ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত কয়েক দিন প্রায় বিরতিহীন আলোচনা চালিয়ে পরিবর্তিত ব্রেক্সিট চুক্তির একটি খসড়া সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছেছে৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ-ক্লোদ ইয়ুংকার এই খবর জানিয়েছেন৷
কিন্তু এ যাত্রায় ইইউ আগের তুলনায় সতর্ক হয়ে উঠেছে৷ সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-ও ইইউ-র সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন৷ তা সত্ত্বেও তিন-তিনবার তিনি সংসদে তা অনুমোদন করতে ব্যর্থ হন৷ বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রিটেনের সংসদে সর্বশেষ বোঝাপড়ার লক্ষ্যে যথেষ্ট সমর্থন আদায় করতে পারবেন কিনা, তাও এখনো স্পষ্ট নয়৷ বিশেষ করে উত্তর আয়ারল্যান্ডে সরকারি জোটের শরিক দল নতুন চুক্তির বিরোধিতা করছে৷ দেশ হিসেবে ব্রিটেন এই চুক্তি মেনে নিলে তবেই ইইউ আনুষ্ঠানিকভাবে এই সমঝোতা মেনে নিতে প্রস্তুত৷ তবে কিছু সূত্র অনুযায়ী, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কয়েকটি বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয় নি৷ ইউরোপীয় সরকারগুলির পরিষদের প্রধান ডোনাল্ড টুস্ক আগেই জানিয়েছিলেন যে নীতিগতভাবে চুক্তির মৌলিক ভিত্তি প্রস্তুত হয়ে গেছে৷
এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত নেতারা ব্রেক্সিট চুক্তি স্বাক্ষর করবেন কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়৷ ব্রিটেনের সরকার এবং সংসদ চুক্তি অনুমোদন করলে চলতি মাসে আরেকটি জরুরি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে ইইউ নেতারা চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে৷ শনিবার ব্রিটিশ সংসদের বিশেষ জরুরি অধিবেশনে নতুন ব্রেক্সিট চুক্তির পক্ষে সমর্থনের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে যাবে, এমনটাই আশা করা হচ্ছে৷ তবে সব পক্ষ সম্মতি জানালেও ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট সময় আর নেই বলে ইইউ কর্মকর্তারা মনে করছেন৷ সে ক্ষেত্রে শুধু প্রক্রিয়াগত কারণে এই তারিখ কিছুকাল পিছিয়ে দেওয়া হতে পারে৷ ইউরোপীয় কমিশনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লোদ ইয়ুংকার রসিকতা করে বলেন, ‘‘সবাই ইংরিজি বোঝে, কিন্তু কেউ ইংল্যান্ডকে বোঝে না৷''
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসন আগেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন৷ ইইউ-র সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তির আওতায় উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশকে যুক্তরাজ্য থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে তিনি বিরোধী ও বিদ্রোহী পক্ষের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়বেন৷ তবে কিছু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, জনসন ইইউ-পন্থি ও কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিদের সাবধান করে দিতে পারেন৷ এই চুক্তি মেনে না নিলে তিনি প্রথম দলকে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের ভয় দেখাতে পারেন৷ দ্বিতীয় দলকে বলতে পারেন, এখনই চুক্তি মেনে না নিলে ব্রেক্সিটের স্বপ্ন পুরোপুরি বানচাল হয়ে যেতে পারে৷ নতুন নির্বাচন অথবা ব্রেক্সিটের প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোট আয়োজিত হলে ভোটাররা ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে রায় দিতে পারেন৷ উল্লেখ্য, লেবার পার্টির নেতা জেরেমি কর্বিন দ্বিতীয় গণভোটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷
ইইউ ও বরিস জনসনের সমাধানসূত্রের আওতায় উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশ কার্যত ইইউ-র শুল্ক ইউনিয়নে থেকে যেতে পারে৷ তবে পণ্যের উপর ভ্যাট কার্যকর করার বিষয়ে জটিলতা থেকে গিয়েছিল৷ ইইউ ও ব্রিটেনের ভিন্ন ভ্যাটের হারের মধ্যে সামঞ্জস্য আনা মধ্যস্থতাকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে৷ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলে চূড়ান্ত আইনের খসড়া প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ, এএফপি)