রাজনৈতিক চিত্রনাট্য অনুযায়ী দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি শাসনই হবার কথা ছিল, অর্থাৎ ব-কলমে কেন্দ্রের অধীনে৷ ৪৯-দিনের শাসনে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বোধোদয় হলো, স্বপ্ন দেখানো আর তাকে সাকার করা এক জিনিস নয়৷
বিজ্ঞাপন
চিত্রনাট্যটা বোধহয় আগে থেকেই সাজানোই ছিল৷ শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ দিল্লি উপ-রাজ্যপাল নাজিব জং বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে দিল্লি বিধানসভা ভেঙে দিলেন না৷ তাকে জিইয়ে রেখে রাষ্ট্রপতির শাসন বলবৎ করতে চাইলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয় এবং রাষ্ট্রপতির কাছে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়৷ তারপর জারি হয় রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তি৷
রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ছয় মাসের মধ্যে নতুন করে ভোট নিতে হয়৷ দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন আলাদাভাবে না করে সংসদীয় নির্বাচনের সঙ্গেই করা হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশনের সূত্রে জানা গেছে৷ একক বৃহত্তম দল বিজেপিকে সুযোগ দিলেও সরকার গঠনে বিজেপির অনীহার কারণ তাদের হাতে সরকার গঠনের ম্যাজিক সংখ্যা নেই৷ দ্বিতীয়ত বিজেপি পাখির চোখ এখন দিল্লির মসনদ৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ভাইরাস যেভাবে বাসা বেঁধেছে, তা যে প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার পথে গিয়ে নরমে-গরমে-চমকে-ধমকে কোনোভাবেই ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক সিস্টেমে কাজ করবে না, এটা বুঝেই সরকার চালানোর হাত থেকে রেহাই পেতে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল ‘‘আমি তোমাদেরই লোক'' বলে পালাবার পথ খুঁজছিলেন৷ পেয়ে গেলেন মোক্ষম জনপ্রিয় হাতিয়ার দুর্নীতি-বিরোধী জন লোকপাল বিল৷ স্বপ্ন দেখানো যায়, কিন্তু পথনাটিকার অবতারণা করে কিংবা মধ্যরাতে দিল্লির আফ্রিকান মহিলাদের বাড়ি হানা দিয়ে বা খোলা আকাশের নীচে ফুটপাতে দিল্লির কনকনে ঠান্ডায় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে প্রতিবাদ বা ধরনা দেয়া যায়, তাতে স্বপ্ন সাকার হয় না৷ এর জন্য দরকার রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা আর ধীরস্থির প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে কূটবুদ্ধি৷
জন লোকপাল বিল পাশ করা যে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা, সেটা তো অজানা ছিল না৷ অজানা ছিল না সংখ্যালঘু সরকার হয়ে একা জন লোকপাল বিল এনে গ্যাসের দাম নিয়ে আম্বানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়৷ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের মনে আশা জাগিয়ে কেজরিওয়ালের এই বিস্ময়কর উত্থান যেন হাউই-এর মত উঠে নিভে গেল৷ এতে মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশের মোহভঙ্গ হয়েছে সন্দেহ নেই৷ তাহলে কেন কেজরিওয়াল তাড়াহুড়ো করে নেপথ্যে সহযোগী দল কংগ্রেসের সঙ্গে এবং বিরোধী দলের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় না এসে, বলা বাহুল্য নিজের ঘর না সামলে, তাড়াহুড়ো করে বিল পেশ করার ঝুঁকি নিতে গেলেন? আম নাগরিকদের এটাই প্রশ্ন৷ অবিমৃশ্যকারিতা রাজনীতিতে চলে না৷
এখন কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক লক্ষ্য কী? অবশ্যই ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে উঠে আসা৷ প্রস্তুতি হিসেবে দলের প্রথম প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ কেজরিওয়াল নিজের প্রার্থীপদ নিয়ে একটা ধোঁয়াশা রেখেছেন৷ তবে জানিয়েছেন, সরকার গঠন করতে না পারলেও জাতীয় সংসদে সরকারের ‘‘ওয়াচ-ডগ'' হয়ে কাজ করতে পারবে৷ দুর্নীতিবাজ, পরিবারতন্ত্র এবং অপরাধীরা যাতে সংসদে পৌঁছতে না পারে, তার জন্য আম আদমি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে৷ পরোক্ষভাবে কংগ্রেস এবং বিজেপির ভোট ভাগ হবে৷ জাতীয় নির্বাচনেই প্রমাণ হবে ‘‘আমি তোমাদেরই লোক'' কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি জনসমর্থন কতটা ধরে রাখতে পেরেছে৷