আমি দশজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁদের মধ্যে যাঁরা কোনো সংবাদের কারণে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত ভাবেন, তাঁরা বললেন, আইন৷ বাকিরা কিন্তু নৈতিকতাকেই তুলে ধরেছিলেন৷
বিজ্ঞাপন
১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক আদালতে আলোচিত এক মামলার নিষ্পত্তি হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে মামলাটি ঠুকে দেন আলবামা রাজ্যের মন্টগোমারির তিন কমিশনারের একজন সুলিভান৷ তাঁর অভিযোগ, পত্রিকাটি তাঁদের পাতায় এমন একটি বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে, যাতে তাঁর মানহানি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন৷
পূর্ণ পাতার ঐ বিজ্ঞাপনটি মূলত ছিল দক্ষিণে নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারীদের পক্ষে৷ সেখানে বলা হয়েছে যে, আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়ন করা হয়েছে৷
এতে ক্ষুব্ধ হন সুলিভান৷ তার বক্তব্য হলো যে, সেখানকার প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি৷
মামলার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস৷ তারা বলে যে, ঐ বিজ্ঞাপনের কোথাও সুলিভানের নাম পর্যন্ত নেই৷ তাহলে তিনি কেন নিজের ওপর নিচ্ছেন? এ বিষয়ে তারা কোনো সংশোধনী প্রকাশ করতেও অপারগতা জানায়৷
নিউইয়র্কের আদালত দু'পক্ষের শুনানি শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, যে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়েছে, তার পেছনে পরিষ্কার অভিসন্ধি ছিল পত্রিকাটির৷ এর কিছু অংশে মিথ্যাচার করা হয়েছে বলেও মনে করেছে আদালত৷ তাই মামলাকারীর পক্ষে রায় দেয়া হয়৷ রায়ে বাদীর পক্ষে ৫ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়৷
কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশার কথা
ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বললেই সাংবাদিকতার কথা মনে হতে পারে৷ কিন্তু এ ছাড়াও বিশ্বে এমন অনেক পেশা আছে, যেখানে একটু ভুলের কারণে জীবনটা চলে যেতে পারে৷ ছবিঘরে থাকছে তেমনই কিছু কাজের কথা৷
ছবি: AP
জানালা পরিষ্কার
নিজ বাড়ির জানালা পরিষ্কার করাটা হয়ত ঝুঁকিপূর্ণ নয়৷ কিন্তু সেটা যদি হয় উঁচু কোনো ভবনের, তাহলেই সমস্যা৷ জার্মানির মতো দেশে সুউচ্চ ভবনগুলোর বাইরের দিকটা পরিষ্কারের সময় তাই বেশ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়৷ তবুও দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চলছে৷ আর যুদ্ধ মানেই প্রাণহানি৷ তাই যুদ্ধে অংশ নেয়াটা যে-কোনো সৈন্যের জন্যই যে মারাত্মক হুমকির, তা বলাই বাহুল্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পাইলট
ছোটবেলায় হয়ত সবারই ইচ্ছা হয় বড় হয়ে পাইলট হবার৷ আকাশে একটা আস্ত বিমান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া রোমাঞ্চকরই মনে হয়৷ কিন্তু সমস্যা হলো, আকাশে বিমান দুর্ঘটনা হলে বাঁচার সম্ভাবনা শূন্যই বলা যায়৷ আর পাইলটদের ক্ষেত্রে নিজের কোনো ভুলের কারণে দুর্ঘটনা হলে নিজ জীবনের পাশাপাশি চলে যেতে পারে শত শত যাত্রীর জীবনও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দমকলকর্মী
আগুন লাগা মানেই সেখানে ছুটে যেতে হয় দমকলকর্মীদের৷ কিন্তু আগুনের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ যেতে পারে নিজেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পুলিশ
জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে প্রায়ই সন্ত্রাসীদের পেছনে ছুটতে হয়৷ তাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়৷ ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনাতো থেকেই যায়৷ এছাড়া দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে সন্ত্রাসী কিংবা মাস্তানদের ধাওয়া করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে – অবাক হওয়ার কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আর বলে কয়ে আসে না৷ তাই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সময় কখন যে সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আগে থেকেই অনেক কিছু জানা সম্ভব৷ তবে এরপরও ঝুঁকি তো থেকেই যায়৷
