, পরের বছর থেকে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হবে৷ ওই সময় আমার মাথায় আসে যে, মেয়েদের নিয়ে ফুটবল টিম করব৷ আমি তখন কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক৷ মেয়েদের এক ক্লাসের সঙ্গে আরেক ক্লাস, এক সেকশনের সঙ্গে আরেক সেকশনের ফুটবল খেলার মাধ্যমে বেশ কিছু খেলোয়াড় বাছাই করি৷ তো প্রথম অবস্থায় এই এলাকার পরিবেশ, লোকজনের চালচালন কিংবা ধর্মীয় বোধ, সেটি একেবারে সহযোগিতা করছিল না৷ নানা বাধা-বিপত্তি ছিল৷ মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে খেলছে কেন, এমন কথার প্রেক্ষিতে সালোয়ার-কামিজ পরে খেলতে হত৷ মেয়েদের আবার কিসের ফুটবল খেলা---এমন কথাও ছিল৷ এসব অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমরা খেলাটা শুরু করেছিলাম৷

প্রশ্ন : এটা তো প্রতিকূল পরিবেশে মেয়েদের ফুটবল শুরুর কথা বললেন৷ যদি নির্দিষ্ট করে সানজিদা কথা জানতে চাই...

মফিজ উদ্দিন : ওই যে বললাম, স্কুলের মেয়েদের মধ্য থেকে বাছাই করেছিলাম৷ সেখানে সানজিদা টিকেছিল৷ মেয়ের ফুটবল খেলার ব্যাপারে ওর মায়ের একটু আপত্তি ছিল৷ ওর দুলাভাইয়েরও আপত্তি ছিল৷ তবে বাবার সহযোগিতার কারণে সানজিদা ফুটবলে আগ্রহী হয়েছে৷

প্রশ্ন : সানজিদার বাবা-মা কী করেন?

মফিজ উদ্দিন : সানজিদার বাবা কৃষক৷ মা গৃহিনী৷

প্রশ্ন : পরিবার থেকে আপত্তির কথা বলছিলেন৷ তাঁদের কিভাবে বুঝিয়েছেন আপনি?

মফিজ উদ্দিন : অনেক কিছুই বলতে বলতে হয়েছে৷ যেমন, বাংলাদেশের নারীরা আর আগের মতো পিছিয়ে নেই৷ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেয়েদের ফুটবলের উদাহরণ দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করেছি৷

প্রশ্ন : সাফ ফাইনালে প্রথম গোল করেছেন যে শামসুন্নাহার জুনিয়র, তার গল্পটা শুনতে চাই৷

মফিজ উদ্দিন : আমরা যখন খেলা শুরু করি, তখন শামসুন্নাহার একেবারে ছোট৷ ওকে অনেকে পিচ্চি শামসু বলত৷ সানজিদাদের ১৭ দলের দলে ও থাকত, তবে শুরুর একাদশে না৷ খেলার শেষ দিকে মাঠে নামাতাম৷ দেখা যেত, ওই চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে একটা ঝলক দেখাত৷ মানুষকে আনন্দ দিত৷ একবার মনে আছে, ওই শেষ চার-পাঁচ মিনিট খেলেই ও ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে যায়৷

প্রশ্ন : সাফ ফাইনালেও তো প্রথম একাদশে শামসুন্নাহার জুনিয়র ছিলেন না৷ বদলি হিসেবে নেমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোল দিয়েছেন আপনার বলা সেই ছোটবেলার মতোই৷ তাঁকে ফুটবলে নিয়ে আসাটা কিভাবে?

মফিজ উদ্দিন : শামসুন্নাহারের বাবা তেমন কাজ-টাজ করতেন না৷ বাড়ির কাছে মসজিদ ছিল৷ সেখানেই নামাজ-কালাম পড়তেন৷ উনি শামসুন্নাহারকে খেলায় দিতে একেবারেই রাজি ছিলেন না৷ অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করাতে হয়েছে৷ শামসুন্নাহারের একটা ছোট বোন ছিল৷ নাম নাজমুন্নাহার৷ ও-ও ভালো ফুটবলার ছিল; দলে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু ওকে পরে স্কুল থেকে নিয়ে মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়৷

প্রশ্ন : এই জাতীয় দলে কলসিন্দুরের আরেক ফুটবলার তহুরা খাতুন৷ তাকে ফুটবলে নিয়ে আসাটা কাহিনীটা কেমন? তার পরিবারকে বোঝানোটা কত কঠিন ছিল?

