বিজ্ঞানীরা বহু দশক ধরে খোঁজ চালাচ্ছেন এমন জগতের, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব৷ শুধু মঙ্গলগ্রহ নয়, তাঁরা নজর রাখছেন মহাকাশের গভীরেও৷ কিন্তু সমুদ্র সৈকতে বালুকণা খোঁজার মতো কঠিন সেই কাজ৷
বিজ্ঞাপন
টেলিভিশনের পর্দায় এমন দৃশ্য আমরা সবাই দেখেছি৷ মহাকাশে নীল মরুদ্যানের মতো শোভা পাচ্ছে পৃথিবী৷ তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, ‘‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র পৃথিবীতেই কি প্রাণের স্পন্দন রয়েছে? নাকি অন্য কোথাও প্রাণের বিকাশ সম্ভব?'' এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গত কয়েক বছরে গবেষণা অনেক বেড়ে গেছে৷
জার্মানির পটসডাম শহরের বিজ্ঞানীরা সদ্য আবিষ্কৃত বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু পরীক্ষা করেন৷ তাঁরা জানতে চান, দূরের এই জগত প্রাণের বিকাশের জন্য কতটা উপযুক্ত? পৃথিবীর সঙ্গে মিল আছে, এমন গ্রহ খোঁজা কেন এত কঠিন? গ্রহ গবেষক ভ্যার্নার ফন ব্লো বলেন, ‘‘এক্সট্রা-সোলার গ্রহ খোঁজার সমস্যা হলো, নক্ষত্রের আলো সংলগ্ন গ্রহের আলোকে পুরোপুরি ম্লান করে দেয়৷ রাতের আকাশে শুধু নক্ষত্রগুলি দেখা যায়, তাদের আশেপাশে গ্রহ থাকলেও সেগুলি দেখা যায় না৷''
পৃথিবীর মতো ছোটো আকারের পাথুরে গ্রহ দেখা যায় একমাত্র মহাকাশ থেকেই, যখন তারা তাদের সূর্যের আলোকে ঢেকে ফেলে৷ তাই মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা কেপলার স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠিয়েছিলেন৷ কেপলার স্যাটেলাইটে দেড় মিটার বড় টেলিস্কোপ ছিল৷ এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল প্রাণের বিকাশের উপযুক্ত গ্রহের সন্ধান করা৷ কোনো গ্রহ তার সূর্যের পাশ দিয়ে যাবার সময় আলো ঢাকা পড়ে যায়৷ অর্থাৎ নক্ষত্রের আলোয় সামান্য তারতম্য ঘটলেই স্যাটেলাইটকে তা টের পেতে হবে৷ তখনই গ্রহ আবিষ্কার করা যায়৷ যেমন আমাদের এই পৃথিবী সূর্য প্রদক্ষিণ করার সময় যে ছায়া সৃষ্টি করে, তার মাত্রা সূর্যের আলোর দশ হাজার গুণেরও কম৷ আরেকটি সমস্যা হলো, নক্ষত্রের উপর গ্রহের ছায়া পড়ার ঘটনা খুবই বিরল৷
তাই কেপলার স্যাটেলাইট মহাকাশের একটা বড় অংশের উপর নজর রেখেছিল৷ সিগনাস নক্ষত্রপুঞ্জের আশেপাশে প্রায় দেড় লক্ষ নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল টেলিস্কোপ৷ স্যাটেলাইটকে এমন অবস্থান বজায় রাখতে হয়েছে, যাতে প্রত্যেকটি নক্ষত্র ডিটেক্টরে সরে না যায়৷
যেখানে মঙ্গলগ্রহের চেয়েও বেশি শীত
যুক্তরাষ্ট্র আর ক্যানাডার একটা অংশে পড়েছিল মঙ্গলগ্রহের চেয়েও বেশি শীত৷ শৈত্যপ্রবাহ এবং তুষার ঝড়ে জনজীবন বিপন্ন৷ ডয়চে ভেলের ইংরেজি বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়ার অনুসারীদের পাঠানো ছবিতে দেখুন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকার জনজীবন৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/M. Fortner
বরফ ঢাকা শহরের পথে ভেঙে পড়া গাছ
যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা রাজ্যে জর্ডান শহরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে নেমে গিয়েছিল৷ এমন শীতে মানুষের কষ্ট কী পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে তা কল্পনা করা কঠিন নয়৷ এ ছবিটি মাইকেল অ্যালডেন পাঠান মাইন রাজ্যের লুসার্ন থেকে৷ বিদ্যুৎ ছিল না, প্রচণ্ড ঝড়ে গাছপালা ভেঙে পড়ছিল৷ অ্যালডেনের ছবিতে অবশ্য বিরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্যই ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Michael Alden
প্রকৃতি কখন সদয় হবে!
