টানা ১৭ দিন গুহায় আটকে থাকা থাইল্যান্ডের কিশোর ফুটবলাররা অবশেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে৷ প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছে, না খেয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর আশঙ্কা দূরে রাখার রোমহর্ষক সেই দিনগুলোর গল্প৷
বিজ্ঞাপন
২৩ জুন থেকে ৯ জুলাই – টানা ১৭ দিন উত্তর থাইল্যান্ডের এক গুহায় আটক ছিল ‘' ফুটবল দলের ১২ জন কিশোর ফুটবলার এবং তাদের ২৫ বছর বয়সি কোচ৷ তিন দিনের ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধার অভিযান শেষ হয় ১০ জুলাই৷ শেষ হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৩টি প্রাণ বাঁচানোর মানবিক দায়িত্ব৷ ১০ জুলাই সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও অবশ্য তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ গুহা থেকে উদ্ধার করেই সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে৷ কিশোর ফুটবলারদের পরিবার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আপত্তি থাকায় গত এক সপ্তাহ সংবাদমাধ্যমও জানতে পারেনি বিভীষিকাময় ১৭টি দিনের কথা৷ মঙ্গলবার অবশেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে সারা দেশে সম্প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেয় ফুটবলাররা৷ সেই সুবাদে ওই ১৭ দিনের অজানা কথাগুলোও জানা হয়ে যায় সবার৷
‘থাইল্যান্ড মুভস ফরোয়ার্ড' নামের সরকারি এক অনুষ্ঠানের সেটটি সাজানো হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ এক ফুটবল মাঠের আদলে৷ সেখানে ফুটবল নিয়ে এসে সেই ফুটবলে লাথিদিয়েই কথা শুরু করে কিশোর ফুটবলাররা৷ নিজেদের বেঁচে থাকার গল্প শোনানোর আগে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দেয়া এক উদ্ধারকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধাও জানিয়েছে তারা৷
যেভাবে গুহা থেকে উদ্ধার হলো ফুটবল দল
থাইল্যান্ডের বন্যা কবলিত থাম লুং গুহায় আটকে যাওয়া ফুটবল দলের ১৩ জন সদস্যের উদ্ধারকাজই শেষ হয়েছে৷ তারা সবাই জীবিত আছেন, তবে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে৷ বিপজ্জনক এই উদ্ধার অভিযানের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক থাকছে এখানে৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/Chiang Rai PR office
উদ্ধার অভিযানের সফল সমাপ্তি
থাইল্যান্ডের একটি গুহায় বন্যার কারণে আটকে পড়া বারো ফুটবলার এবং তাদের কোচকে জীবিত উদ্ধার সম্ভব হয়েছে৷ মঙ্গলবার পাঁচজনকে উদ্ধার করা হয়৷ বাকিদের আগে উদ্ধার করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/Royal Thai Navy/Facebook
যেভাবে আটকা পড়ে তারা
গত ২৩ জুন গুহার মধ্যে আটকে পড়ে ১২ কিশোর ফুটবলার এবং তাদের কোচ৷ স্থানীয় ‘ওয়াইল্ড বোর্স’ ফুটবল ক্লাবের এই সদস্যরা গুহায় প্রবেশের পর হঠাৎ করে বন্যার পানি গুহাতে প্রবেশ করে এবং তাদের ফেরার পথ আটকে যায়৷ এরপর কয়েকদিন তাদের অবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও একদল বৃটিশ অনুসন্ধানী দল গুহার অনেক গভীরে তাদের জীবিত খুঁজে পান৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Tham Luang Rescue Operation Center
রবিবার থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু
গুহার প্রায় তিন মাইল গভীরে অবস্থান করা কিশোরদের উদ্ধারে এক বড় বাধা ছিল বন্যার পানি এবং গুহার অত্যন্ত সরু কিছু অংশ৷ এমনকি তাদের সহায়তা করে ফেরার পথে এক ডুবুরিও মৃত্যুবরণ করেন৷ অন্যদিকে, আগামী কয়েকদিন আরো বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় তাদের উদ্ধারে তড়িঘড়ি করার প্রয়োজন পড়ে৷ ফলে রবিবার শুরু হয় উদ্ধার অভিযান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Chiang Rai PR office
বিপজ্জনক অভিযান
