পুলিশে জনবল বাড়ে, আধুনিক প্রযুক্তি যোগ হয়। কিন্তু অপরাধ কমেনা। উল্টো বাড়ে । তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরাধের নতুন ধরন। আর এই সময়ে পুলিশের মাথা ব্যথা হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সমাজে অস্থিরতা যেমন এর একটি কারণ। তেমনি পুলিশ এখন অপরাধ দমন ছাড়াও আরো অনেক কাজে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। এর বাইরে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও বড় একটি কারণ বলে তারা মনে করছেন।
গত বছর সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে মোট মামলা হয়েছে এক লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৬টি। আগের বছর মামলা হয়েছিল দুই লাখের বেশি। আর ২০২১ সালে এক লাখ ৯৭ হাজারের বেশি।
'গোয়েন্দাবিভাগ এখন দোকান হয়ে গেছে'
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশে তিন হাজার ২৮টি হত্যা ও পাঁচ হাজার ২০২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে আটটির বেশি হত্যা এবং ১৪টির বেশি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর ওই বছর নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৩৭টি। প্রতিদিন ৩০টির বেশি নারী নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে পুলিশের কাছে।
২০২১ সালে ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৯৭১টি। সেখানে ২০২২ সালে এক হাজার ১২৮টি এবং ২০২৩ সালে এক হাজার ৩৮৪ টি ডাকাতির ঘটনা পুলিশ রেকর্ড করেছে।
২০২২ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ৪৬৩টি আর ২০২৩ সালে ৪৬৬টি।
২০২৩ সালে চোরাচালানের মামলা হয়েছে দুই হাজার ৫০০টি আর ২০২২ সালে মামলা ২১৪ টি কম ছিলো। মোট মামলার সংখ্যা ছিলো দুই হাজার ২৪৬টি।
২০২৩ সালে এককভাবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। এ বছর সারা দেশে মাদকসংক্রান্ত মামলা করা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪১৮টি। আগের বছর এ আইনে মামলা হয় ৮২ হাজার ৬৭২টি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন বলেন," বছরের পরিসংখ্যান আসলে আপস অ্যান্ড ডাউন হয়। কখনো বাড়ে, কখনো কমে। তবে পরিসংখ্যানের চেয়ে বড় ব্যাপার হলো পারসেপশন। মানুষ কী মনে করে। মানুষ আগের চেয়ে অনিরাপদ বোধ করেনা। নিরাপদ বোধ না করলেও তারা যে খুব খারাপ মনে করে এই ধরনের তথ্য কিন্তু আমাদের কাছে নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন," অপরাধ নিয়ে যখন বাণিজ্য হয় তখন আপনি পুলিশে জনবল বাড়িয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা কমাতে পারবেন না। এখানে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু সদস্যের যোগাযোগের অভিযোগ আছে। আবার পুলিশ নিজেও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।”
তার কথায়," পুলিশ আবার আইন শৃঙ্খলা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে রাজনীতি, ব্যক্তি এসব বিষয়কেও প্রাধান্য দেয়। যেখানে অর্থের যোগাযোগ আছে সেখানে এখন অপরাধ বেশি। আর এই অর্থেও দ্বারাও কোনো কোনো পুলিশ সদস্য নিয়ন্ত্রিত হয়।”
পুলিশের সাবেক ডিঅজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন," পুলিশের দক্ষতার চেয়েও বড় সমস্যা হলো এখন মনিটরিং-এর অভাব। এখানে অধস্তনরা কী করেন উপরের কর্মকর্তরা তার খোঁজ রাখেন না। এসপি সাহেবরা তো এখন বাইরে বের হতে যেন লজ্জা পান। হাইওয়েতে ডাকাতি হয় পুলিশ তার ডিউটিতে থাকেনা। এখন পুলিশের সম্পর্ক হয়ে গেছে বিত্তের সঙ্গে।”
তিনি জানান," আমাদের লোকজনও তো নানা সহায়তা নিতে থানায় যান। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা হওয়ায় আমাদের কাছে আসলে আমরাও থানায় পাঠাই। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। ডিবি(গোয়েন্দা বিভাগ) তো এখন পুরাই দোকান হয়ে গেছে।”
আর আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক , মানবাধিকার কর্মী ফারুক ফয়সাল বলেন," পুলিশ তো আর পুলিশের কাজে নাই। সে তো এখন অন্য কাজে ব্যস্ত। ফলে অপরাধ কমছেনা।”