মফিজ উদ্দিন : তহুরার বিষয়টা আরও কঠিন ছিল৷ ওর দাদা একজন হাজী৷ ওনাকে আমিও দাদা ডাকি৷ আমাকে এক দিন বললেন, ‘তুই যে আমার নাতিরে খেলা শিখাইতাছোস, ওরে বিয়া দেওন লাগব না! বল খেললে ওরে বিয়া দেওন যাইব?’ এ নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে৷ তহুরার দাদা ফুটবল খেলতে নিষেধ করে দেয়৷ ওর বাবাও নিষেধ করে৷ তহুরার দুলাভাই একজন হাফেজ এবং মওলানা৷ তহুরা ফুটবল খেললে খুব রাগ করতেন৷ এ কারণে তিনি এলে তহুরা আর বাড়িতে থাকত না৷ এরপর আমি এলাকার মেম্বারকে সাথে নিয়ে গিয়ে তহুরার বাবাকে অনেক বুঝিয়েছি৷ শুধু ওর কাকারা রাজি ছিল মেয়েকে খেলতে দিতে৷ আর মেয়ের যেহেতু এত আগ্রহ, তাই সবাই মিলে বোঝানোর পর তহুরার বাসা থেকে ফুটবল খেলতে দিতে রাজি হয়েছে৷ এখন তো মেয়ে স্বাবলম্বী হয়ে গেছে৷ সবাই তাই ক্রেডিট নিতে চায়৷

প্রশ্ন : মারিয়া মান্দার বেলাতেও কি পরিবারের এমন বাধা এসেছিল?

মফিজ উদ্দিন : নাহ্৷ মারিয়া মান্দার পরিবারের দিক থেকে কোনো বাধা ছিল না৷ ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল দারিদ্র্য৷ এমনও হয়েছে যে, ওর বুট কেনার টাকা নেই৷ অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে সে টাকা দিয়ে মারিয়া মান্দা বুট কিনেছে-এমন ঘটনাও আছে৷ আমাকে বলেছে, স্যার আমি দুদিন খেলায় আসতে পারব না৷ আমি ওকে ছুটি দিয়েছি৷ পরে জানতে পেরেছি, সেই দুদিন মারিয়া অন্যের জমিতে কাজ করে সে টাকা দিয়ে বুট কিনেছে৷ ওর মা-ও অন্যের জমিতে কাজ করত৷ এরকমও দিন গেছে ওদের৷

প্রশ্ন : তাকে খেলায় আনতে অন্যদের মতো সমস্যা হয়নি?

মফিজ উদ্দিন : না৷ ওরা তো আদিবাসী৷ ওদের সমাজে মেয়েকে খেলতে দেবার ব্যাপারে বিধিনিষেধ নেই৷

প্রশ্ন : এখন তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন?

মফিজ উদ্দিন : ভালো৷ তবে কলসিন্দুরের যে মেয়েদের কথা বললেন, ওদের মধ্যে সানজিদা ও তহুরা ছাড়া বাকি সবাই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা৷ আমি যখন কলসিন্দুর স্কুল থেকে বদলি হয়ে যাই, তখন ৭০-৮০ জন মেয়েকে নিয়ে ফুটবল প্র্যাকটিস করাতাম৷ তাদের প্রায় সবাই গরীব৷ এখন যারা জাতীয় পর্যায়ে খেলছে, ওদের আর আগের মতো দরিদ্রতা নেই৷ মোটামুটি চলার মতো সংস্থান হয়েছে৷  

প্রশ্ন : মারিয়া মান্দার ওই অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে বুট কেনার মতো আর কোনো কাহিনী কি আপনার মনে পড়ছে?

মফিজ উদ্দিন : না, ওরকম নেই৷ তবে দরিদ্রতার ছাপ ছিল প্রায় সবার মধ্যে৷ আমরা করতাম কী, সাপ্তাহিক একটা টাকা নিতাম৷ সবাই আমার কাছে টাকা জমা রাখত৷ আমি খাতায় লিখে রাখতাম৷ কারও বুট কেনার টাকা জমা হয়ে গেলে সেটা ওকে দিতাম; ও বুট কিনে আনত৷

প্রশ্ন : এসব কাজে কি এলাকার কারও সহযোগিতা পেতেন?

মফিজ উদ্দিন : ২০১১ সালে তো আমরা শুরু করি৷ ২০১৪-১৫ পর্যন্ত নিজেদেরই সব করতে হয়েছে৷ এরপর কেউ কেউ কিছুটা সহযোগিতা করেছেন৷ যেমন মেয়েদের খেলা দেখে খুশি হয়ে হয়তো পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন৷ সেটা দিয়ে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করতাম৷ কেউ হয়তা জার্সি দিত; কেউ বুট দিত৷ এগুলো পরে এসেছে৷ শুরুর চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে বেশি ছিল৷

প্রশ্ন : এখন তো বাংলার এই মেয়েরাই দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন৷ তাদের নিয়ে আরও কত বড় স্বপ্ন দেখেন আপনি?

মফিজ উদ্দিন : আসলে স্বপ্ন তো দেখাই যায়৷ কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা বড় কথা৷ আমাদের আর্থ-সামাজিক যে অবস্থা, আমাদের মেয়েদের যে শারীরিক গঠন, শক্তিমত্তা-এসব বিবেচনা করলে এত বেশি উচ্ছসিত হওয়া যায় না৷ তারপরও আমি আশা রাখি, যে গ্রুপটা এখন আছে আর পাইপলাইনে যে মেয়েরা আছে, তাদের নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে না পারলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজত্বটা যেন আরও কিছু দিন থাকে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