তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছবি তুলে সমালোচনার মুখে পড়ে জার্মানির জাতীয় ফুটবল দল ছেড়ে দিলেন মেসুত ও্যজিল৷ বিদায়ী বিবৃতিতে তিনি বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথম রাউন্ডেই জার্মানির বিদায় এখনো হজম করছেন জার্মানরা৷ এরই মধ্যে জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়ের বিস্ফোরক বিবৃতি পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে৷ ২৯ বছর বয়সি তুর্কি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় মেসুত ও্যজিলদীর্ঘকাল জাতীয় দলে রয়েছেন৷ ব্রিটেনে আর্সেনাল ক্লাবেও তিনি খেলেন৷ মে মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান লন্ডন সফর করছিলেন৷ সে সময়ে জার্মানির দুই তুর্কি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ ও্যজিল ও গুন্দোয়ান তুরস্কের বিতর্কিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছবি তুলে জার্মানিতে তীব্র সমালোচনার শিকার হন৷ জার্মানির জাতীয় দলের খেলোয়াড় হয়েও তাঁরা তুরস্কের ‘স্বৈরাচারী' প্রেসিডেন্টের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে৷ তবে সমালোচনা সত্ত্বেও ও্যজিল নীরব ছিলেন৷ রাশিয়ায় বিশ্বকাপে খেলার পর দেশে এসে রবিবার তিনি মুখ খোলেন৷ ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে তিনটি ভাগে বিবৃতি প্রকাশ করেন তিনি৷ শেষ বিবৃতিতে তিনি জাতীয় দল ত্যাগের ঘোষণা করেন৷
মেসুট ও্যজিল নানা মহলের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলেছেন৷ তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বিষয়টি খোলসা করে তিনি বলেন, তুর্কি বংশোদ্ভূত মানুষ হিসেবে পরিবারে তিনি তাঁর পূর্ব-পুরুষের দেশের প্রতিও শ্রদ্ধা জানানোর শিক্ষা পেয়েছেন৷ তারই আওতায় ব্যক্তি এর্দোয়ান নয়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদের প্রতি সম্মান দেখিয়েই তিনি লন্ডনে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ তুরস্কে নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হতে তিনি সেখানে যাননি৷ এ প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও রানিও এর্দোয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন৷
জার্মানির প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন ও্যজিল৷ জার্মানিতে জন্মগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও তাঁকে অনেকে জার্মান নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ জার্মান দলে তাঁর বন্ধু লুকাস পডোলস্কি ও মিরোস্লাভ ক্লোজে জার্মান-পোলিশ হিসেবে পরিচিত না হলেও তাঁকে সব সময়ে কেন জার্মান-তুর্কি হিসেবে তুলে ধরা হয়, সেই প্রশ্ন তুলেছেন ও্যজিল৷ তুরস্ক ও ইসলাম ধর্মই কি এই বৈষম্যের কারণ? জার্মান ফুটবল ফেডারেশন ডিএফবি ও তাঁর কয়েকটি স্পন্সর কোম্পানির বিরুদ্ধেও বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন তিনি৷ ও্যজিল দাবি করেন, খেলা নিয়ে সমালোচনা মেনে নিতে তাঁর কোনো সমস্যা নেই৷
ও্যজিল এমন বিবৃতি প্রকাশ করায় জার্মানিতে সার্বিকভাবে বর্ণবাদ ও সমাজের মূল স্রোতে বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ ও্যজিলের মতো তারকা খেলোয়াড় নিজেকে সমাজ থেকে এমন বিচ্ছিন্ন মনে করায় অনেক মহল গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে৷ জার্মান ফুটবল ফেডারেশনও অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে৷ ডিএফবি-প্রধান রাইনহার্ড গ্রিন্ডেলের পদত্যাগের ডাক দিচ্ছেন বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা৷
জার্মান সমাজে বর্ণবাদ নিয়ে ও্যজিলের বিস্ফোরক অভিযোগ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সমালোচনাকে ন্যায্য বলে মনে করছেন অনেকে৷ সবুজ দলের তুর্কি বংশোদ্ভূত নেতা চেম ও্যজদেমির বলেন, তুরস্কের প্রতি সম্মান দেখাতে হলে যারা সে দেশে এর্দোয়ানের দমন নীতির শিকার হচ্ছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত৷
ও্যজিল তাঁর বিবৃতি প্রকাশের পর তুরস্কের সরকারি মহলে তাঁর প্রতি জোরালো সমর্থন দেখা যাচ্ছে৷ সে দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী তাঁর সম্মানজনক অবস্থানের গভীর প্রশংসা করেছেন৷ তুরস্কের বিচারমন্ত্রী তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, পদত্যাগের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে সেরা গোল দিয়েছেন ও্যজিল৷
এক নজরে মেসুত ও্যজিল
এক যুগ জার্সি গায়ে বিভিন্ন পর্যায়ের জার্মান দলের প্রতিনিধিত্ব করার পর, এর্দোয়ান-বিতর্কে অবসর নিলেন মেসুত ও্যজিল৷ চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক ও্যজিলের বর্ণিল ক্যারিয়ার৷