তার মতে," সমাজে রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের অস্থিরতা বাড়ছে। ফলে অপরাধও বাড়ছে। আর বিচারহীনতার কারণে অপরাধীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে।”
'আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে অপরাধীরা'
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব মনে করেন," পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়। তারা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। তারা আগেই অপরাধী চক্রকে চিহ্নত করে অপরাধ কখনো কখনো থামিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে।”
তার কথায়," এই সময়ে অপরাধ বাড়ার পিছনে কিশোর গ্যাং এবং মাদকের একটা বড় ভূমিকা আছে। সেক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের একটা বড় দায়িত্ব আছে।”
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন বলেন," আমরা এই সময়ে কিশোর গ্যাং নিয়ে নানা কাজ করছি। তাদের কারণে অপরাধ বাড়ছে। আমরা তাদের আইনের আওতায় আনা ছাড়াও সামাজিক সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করছি। আর আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও অপরাধীরাও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ করছে।”
তার কথায়," নাগরিকদের দায়িত্ব আছে। তারা যেন তাদের জানা অপরাধের খবর আমাদের জানান। কোনো অপরাধ হলে ঠিক সময়ে যেন পুলিশকে জানান। ৯৯৯ নাম্বার আছে সেখানে যেন অভিযোগ করেন।”
ঢাকায় ঘরে-বাইরে সিসিটিভির ব্যবহার
ঢাকায় নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে৷ সেই সঙ্গে সব পর্যায়ে বাড়ছে সিসিটিভির ব্যবহার৷ ডিএমপি-ও রাজধানীকে সিসিটিভি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সবচেয়ে দামি সিসিটিভি
বাংলাদেশে আমদানি করা সবচেয়ে দামি সিসিটিভি এটা। দুই লাখ টাকা দামের এই সিসিটিভিতে আছে ৫ মেগাপিক্সেল আইপি ক্যামেরা। ৫ কিলোমিটার দূরের জিনিসও এই ক্যামেরায় ধরা পড়বে, পাওয়া যাবে রঙিন ছবি। তাইওয়ানের তৈরি এই সিসিটিভি আমদানি করেছে সিডনি সান ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে এই সিটিসিভির খুব বেশি চাহিদা নেই। শৌখিন মানুষরাই এটার ক্রেতা।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
‘৪ ক্যামেরার সেটআপেই মানুষের আগ্রহ বেশি’
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কম্পিউটার সিটির (আইডিবি ভবন) তৃতীয় তলায় রয়েছে ডিজিটাল পেস নামের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সত্বাধিকারী মো. সুমন। তিনি মূলত সিসিটিভির ব্যবসা করেন। জানালেন, বাংলাদেশে যে সিসিটিভি পাওয়া যায় তার অধিকাংশই চীন থেকে আসে। কিছু দামি ক্যামেরা আসে তাইওয়ান থেকে। সর্বনিম্ন ১২ হাজার টাকা থেকে কয়েক লাখ টাকার সেটআপ মেলে। তবে ৪ ক্যামেরার সেটআপেই মানুষের আগ্রহ বেশি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
মুদি দোকানেও সিসিটিভি ক্যামেরা রাখার সুবিধা
শুধু ঢাকা শহর নয়, গ্রামের মুদি দোকানেও এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সিসিটিভি। ছবিটি শেওড়াপাড়ার একটি দোকান থেকে তোলা। দোকানের মালিক আবুল কালাম আজাদ জানালেন সিসিটিভির বহুমাত্রিক সুবিধার কথা। তার মতে, কেউ কোনো মালামাল নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা যেমন দেখা যায়, অন্যদিকে তিনি দোকানে না থাকলেও কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা বা চুরি করছে কিনা সেটাও তিনি বাসায় বসে দেখতে পারেন।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
মার্কেটের নিরাপত্তায় সিসিটিভি
রাজধানী ঢাকার প্রায় সব মার্কেটেই আছে সিসিটিভি। নিরাপত্তা প্রহরীদের পাশাপাশি সিসিটিভিও থাকলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বাড়ে। ওয়াইফাই সংযোগ করা এই সিসিটিভিগুলোর অ্যাপ প্রত্যেকটি দোকানের মালিককে দেওয়া থাকে। ফলে ওই মার্কেটের দোকানদাররা বাসায় বসেও মার্কেটের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতে পারেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ তো আছেই। ছবিটি আগারগাঁওয়ের কম্পিউটার সিটি থেকে তোলা।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্লাবের নিরাপত্তায়ও সিসিটিভি