ছবি: picture alliance/landov
বাড়ির ছাদ ঠিক করা
বাংলাদেশে টিনের বাড়ি দেখতে যেমন হয় জার্মানির অনেক বাড়িও সেরকম৷ শুধু পার্থক্য হচ্ছে, টিনের পরিবর্তে জার্মানিতে ‘টাইলস’ বসানো হয়৷ আর সেই কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে৷ তাই এই কাজ শুরুর আগে একটা জীবন বিমা করাটা অতি আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গাছ কাটা
জার্মানিতে গাছ কাটতে যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, সেটা যদি কোনোভাবে শরীরের সংস্পর্শে চলে আসে তাহলেই শেষ! ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা৷ আর যে গাছ কাটা হচ্ছে সেটা কোনদিকে হেলে পড়তে পারে সেটা বুঝতে অনেকসময় ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
এই রায়টি খুব আলোচিত হয়৷ রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে এখনো যুক্তিতর্ক চলে৷ তবে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেটি অনেক জায়গাতেই রেফারেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ কোনো গণমাধ্যম যদি কোনো মিথ্যা তথ্য পরিষ্কার কোনো অভিসন্ধি থেকে প্রকাশ করে, এবং এতে যদি কারও মানহানি হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মনে করেন, তাহলে তিনি মামলা করতে পারেন৷
কারণ, বেশিরভাগ দেশে যেমন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতার পক্ষে আইন আছে, তেমনি একজন নাগরিকেরও নিজস্ব সম্মান ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বজায় রাখার অধিকার আছে৷
এই রায় এবং পরবর্তীতে অনেক রায়েই যে বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়েছে, তা হলো, সংবাদ প্রকাশের নৈতিকতা এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোপনীয়তা বজায় রাখতে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা৷
দু'টি বিষয়কে অনেক ক্ষেত্রেই ‘অজান্তে বা জেনে শুনে' গুলিয়ে ফেলা হয়৷ ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের আইনি সুরক্ষার নামে সংবাদ মাধ্যম বা বাক স্বাধীনতার ওপর অবাধ হস্তক্ষেপের উদাহরণ বিশ্বজুড়ে আছে৷ বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়৷
সেরা ১১ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
পুলিৎজার পুরস্কারকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার বলে ধারণা করা হয়৷ গত ১১ বছরে কারা পেয়েছেন এ পুরস্কার জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Heidi Levine
২০০৬ সাল
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’-র সাংবাদিক সুজান স্মিড, জেমস ভি গ্রিমাল্ডি এবং আর. জেফরি স্মিথ সে বছর পেয়েছিলেন এই পুরস্কার৷ সংস্কারের নামে মার্কিন কংগ্রেসে ওয়াশিংটন লবিস্ট জ্যাক আব্রামোফের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷
ছবি: AP
২০০৭ সাল
‘দ্য বার্মিংহ্যাম নিউজ’-এর ব্রেট ব্ল্যাকলেজ পেয়েছিলেন এই পুরস্কার৷ একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দেন তিনি৷ যার ফলে ঐ চ্যান্সেলরকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০০৮ সাল
এ বছর দু’টি পত্রিকা এ পুরস্কার পায়৷ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার ওয়াল্ট বোগদানিচ এবং জেক হুকার পেয়েছিলেন এ পুরস্কার৷ চীন থেকে আমদানিকৃত ওষুধ ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷ এছাড়া ‘শিকাগো ট্রিবিউন’-এর এক প্রতিনিধি জিতেছিলেন এই পুরস্কার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০৯ সাল