২০০৫ সালে ও্যজিল নিজের শহর গালসেনকিয়র্শেনে বুন্ডেসলিগার দল শালকের যুবা দলে যোগ দেন৷ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর সাফল্য আসে বেশ দ্রুতই৷ ২০০৯ সালে জার্মানির হয়ে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি৷
ছবি: Imago/Team 2
ব্রেমেন এবং তারপর
যাঁরা একসময় ‘ভবিষ্যতের তারকা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁদের হতাশ করেননি ও্যজিল৷ শালকের সাথে বেতন নিয়ে বনিবনা না হওয়ার পর ২০০৮ সালে ভ্যার্ডার ব্রেমেনে যোগ দেন তিনি৷ ২০১০ সালের বিশ্বকাপে তাঁর নজরকাড়া নৈপুণ্য ইউরোপের সবচেয়ে ভালো ক্লাবগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ ২০১০ সালে ও্যজিল রেয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন, পরে তৎকালীন সময়ে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর রেকর্ড ট্রান্সফার মানিতে যোগ দেন ইংলিশ দল আর্সেনালে৷
ছবি: Imago/Sven Simon
ইন্টিগ্রেশন
২০১০ সালে ও্যজিল জার্মানির সর্বোচ্চ মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ‘বাম্বি’ জিতে নেন৷ জার্মানিতে ও্যজিল তাঁর পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম৷ তুর্কি ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করলেও, ও্যজিল জার্মানির প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা বরাবরই জানিয়ে এসেছেন৷ ও্যজিল একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম৷ ২০১৬ সালে মক্কায় হজ করে এসেছেন তিনি, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছবিও পোস্ট করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Pedersen
জয় করেছেন হৃদয়
২০১২ সালে জার্মানির হয়ে তুরস্ককে হারানোর পরের ছবি এটি৷ খেলোয়াড়দের কেবিনে গিয়ে ও্যজিলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ নিজের শান্ত মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অনেক ভক্তকে কাছে টেনেছেন৷ ২০১৪ সালে নিজের বিশ্বকাপ জয়ের উপার্জন ব্রাজিলের দুস্থ শিশুদের চিকিৎসার জন্য দান করে সবার মন জয় করে নেন তিনি৷
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পথে সাতটি ম্যাচই শুরুর করেছিলেন ও্যজিল৷ জার্মান কোচ ইওয়াখিম ল্যোভের সঙ্গে বরাবরই সুসম্পর্ক ছিল তাঁর৷ সবচেয়ে বেশি সফল পাসের তালিকায় সেবার তৃতীয় হয়েছিলেন ও্যজিল৷ সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে আর্জেন্টাইন তারকা মেসিই ছিলেন কেবল তাঁর চেয়ে এগিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/GES/M. Gillar
এর্দোয়ান বিতর্ক
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের সঙ্গে আগেও দেখা করেছেন ও্যজিল৷ কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাসে এর্দোয়ানের সাথে এমনই এক সাক্ষাতের পর তোলা ছবি বিতর্ক উসকে দেয়৷ বামপন্থিরা এই বৈঠক ও ছবিকে বর্ণনা করেছেন স্বৈরাচারী এক শাসকের পক্ষে সমর্থনের প্রতীক বলে, অন্যদিকে, চরম ডান থেকে অভিযোগ এসেছে ও্যজিলের জার্মানির প্রতি আনুগত্যের অভাবের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Presidential Press Service
একটি অধ্যায়ের অবসান
২০১৮ সালে রুশ বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পড়ে জার্মানি৷ কয়েক দশকের মধ্যে যা ছিল দেশটির সবচেয়ে বাজে পারফর্ম্যান্স৷ ডিএফবি-প্রধান রাইনহার্ড গ্রিন্ডেল নিজের দিকে আসতে থাকা সমালোচনার তীর ঘুরিয়ে দেন ও্যজিলের দিকে৷ তিনি অভিযোগ করেন, এর্দোয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর দলে বিক্ষিপ্ত মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে৷ এর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে জার্মান ফুটবল ফ্যানরাও৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
জিতলে ‘জার্মান’, হারলে ‘অভিবাসী’
মাত্র ২৯ বছর বয়সেই টুইটারে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অবসরের ঘোষণা দিলেন ও্যজিল৷ গ্রিন্ডেলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তাঁর অদক্ষতার জন্য আমি বলির পাঁঠা হতে রাজি না’৷ ডিএফবি প্রধানের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগও তোলেন তিনি৷ বাজে সময়ে পাশে থাকায় জার্মান কোচ ইওয়াখিম ল্যোভ এবং সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানান তিনি৷ জার্মানির হয়ে মোট ৯২ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২৩টি গোল নিজে করেছেন এবং ৪০টি গোলে সহায়তা করেছেন ও্যজিল৷