1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

অবাধ চাঁদাবাজী, সিন্ডিকেটের কবলে অসহায় ক্রেতা

সমীর কুমার দে ঢাকা
১২ অক্টোবর ২০২৪

গত দুই-তিন সপ্তাহে দ্রব্যমূল্য অনেকটাই বেড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- এখন কেন দ্রব্যমূল্য বাড়বে? এখন তো সেই ‘সিন্ডিকেট' থাকার কথা নয়, ‘চাঁদাবাজি'ও বন্ধ হওয়ার কথা, তাহলে কেন দাম বাড়ছে?

ঢাকার একটি কাঁচাবাজেরর চিত্র
শুধু সবজি নয়, চাল, ডাল, তেলসহ সবকিছুর দামই বেড়েছেছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

অনুসন্ধানে গিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ জানা গেল। প্রথমত, টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে অনেক এলাকায় ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়া, বৈদেশিক মার্কেটে কিছু কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবংচাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট বন্ধের কথা বললেও সেগুলো পুরোমাত্রায় সচল থাকা। পূজোর কারণে ভারত থেকে কিছু পণ্য আমদানিতে বিঘ্ন হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের এখন জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

তবে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন. "আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি, আশা করছি শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”

গত বুধবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, "সরকার ক্ষমতায় আসার দুই মাসে ঊর্ধমুখী মূল্যস্ফীতি থামাতে পেরেছে। অধৈর্য না হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যেও স্বস্তি পাওয়া যাবে।” সুলভ মূল্যে পণ্য পেতে জনগণকে আরও কিছু দিন ধৈর্য ধরার আহ্বান রেখে তিনি বলেন, "মূল্যস্ফীতি অফিসিয়ালি ১ শতাংশ কমেছে। মূল্যস্ফীতি আমরা মোটামুটি এক জায়গায় থামাতে পেরেছি।”

বাজারে জিনিসপত্রের অনেক দাম- সাংবাদিকরা এমন তথ্য তুলে ধরলে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "এখন কমাবার ব্যাপারে একটু সময় লাগবে। এরই মধ্যে আমরা কিছু ডিসিশন দিয়েছি। তেলের ওপর ডিউটি (শুল্ক) কমিয়েছি। আজকে চিনির ওপর ডিউটি কমিয়ে দেওয়া হল।”

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ তদারক ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। জেলা পর্যায়ে এসব টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যা দেশের সব জেলা পর্যায়ে আলাদাভাবে কাজ করবে। গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতিটি জেলায় বিশেষ এ টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক হিসেবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং সদস্য সচিব হিসেবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া টাস্কফোর্সে সদস্য হিসেবে থাকবেন জেলার একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, কৃষি বিপণন কর্মকর্তা বা জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি এবং দুজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। টাস্কফোর্স প্রয়োজনে সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কে বলেছে সিন্ডিকেট নেই, কে বলেছে চাঁদাবাজি নেই। ব্যবসায়ীরা তো আমাদের বলছে, সবই আছে শুধু নাম পরিবর্তন হয়েছে। এগুলো আমরা বলছি না, ব্যবসায়ীরা আমাদের বলছেন। এখন এগুলো যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে কিভাবে?সরকারকে তো এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।”

কিছু পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচের কেজি হয়েছে ৪০০ টাকা। প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ১৮০-১৯০ টাকা। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির মতো পণ্যসহ প্রায় সব ধরনের সবজির দামও বেড়েছে। এর আগে গত রবিবার এক ফেসবুকে স্ট্যাটাসে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, "অনেকগুলো পণ্য ডিউটি ফ্রি করার পরও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বাজার মনিটরিংয়ে টাস্কফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুতই মাঠে নামবে টাস্কফোর্স।” কিন্তু টাস্কফোর্স গঠনেও পড়েনি কোন প্রভাব।

কেন প্রভাব পড়ছে না? জানতে চাইলে শেওড়াপাড়ার সবজি বিক্রেতা আব্দুল কুদ্দুস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা তো কারওয়ান বাজার থেকে সবজি এনে বিক্রি করি। কারওয়ান বাজারের আড়তদাররা আমাদের বলছেন, বন্যায় অনেক এলাকা ডুবে গেছে। ফলে ওই এলাকা থেকে সবজি আসছে না। আবার সবজির ট্রাকে কিছু চাঁদাবাজির কথাও তারা বলছেন। ফলে আমরা তো বুঝতে পারি না, কেন দাম বাড়ছে। আমরা যে দামে কিনি, সেভাবেই বিক্রি করি।”