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর ডেভিড বার্সতো পেয়েছিলেন এ পুরস্কার৷ কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রেডিও ও টেলিভিশনে বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পেন্টাগনের সমর্থনে ইরাক যুদ্ধকে প্রভাবিত করছে৷ তাদের এসব বক্তব্যের কারণে কত কোম্পানি সুবিধাভোগ করছে তাও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Emmert
২০১০ সাল
‘দ্য ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ’-এর বারবারা ল্যাকার ও ওয়েনডি রুডারম্যান এবং ‘নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন’-এর প্র-পাবলিকার শেরি ফিঙ্ক যৌথভাবে এ পুরস্কার জিতেছিলেন৷ একটি অসৎ পুলিশ দলের মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি উদঘাটন করেন ল্যাকার ও রুডারম্যান৷ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ হয়েছিল৷ ফিঙ্ক ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা আঘাত হানার পর রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Ngan
২০১১ সাল
‘সারাসোতা হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর পেইজি সেন্ট জন সে বছর পুলিৎজার পেয়েছিলেন৷ ফ্লোরিডার বাড়ি মালিকদের সম্পদের ইনস্যুরেন্সে দুর্বলতা সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তাঁকে এ পুরস্কার এনে দিয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১২ সাল
‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর ম্যাট অ্যাপুৎসো, অ্যাডাম গোল্ডম্যান, এইলিন সুলিভান এবং ক্রিস হাওলি সে বছর এই পুরস্কার জিতেছিলেন৷ নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ‘ক্ল্যানডেস্টাইন গুপ্তচর কর্মসূচি’র আওতায় শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রতি নজর রাখা হচ্ছিল, যা প্রকাশ পায় এপি-র ঐ প্রতিবেদনে৷ প্রতিবেদন প্রকাশের পর কংগ্রেস থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত দাবি করা হয়৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১৩ সাল
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর ডেভিড বার্সতো এবং আলেহান্দ্রা ইয়ানিক ফন বেরত্রাব এই বছর পুরস্কারটি পান৷ মেক্সিকোতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কীভাবে ওয়াল-মার্ট ঘুষ দেয়, সেটা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷
ছবি: AP
২০১৪ সাল
ওয়াশিংটর ডিসির ‘দ্য সেন্টার ফর পাবলিক ইনটিগ্রিটি’-র ক্রিস হামবি জেতেন এই পুরস্কার৷ কয়লা খনির শ্রমিকদের ফুসফুসের রোগ নিয়ে কয়েকজন আইনজীবী ও চিকিৎসকের প্রতারণার চিত্র তুলে ধরেছিলেন তার প্রতিবেদনে৷ যার ফলে ঐ আইনজীবী ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১৫ সাল
এ বছর দুইজন জিতেছেন এই পুরস্কার৷ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর এরিক লিপটন কংগ্রেস নেতা ও অ্যাটর্নি জেনারেলদের লবিস্টরা তাদের কতটা প্রভাবিত করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর এক প্রতিনিধির স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের জন্য৷
ছবি: Imago/Rüdiger Wölk
২০১৬ সাল
চলতি বছরে ‘ট্যাম্পা বে টাইমস’-এর লিওনোরা লাপিটার ও অ্যান্থনি কর্মিয়ার এবং ‘দ্য সারাসোতা হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর মাইকেল ব্রাগা জিতেছেন এই পুরস্কার৷ ফ্লোরিডা মানসিক হাসপাতালের অবহেলার অমানবিক চিত্র ফুটে উঠেছিল তাদের প্রতিবেদনে৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
11 ছবি1 | 11
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত গণমাধ্যম জনগণের স্বার্থ সুরক্ষা, সুশাসন ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে ভুমিকা রেখেছে এবং এখনো রেখে যাচ্ছে৷সেক্ষেত্রে এর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে বড় রকমের প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ বলেও মনে করা হয়৷ তবে একইসঙ্গে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীলতার পরিচয়ও দিতে হয়৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংবাদমাধ্যমকে ব্যাপকভাবে প্রপাগান্ডার মেশিন হিসেবে ব্যবহার করার পর ‘টাইম' ও ‘লাইফ' ম্যাগাজিনের প্রকাশক হেনরি লুস একটি গণতান্ত্রিক দেশে মিডিয়ার ভুমিকা কী হওয়া উচিত তা ঠিক করতে একটি কমিশন গঠন করার জন্য শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রেডিডেন্ট রবার্ট হাচিন্সকে অনুরোধ করেন৷