পাড়া মহল্লার ক্লাবেও নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সিসিটিভি। ক্লাবের মাঠে কারা আসছে, কারা যাচ্ছে সবকিছু দূরে বসেও মনিটরিং করতে পারছেন দায়িত্বশীলরা। রাজধানীর কল্যাণপুরে রয়েছে অনুশীল সংসদ। প্রতিদিন বিকেলে শিশুরা এই ক্লাবের মাঠে খেলাধূলা করতে যায়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিকেলে যেহেতু বাচ্চারা এখানে আসে, ফলে সিসিটিভি তাদের সচল রাখতেই হয়। ছবিটি কল্যাণপুরের অনুশীলন সংসদ থেকে তোলা।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
দোকানের নিরাপত্তায় সিসিটিভি
মিরপুর-১০ নম্বরে এক ফার্নিচারের দোকানের সামনে ও ভেতরে দেখা গেল সিটিটিভি। দোকানের কর্মচারী মনিরুল ইসলাম বললেন, ‘‘অনেক সময় মালিক দোকানে থাকেন না। কাস্টমারদের সঙ্গে আমাদের ব্যবহারের বিষয়টি তিনি সিসিটিভি দিয়ে মনিটরিং করেন। পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয় তো আছেই। বাইরের সিসিটিভিটি লাগানো মূলত রাতে যখন আমরা থাকি না, তখনকার নিরাপত্তার জন্য। মালিক বাসায় থেকেও এটা মনিটরিং করেন।’’
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নানা ধরনের সিসিটিভি
এই ছবিটিতে যে সিসিটিভিগুলো দেখা যাচ্ছে দেশে এগুলোই বেশি চলছে। সাধারণ এই সিসিটিভিতেও ৩০এফপিএস কোয়ালিটির ছবি পাওয়া যায়। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে এমন ৪টি সিসিটিভির সেট পাওয়া যায়। কেউ স্টোরেজ বেশি নিলে দাম একটু বেশি পড়ে। কিন্তু সেখানে ফুটেজ কোয়ালিটি ভালো থাকে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। এখন সাধারণ সিসিটিভিতে এসডি কোয়ালিটির ফুটেজ পাওয়া যায়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বাড়ির নিরাপত্তায় সিসিটিভি
ঢাকা শহরে সব ধরনের বাড়িতে এখন লাগানো হচ্ছে সিসিটিভি। চুরি হলে চোরের সন্ধান দিতে সিসিটিভির জুড়ি নেই। তবে অধিকাংশ বাড়িতে সিসিটিভি থাকলেও কম জায়গায় বেশি দিনের স্টোরেজ রাখার কারণে ফুটেজ কোয়ালিটির রেজোলিউশন কমিয়ে রাখে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ফুটেজে চোরের ছবি দেখা গেলেও চেহারা ঠিকমতো চেনা যায় না। দোকানিরা বলছেন, স্টোরেজ বেশি নিয়ে রেজোলিউশন বাড়িয়ে রাখতে হবে। তাহলেই চেহারা স্পষ্ট দেখা যাবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
গাছেও সিসিটিভি
বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে এখন ঢাকা শহরের গাছেও দেখা মিলছে সিসিটিভি। ছবিটি কল্যাণপুরের গার্লস স্কুল ও কলেজের প্রধান ফটকের সামনে থেকে তোলা।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
‘জনগণের সহায়তায় আমরা পুরো ঢাকা শহরকে সিসিটিভির মধ্যে আনার চেষ্টা করছি’
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, ‘‘গুলশান বনানী বারিধারা এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে যেসব সিসিটিভি লাগানো হয়েছে, সেগুলো আমাদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এভাবে সবাই যদি একটি করে কানেকশন আমাদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দেয়া হয়, তাহলে রাজধানীর ৮০ভাগ এলাকা আমাদের নেটওয়ার্কে চলে আসবে। জনগণের সহায়তায় আমরা ঢাকাকে সিসিটিভির মধ্যে আনার চেষ্টা করছি।’’
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বাহারি সব সিসিটিভি
আগারগাঁওয়ের কম্পিউটার সিটিতে পাওয়া যায় বাহারি সব সিসিটিভি। সেখানকার একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী মো. তপু শেখ দাবি করলেন, ঢাকা শহরের মধ্যে উন্নতমানের সিসিটিভি কিনতে হবে কম্পিউটার সিটিতে হবে। সারাদেশে তারা সিসিটিভি সরবরাহ করেন। রাতের বেলায়ও রঙিন ছবি ধারণ করে এমন সব সিসিটিভিও রয়েছে তাদের কাছে।