ইন্ডিয়ানার সাউথ বেন্ড থেকে এ ছবি পাঠিয়ে কারস্টেন হাইভোনেন লিখেছেন, ‘‘আমাদের এখানে ১৩ ইঞ্চি পুরু বরফ জমেছে৷ তাপমাত্রা নেমে গেছে মাইনাস ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে৷ এমন শীতে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়৷ আবহাওয়া কখন উষ্ণ হবে, কখন রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা হবে – আমরা এখন তারই অপেক্ষায় আছি৷ বাচ্চারা দু’দিন ধরে স্কুলে যেতে পারছে না, আগামী কালও বোধহয় যেতে পারবে না৷’’
ছবি: Kristen Hyvonen Amsler
জুরি আছে আনন্দে
কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ৷ শীতে মানুষ কষ্টে মরছে আর পাহাড়ি কুকুর জুরির এ সময়েই মহা আনন্দ৷ তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নামলে ও বরফের বুকে খেলতে চায়, চায় কেউ ওর সঙ্গে থাকুক, ওর সঙ্গে আনন্দ করুক৷ ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের শ্যাম্পেইন থেকে জুরির এই ছবি পাঠিয়ে এরিন কিরবি জানতে চেয়েছেন, ‘‘এমন শীতের মধ্যে কে ওর সঙ্গে খেলবে!’’
ছবি: Erin Kirby
বরফের সঙ্গে যুদ্ধ
মিশিগানের মেরিল থেকে এ ছবি পাঠিয়েছেন জুলিয়েট জাভার্স৷ শহরের পথ-ঘাট ঢেকে গেছে বরফে৷ চলছে বরফ সরিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করার চেষ্টা৷
ছবি: Juliette Zavarce
বরফের বাগান
যুক্তরাষ্ট্রের মইনেস থেকে ছবিটি পাঠিয়েছেন মারিয়ানা লিঙ্ক-আলেকজান্ডার৷ আইওয়া অঙ্গরাজ্যে এ শহরটির বর্তমান অবস্থা জানাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘ওয়েস্ট ডেস মইনেসে আমার বাড়ির সামনের বাগান৷ গতরাতে এখানে তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রিতে নেমে যায়, শৈত্যপ্রবাহের ঠান্ডা তো মাইনাস ৪০-এরও নীচে৷’’ এমন শীতে মারিয়ানার বাগানটা কিন্তু অন্য রূপে সেজেছিল৷
ছবি: Marianne Link-Alexander
অপরূপ প্রকৃতি
দুঃসময়েও কখনো কখনো মানুষ আনন্দ খুঁজে নেয়৷ মিশিগানের মেরিলে আলিরিও জাভার্স শীতের অত্যাচারে কাবু হতে চান না৷ তাই তিনি ব্যালকনি থেকেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন বরফে ঢাকা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে৷
ছবি: Juliette Zavarce
জলপ্রপাত এখন বরফসমুদ্র
শন ও’কনর থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োতে, চ্যাগরিন জলপ্রপাতের কাছে৷ এই শীতে সব জল জমে বরফ৷ মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পানি বরফ না হয়ে থাকে কী করে!