প্রচণ্ড সমালোচনার মুখেও ১২জন বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে কমিশনটি গঠন করেন, যেখানে কোনো সাংবাদিক ছিলেন না৷ এই কমিশন পরিচিত ‘হাচিন্স কমিশন' নামে৷ ১৯৪৭ সালে সেই কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সমাজ গঠনে গণমাধ্যমের ভুমিকা অনস্বীকার্য৷ তাই সংবাদ মাধ্যমকেও ‘সামাজিক দায়িত্ব' নিয়ে কাজ করতে হবে৷
কমিশন তিনটি ভাগে তাদের সুপারিশ দেয়৷ প্রথমত, সরকারের কী দায়িত্ব হবে? কমিশন মনে করে যে, সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে৷ গণমাধ্যমকে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে দিতে হবে৷ তবে কোনো গণমাধ্যম যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার বা আইন তাদের ব্যবস্থা নেবে, যদিও একে সর্বশেষ ধাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷
দ্বিতীয়ত, তারা বলছে, গণমাধ্যম যদি নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নেয়, তাহলে সরকারকে যতটুকু ভুমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে, সেই সুযোগ আরো কমে যায়৷ সেক্ষেত্রে নিজেদের সমালোচনা নিজেরাই করে এক ধরনের সুস্থ সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব নিতে হবে৷
তৃতীয়ত, তাঁরা জনগণকেও দায়িত্ব নেয়ার সুপারিশ করেছেন৷ তাঁরা বলেন, জনগণ পত্রিকা কিনবেন৷ তাই তাদের হাতেই ক্ষমতা কাকে তারা গ্রহণ করবেন বা কাকে বর্জন করবেন৷ তাই তারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷
পরবর্তীতে অনেক তাত্ত্বিকই এই সুপারিশ গ্রহণ করেছেন৷ তাঁরা বলেছেন, যদিও যুগ যুগ ধরে ‘কোড অব এথিক্স' আছে গণমাধ্যমের, তারপরও কমিশনের সুপারিশগুলো খুবই প্রয়োজনীয়৷
তবে এর সমালোচকরা বলেছেন, যে সামাজিক দায়িত্বশীলতার কথা বলা হয়েছে, এর অর্থ এক ধরনের দায়বদ্ধতা, দায়বদ্ধতা যতটা জনগণের প্রতি তার চেয়েও বেশি রাষ্ট্রের প্রতি৷ আর রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়বদ্ধতা, তা পালিত না হলে আইনের খড়গ নেমে আসবে৷
এত দশক আগে যেসব বিতর্ক বা আলোচনার সমাধান খোঁজা হয়েছে, এখনো কি সেই সমাধান পাওয়া গেছে? যদি তাই হতো, এখনও সংবাদ মাধ্যম কী প্রকাশ করতে পারবে বা কী পারবে না, সেসব নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই৷
তাই আজও সাংবাদিকতার পাঠে মিডিয়া এথিক্স বা নৈতিকতা ও মিডিয়া ল' বা আইন খুব গুরুত্বের সাথে রাখা হয়৷
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন এখনো পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলে
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন তৈরি হয়েছে, এবং এখনো বলবৎ আছে, তাতে কী বলা হয়েছে৷ ছবিঘরে জেনে নিন কিছু আশ্চর্য আইনের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার কয়েকটি কিছুটা সংশোধিত আকারে আজও রয়ে গেছে৷ যেমন: ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩৷ এ আইন অনুযায়ী, যে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের আগে জেলার ডেপুটি কমিশনারের লিখিত অনুমোদন লাগবে৷ এটি ১৮২৩ সালে ভারতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গর্ভনর জেনারেল জন অ্যাডামের অধ্যাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দণ্ডবিধি ১৮৬০
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ‘১২৪ ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে, তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এটি একেবারেই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন৷ একই আইনের ‘৫০৫ খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো প্রতিবেদন বা বিবৃতি যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাকে ৭ বছর কারাভোগ করতে হবে৷ একইভাবে মানহানির জন্য ৪৯৯ এবং ৫০১ অনুচ্ছেদে শাস্তির বিধান রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪
বাংলাদেশের অবাধ তথ্যের প্রবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন বা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪৷ প্রথমটিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা যেতে পারে এমন কোনো বিষয় কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় আইনে রাষ্ট্রের চোখে অনিষ্টকর কোনো তথ্য গণমাধ্যমে কেউ প্রকাশ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে৷ অথচ ৩৯(২)-এ এই স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই’ নিশ্চিত হবে বলা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে অথবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে এই বাধা-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Jaspersen
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা
২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে কোনো ব্যক্তি যদি ইন্টারনেটে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা কারো মানহানি ঘটে, কিংবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, বা এ ধরনের তথ্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে দেয়া হয়, তাহলে এটি অপরাধ এবং সেই অপরাধে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: Schlierner - Fotolia.com
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা
এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ৷
ছবি: Badruddoza Babu
৩২ ধারায় শাস্তি
এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে৷ কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে৷
ছবি: Imago/IPON
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯
এই আইনটি বাক স্বাধীনতার পক্ষে৷ বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’’ আরো বলা হয়েছে, ‘‘তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Dinodia Photo Library
8 ছবি1 | 8
তবে তাই বলে যে, বিষয়গুলো এখনো একই তিমিরে রয়ে গেছে, তা নয়৷ অনেক বদলেছে৷ সংবাদ প্রচারের মাধ্যম প্রসারিত হয়েছে৷ সেই সঙ্গে আইন বদলেছে৷ সাংবাদিকতার প্র্যাকটিস বদলেছে৷ তাই অনেক সমস্যার ধরণও বদলেছে৷ তাই এই বিবাদ একটি চলমান প্রক্রিয়া৷
কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তাকালে বৈশ্বিক সাংবাদিকতার যে মান, সেখানে এখনো যেতে সময় লাগবে৷ একটি ছোট উদাহরণ দিই৷
খুব দূরে নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন৷ সেখানকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশ থেকে উন্নত নয়৷ তবে সেখানে বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে একটি আলাদা বিভাগ চালু আছে৷ সেটি হলো, এথিক্স ডিপার্টমেন্ট৷
প্রতিষ্ঠানটির খবর সংগ্রহ থেকে ছাপানো পর্যন্ত একটি এথিকাল গাইডলাইন আছে৷ সংবাদকর্মীদের জন্য আলাদা গাইডলাইন আছে৷ সেই গাইডলাইন কেউ ভঙ্গ করছেন কি না তা দেখার জন্য এই ডিপার্টমেন্ট, যার প্রধান সরাসরি প্রধান সম্পাদকের কাছে দায়বদ্ধ৷
বাংলাদেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই এমন করতে পারে৷ কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বিভাগ তো দূরের কথা, কোনো এথিকাল গাইডলাইনই নেই৷ হয়তো অচিরেই কেউ চিন্তা করবেন এমন কিছুর৷ সেই প্রত্যাশা থাকলো৷
তবে কোনোভাবেই আইন দিয়ে সাংবাদিকতা বা বাকস্বাধীনতা রুখে দেয়া মেনে নেয়া যাবে না৷ কারণ, এখনকার বিশ্বে সংবাদ প্রকাশের ধরন অনেক পাল্টেছে৷ উইকিলিক্স থেকে পানামা পেপার্স– এগুলোই উদাহরণ৷ সাংবাদিকতার গণ্ডি আর দেশে সীমাবদ্ধ নেই৷ এখন কোলাবোরেশনের যুগ৷ সেই সুযোগ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত৷