1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অবসরের রাজনীতি, অবসরের অর্থনীতি

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

কোন জিনিস কোনো চাকরিজীবী চায় না? জবাবটা এত সহজ যে এটা কোনো কুইজের প্রশ্নই হতে পারে না৷ উত্তর হলো, অবসর৷

ছবি: imago/photothek

অঙ্ক এমনিতেই জটিল, তার ওপর যদি তা অবসরের অঙ্ক হয় তো জটিলতার শেষ নেই৷ সেখানে শুধু ৫৫, ৫৮. ৬০. ৬৫-র হিসাব নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয় কয়েক সের অর্থনীতি, টনখানেক রাজনীতি এবং কয়েক ছটাক জটিল সমাজনীতি৷ এ সব হিসাব করেই অবসরের বয়স কখনো কমতি, কখনো বাড়তি৷ কখনো আবার অপ্রত্যাশিত রকম বেড়ে যায়৷ এ তো গেল সরকারি চাকরির গল্প৷ বেসরকারি ক্ষেত্রে বরং অঙ্ক একেবারে সহজ৷ একটাই ফর্মুলা৷ হায়ার অ্যান্ড ফায়ার৷

উদার অর্থনীতি, আর্থিক সংস্কার, বেসরকারিকরণ, গ্লোবালাইজেশনের মতো কঠিন কঠিন বিষয়গুলি চালু করার পর দেখা গেল, ভারতে বেসরকারি ক্ষেত্রে, কল-কারখানায় কাজের অধিকার, শ্রমিকদের অধিকার বলে বিশেষ কিছু আর নেই৷ কাজের নির্দিষ্ট সময় নেই, চাকরির নিশ্চয়তা নেই, চাকরির সুযোগ-সুবিধাগুলোও একে একে শেষ হয়ে যাচ্ছে, ছুটিছাটা কমে গেছে৷ কেন যে এখনো মে দিবসের দিন ভারতে ১৫টি রাজ্যে ছুটি থাকে কে জানে৷ কার্ল মার্কস সাহেবের ধারণা ছিল, সর্বহারার শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একসময় রাষ্ট্র বলে আর কিছু থাকবে না৷ রাষ্ট্র ব্যাপারটাই না কি মুছে যাবে৷ ভারতে তো উল্টো ছবি দেখা গেল৷ তাঁর আদর্শ নিয়ে চলা বামপন্থি দল ও তাঁদের ইউনিয়ন সব মুছে যেতে বসেছে৷ ফলে বেসরকারি ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন আর হয় না৷ আর হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের সময়ে আবার কীসের আন্দোলন!

তাই সরকারি চাকরির দিকেই তাকানো যাক৷ এমনিতে অবসরের বয়স ঠিক হয় বা হওয়া উচিত গড় আয়ুর অনুপাতে৷ একসময় না কি কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যেতেন মেয়েরা, ছেলেদের দৌড়ই বা আর কী ছিল৷ পঞ্চাশ হওয়া মানে তো ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে’ গাইতে থাকা৷ সরকারি চাকরিতে আগে অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর৷ কেরালায় এখনো তাই আছে৷ এখন তো সেই যুগ আর নেই৷ সত্তরেও দিব্যি টগবগ করে ছুটছেন লোকে৷ সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স ৫৮ হলো৷ তারপর ৬০৷ মাঝখানে একবার শোনা গেল, সরকার না কি আবার অবসরের বয়স ৫৮ করার কথা ভাবছে৷ হইহই শুরু হলো৷ সরকারি বিবৃতি এল, এরকম কোনো সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা হচ্ছে না৷ তারপর শোনা গেল, অবসরের বয়স বেড়ে ৬২ হচ্ছে৷ আবার হইচই৷ আবার বিবৃতি, এরকম কিছু করা হচ্ছে না৷ এর মধ্যেই সরকারি চিকিৎসকদের অবসরের বয়স ৬৫ করা হলো৷ সরকারি শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ৬৫ হলো৷ আর এই সব অঙ্কেই ঢুকে গেল ওই অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতির সরল ও জটিল সব সমীকরণ৷

এ জগতে স্বার্থ ছাড়া কে আর নড়ে বসে? সেই তালিকায় সরকারও তো বাদ নয়৷ অবসরের বয়স যখন বাড়ানো হলো, মানে ৫৮ থেকে ৬০ করা হলো তখন সরকারের স্বার্থটা কী ছিল? দুই বছর পেনশনের বোঝা না নেয়া৷ যাঁদের ৫৮ বছর বয়সে অবসর নেয়ার কথা ছিল, তাঁরা ৬০ বছরে অবসর নেবেন৷ দুই বছর ধরে তাঁদের পেনশন দিতে হবে না৷ অবসরকালীন গ্র্যাচুইটি ইত্যাদিও দিতে হবে না৷ সেই টাকাটা বাড়তি পাওয়া গেল৷ তা দিয়ে দেশের অর্থনীতি সামাল দিতে কিছুটা সুবিধা হবে৷ এ হলো অর্থনীতির অঙ্ক৷ রাজনীতিটা আসে কোথায়? ভোটের আগে যদি শিক্ষকদের অবসরের বয়স এক লাফে ৬৫ করে দেয়া হয়, তা হলে সম্ভাব্য ভোটব্যাঙ্কের সেবা করা হয়, এটা এমন কিছু জটিল অঙ্ক নয়৷ আর সরকারি কর্মচারিদের বিরাগভাজন হওয়ার মূল্যটা বেশ কয়েক বছর আগে ভোটে হেরে রাজস্থানের কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটকে দিতে হয়েছিল বলে দলের নেতারা এখনো আফসোস করেন৷