থাইল্যান্ডের স্থানীয় এবং একদল আন্তর্জাতিক ডুবুরি চূড়ান্ত উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন৷ একেক জন শিশুকে গুহার বিপদসঙ্কুল কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বের করে আনতে দু’জন করে ডুবুরিকে দায়িত্ব দেয়া হয়৷ তাদের সহায়তা করেন আরেকদল উদ্ধারকর্মী৷ গুহার প্রবেশ মুখ থেকে কিশোরদের অবস্থান অবধি স্থাপিত একটি দড়ি ধরে ডুবুরিরা কিশোরদের বের করে আনতে শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Tham Luang Rescue Operation Center
সবাই ভালো আছে
থাম লুং গুহা থেকে উদ্ধারকৃত কিশোর ফুটবলার দল এবং তাদের কাচ বর্তমানে চিয়াং রাই রাজ্যের রাজধানীর হাসপাতালে৷ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃতদের অন্তত দু’জনের ফুসফুসে সামান্য সংক্রমণ ধরা পড়েছে৷ এছাড়া সবাই সুস্থ আছে৷ তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের আরো কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে৷
ছবি: Getty Images/L. DeCicca
পুরো এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা
রবিবার চূড়ান্ত উদ্ধার অভিযান শুরুর আগে গুহাটির প্রবেশমুখ থেকে গণমাধ্যমসহ উদ্ধারকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন মানুষদের সরিয়ে দেয় থাই সেনাবাহিনী৷ উদ্ধারকাজে থাই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও কাজ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
আটকে পড়াদের ছবি
গুহায় আটকে পড়া ফুটবল দলের কয়েকটি ছবি দেখা যাচ্ছে এখানে৷ আটকে পড়ারা যাতে জীবিত বেরিয়ে আসতে পারে, সেজন্য গোটা থাইল্যান্ডে বিশেষ প্রার্থণার আয়োজন করা হয়৷ আর গত কয়েকদিন গোটা বিশ্বের নজর ছিল এই উদ্ধার অভিযানের দিকে৷
ছবি: Reuters/S. Z. Tun
বিশ্বকাপে আমন্ত্রণ
কিশোর ফুটবলাররা বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে গুহা থেকে উদ্ধার হলে তাদের রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফাইনাল মাঠে বসে দেখার আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানিয়েছে ফিফা৷ তবে, কিশোররা উদ্ধার হলেও সেখানে যেতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি, কেননা, চিকিৎসকরা উদ্ধারকৃতদের অন্তত এক সপ্তাহ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে চান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Solanki
8 ছবি1 | 8
অনুষ্ঠানে এসে এক ফুটবলার জানায়, আটকে পড়ার পর তার মাথা যেন ঠিকভাবে কাজ করছিল না, অনেক যুদ্ধের পর বেঁচে থাকাটা তার জন্য এখন অলৌকিক ঘটনা৷ তার ভাষায়, ‘‘ওটা সম্পূর্ণ অলৌকিক ঘটনা৷ (আটকে পড়ার সময়) আমার মস্তিষ্ক খুব ধীরে ধীরে কাজ করছিল, আমরা তো ১০ দিন গুহায় আটকে ছিলাম৷ বুঝতে পারছিলাম না কী বলবো!''
১১ থেকে ১৬ বছর বয়সি ১২ জন ফুটবলার এবং তাদের কোচের ১৭ দিন ধরে শুধু একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে – বাঁচতে হবে আর বাঁচতে হলে গভীর গুহা থেকে বেরোনোর পথ বের করতেই হবে৷ গুহায় তখন জল থৈ থৈ৷ আরেকবার বৃষ্টি শুরু হলেই পানির উচ্চতা বাড়বে আর তাতেই সলিল সমাধি হবে সবার৷ তাই কিশোরদের কেউ কেউ গুহা খুঁড়ে পথ করার চেষ্টাও করেছে৷ সঙ্গে কোনো খাবার ছিল না৷ তাই না খেয়ে খেয়ে শরীর তখন ভীষণ দুর্বল৷ মন তবু বলছিল, ‘‘বের হওয়ার পথ করতে পারবোই৷'' কোচ জানালেন, ‘‘যখন মনে হলো কর্তৃপক্ষ আমাদের উদ্ধার করবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকা ঠিক হবে না, তখন আমরা নিজেরাই মাটি খুঁড়ে পথ করার চেষ্টা শুরু করি৷'' এক কিশোর জনায়, অনেক চেষ্টায় সে তিন ফুট খুঁড়তে পেরেছিল৷
শেষ পর্যন্ত আর মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসার অসম্ভব চেষ্টায় প্রাণপাত করতে হয়নি তাদের৷ তার আগেই সফলভাবে শেষ হয় কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধার অভিযান৷ তারপর থেকে চলেছে চিকিৎসা৷ সাত দিনের চিকিৎসায় এখন সবাই বেশ সুস্থ৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ-কে এক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বলেছেন, ‘‘আমরা অনেকগুলো ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখেছি ওরা এখন সুস্থ আছে৷ এখন সমাজের যে কোনো চাপ সহ্য করার মানসিক শক্তিও হয়েছে ওদের৷ আর কোনো চিন্তা নেই৷ ওরা এখন বাড়ি ফিরতে পারে৷''