ছবি: Shawn O'Conner
বরফ ঝরায় ঘাম
মাইনাস ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ইন্ডিয়ানার হান্টিংটন শহরও বরফে বরফে সয়লাব৷ এ ছবির প্রেরক বরফ সরানোর যন্ত্র নিয়েই নেমেছিলেন কাজে৷ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য পথ করতে পাক্কা দু’ঘণ্টা খাটতে হয়েছে তাঁকে৷ যুক্তরাজ্য সরকার এমনি এমনিই তো আর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া বাকি সবার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি!
ছবি: Dan Herber
বরফাচ্ছাদিত
মাইনের পোর্টল্যান্ড থেকে জেমস কোলবাথের পাঠানো ছবি৷ দেখুন, বাড়ি এবং বাড়ির আশপাশ কত উঁচু বরফে ঢাকা৷
ছবি: James Colbath
খেটে মরা
মিশিগান থেকে এ ছবি পাঠিয়েছেন রন সোন৷ বাড়িতে তখন শুধু তাঁর ছোট ছেলেটিই ছিল৷ কাজ সেরে একে একে সবাই বাড়ি ফিরছে৷ বরফ সরিয়ে সেই ছেলেকে প্রথমে তাঁর দাদির জন্য, তারপর বাবা-মায়ের বাড়ি ফেরার পথ করে দিতে হয়েছে৷ পরে আরো একবার বরফ সরিয়ে গাড়ি আসার পথ করতে হয়েছিল তাঁকে৷ মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সাত ইঞ্চি পুরু বরফ তিনবার সরানোর পর শরীর আর চলছিল না৷
ছবি: Ron Sohn
10 ছবি1 | 10
একমাত্র এভাবেই কেপলার গ্রহের ছায়ার কারণে আলোর সামান্য তারতম্য টের পেয়েছে৷ দূরের এই সব গ্রহে প্রাণের স্পন্দন সম্ভব কিনা, তা দেখার কাজ গবেষকদের৷ এটা অনেকটা নির্ভর করছে নক্ষত্র থেকে গ্রহের দূরত্বের উপর৷ পৃথিবীর মতো সেই গ্রহেও তরলকে তরল থাকতে থাকতে হবে, বাষ্প বা বরফ হয়ে গেলে চলবে না৷ ভ্যার্নার ফন ব্লো বলেন, ‘‘তরল পানি বা জল প্রাণের স্পন্দনের পূর্বশর্ত, যেমনটা পৃথিবীতে ঘটেছিল৷ অন্য কোনো গ্রহের তাপমাত্রা যতি আনুমানিক শূন্য থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ঘোরাফেরা করে, তখন সেখানে তরল জল থাকা সম্ভব৷ এমন পরিবেশে প্রাণের বিকাশ ঘটা সম্ভব৷''
কিন্তু কেপলার আর দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধান করতে পারেনি৷ কারণ গত বছরের আগস্ট মাসে স্যাটেলাইটের দুটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে গেছে৷ চোখ ঘোরানোর ক্ষমতা ছাড়া ফোকাস করা সম্ভব নয়৷ অথচ ঠিক তার আগেই অভিযানের সময়কাল আরও ৩ বছর বাড়ানো হয়েছিল৷ কেপলার মোট ১৩৫টি নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছে৷ সবচেয়ে ছোট গ্রহটি আমাদের চাঁদের চেয়ে সামান্য বড়৷
সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার ছিল প্রায় আমাদের মতোই একটি সৌরজগত৷ সেই নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীর মতো দুটি গ্রহ৷ এমন আদর্শ ‘এক্সোপ্ল্যানেট' আর পাওয়া যায়নি৷ তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন আরও গ্রহের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনুমান করা হয়৷ ভ্যার্নার ফন ব্লো বলেন, ‘‘কেপলারের আবিষ্কার থেকে মোটামুটি অনুমান করা যায়, মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে সম্ভবত ৫,০০০ কোটি গ্রহ রয়েছে৷ তার মধ্যে ৫০ কোটি গ্রহে প্রাণের বিকাশ সম্ভব৷''
তবে এই সব গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর মিল কতটা বা সেখানে প্রাণ আছে কিনা, ভবিষ্যতের অভিযানগুলিতে তা জানার চেষ্টা চালানো হবে৷