এরপরই আসছে সমাজনীতির গোলমেলে বিষয়টি৷ একটা সরকারি চাকরি খালি হলে, তা পাওয়ার জন্য লাখো বেকার মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তা হলে তাঁদের জন্য সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স কি ৫৮ রাখাই উচিত নয়, খুব বেশি হলে ৬০৷ তা বাড়িয়ে দিলে যুবকরা চাকরি পাবেন কী করে৷ বিশেষ করে উপমহাদেশের দেশগুলিতে, যেখানে চাকরি ও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে অসাম্য ভয়ঙ্কর রকমের প্রকট৷ সরকারি চাকরির মেয়াদ যবেই শেষ হোক, কর্মীরা তো অকুল পাথারে পড়বেন না৷ কারণ, তাঁদের বাঁধা পেনশন আছে৷ সপ্তম বেতন কমিশনের পরে তার পরিমাণ অনেকটাই বেড়েছে৷ ফলে তাঁদের জীবনধারনের সমস্যা নেই৷ কিন্তু সরকারের সামনে প্রশ্ন দাঁড়ায়. কাদের খুশি করা হবে, লাখ লাখ সরকারি কর্মীকে, না কি, বেকার আমজনতাকে৷ এখানে সরকারের দাঁড়িপাল্লা অধিকাংশ সময়েই কর্মীদের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ কারণ, কর্মীরা তুষ্ট থাকলে সব ঠিক থাকবে, তাঁরা রুষ্ট হলে মুশকিল৷ আর কতজন যুবকই বা আর চাকরি পাবেন৷ তার বাইরেও তো কোটি কোটি লোক থাকবেন৷ তাঁদের তো খুশি করা যাবে না৷ তাই ঝোপের পাখির পিছনে না ছুটে হাতের পাখিটাই ধরা যাক৷

এ বার দুই অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তার মতামত শোনা যাক৷ সেন্ট্রাল বোর্ড অফ এক্সাইজ অ্যান্ড কা্টমসের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার মনে করেন, ‘‘নতুন প্রযুক্তি এসেছে, নতুন ভাবনা এসেছে৷ এখন সরকারি চাকরিতেও যুবকদের বেশি করে নেয়া দরকার৷ তাই অবসরের বয়স কোনোভাবেই বাড়ানো উচিত নয়৷ সরকারের হাতে ফান্ডামেন্টাল রুলস ৫৬ জে আছে৷ সেই নিয়ম অনুসারে সরকার যে কোনো সময়ে যে কোনো সরকারি কর্মীকে অবসর নিতে বলতে পারে৷ সব চেয়ে বড় কথা, দেখতে হবে দেশের চাকরির পরিস্থিতি কী? অবসরের বয়স বাড়ালে তো যাঁরা সদ্য পাস করে বেরোচ্ছেন, তাঁদের সামনে চাকরির দরজা বন্ধ করে দেয়া৷ কেন তা করা হবে?’’ অধুনালুপ্ত যোজনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত আমলা অমিতাভ রায়ের বক্তব্য, ‘‘করোনাকালে সরকারও একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে৷ ৩৩ শতাংশ কর্মীদের নিয়ে চালানো যায় কি না, ৫০ শতাংশ লোককে নিয়ে চালানো যায় কি না৷ নতুন নিয়োগ এমনিতেই নেই৷ কিছু বাড়তি লোক ছেঁটে ফেলা যেতে পারে৷ কম লোক দিয়ে কাজ হয়ে গেলে বেশি লোক নিয়ে কী হবে? ভারত সরকার যে দু হাজার সাল নাগাদ অবসরের বয়স ষাট করলো তা তো রাজকোষের ঘাটতি ঢাকতে৷ এতগুলো লোককে পেনশন দিতে হবে না বলে তখন বয়স বাড়ানো হয়৷ সেটাই থাকুক৷ বাড়ানোর দরকার নেই৷’’

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় পার্সোনাল মন্ত্রী সংসদে হিসাব দিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় সাতলাখ পদ খালি৷ এটা ২০১৮-র হিসাব৷ ৩৮ লাখ অনুমোদিত পদের মধ্যে প্রায় সাত লাখ পদে লোক নেই৷ তারপর সংখ্যাটা সম্ভবত বেড়েছে বই কমেনি৷ সরকার তো সংকোচনের মুডে৷ সব চেয়ে বেশি মানুষ যেখানে কাজ করেন, সেই রেলেরও বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে৷ বিমানবন্দরগুলি বেসরকারি হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে৷ মোদী বলেছিলেন, ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্স৷’ কর্মীসংখ্যার দিক থেকে অন্তত মিনিমাম জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে ভারত৷ ভবিষ্যতে সরকারি কর্মীর সংখ্যা এতটাই কমে যেতে পারে যে, তাঁদের অবসরের বয়স নিয়ে আর কেউ আলোচনাই করবেন না৷ যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন সরকারি কর্মীদের ষাটেই থাক৷ অন্তত যতদিন তাঁদের পেনশন নামক সুরক্ষাকবচ থাকছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