আসলে কি ঢাকায় আসার পর পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে? নাকি উৎপাদন পর্যায়েই দাম বেশি? এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, সবজির অন্যতম পাইকারি মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাট। পাইকারি এই হাট থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ছাড়াও সারা দেশের সবজির অন্যতম সরবরাহস্থল এই হাট। বৃহস্পতিবার এ হাটে এক কেজি করলা বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। পটোল বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা দরে। এ ছাড়া হাইব্রিড শসা প্রতি কেজি ৫০ টাকা, দেশি শসা ৭০, কাকরোল ৬৫ টাকা, বেগুন ৭০ টাকা, কচুমুখি ৫০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা ও ঢ্যাঁড়স ৬৫ টাকা ও পেঁপে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লাউ প্রতিটি ৬০ টাকা ও মিষ্টিকুমড়া প্রতি কেজি ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কাঁচা মরিচের কেজি ছিল ২৯০ টাকা।

ওই হাটের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে মহাস্থান হাটে পাইকারি পর্যায়ে এক কেজি কাঁচামরিচ ১৪০, করলা ৫০, পটোল ২৫ টাকা, হাইব্রিড শসা ৩০ টাকা, দেশি শসা ৪০ টাকা, কাকরোল ৩০ টাকা, বেগুন ৩০ টাকা, কচুমুখি ৩০ টাকা, মুলা ২৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৩০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, লাউ প্রতিটি ৪০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। তাহলে দাম কেন বেড়েছে? এর জবাবে বিক্রেতা ও পাইকারেরা বলছেন, বর্ষার কারণে কৃষকের খেতে সবজি নষ্ট হয়েছে। এতে সবজির উৎপাদন বিপর্যয় ঘটেছে।

শুধু সবজি নয়, চাল, ডাল, তেলসহ সবকিছুর দামই বেড়েছে। তেলের দাম কেন বাড়ছে? জানতে চাইলে ফেনীর হারুন ফ্লায়ার মিলস লিমিটেডের স্বত্বাধিকার হারুন-উর-রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দু'টি কারণ। এক. বৈশ্বিকভাবেই দাম বাড়ছে। আর দুই. ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের টাকা শক্তিশালী হবে, ততদিনে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না। সিন্ডিকেট বলে কিছুই নেই। এগুলো দায় এড়ানো কথা। আগের সরকারও এই কথাগুলো বলেছে। এই সরকারও বলছে। আমি মনে করি, টাকাকে শক্তিশালী করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আমাদের সবকিছুর সঙ্গেই আমদানির একটা সম্পর্ক আছে।”

নিত্যপণ্যের দরে ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বৃহস্পতিবার বাজার পরিদর্শন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিব দাবি করেছেন, কিছু পণ্যের দাম কমেছে। মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মোট ছয়টি দল বৃহস্পতিবার ঢাকার বিভিন্ন কাঁচাবাজারে বেশ কিছু পণ্যের পাইকারি ও খুচরা মূল্যের ব্যবধান খতিয়ে দেখল। পাইকারি বাজার থেকে কী মূল্যে পণ্য কেনা হয়েছে, আর কী মূল্যে বিক্রি হয়েছে, অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে কিনা, সেটিও দেখেছে এসব দল। মূল্য তালিকা টানানো না থাকায় একটি দোকানকে জরিমানাও করা হয়েছে।

উপসচিব সুলতানা আক্তারের নেতৃত্বে একটি দল যায় রাজধানীর বনানী কাঁচাবাজারে। তারা চাল, ডাল, ডিম, আটা, কাঁচা মরিচ, সবজি, মাছ ও মুরগির দর পর্যবেক্ষণ করে। খুচরা মূল্য তালিকা সঠিকভাবে না সাঁটানোয় তারা বিভিন্ন দোকানকে সতর্ক করে। গত কয়েক দিনের তুলনায় ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম কিছুটা কমেছে দাবি করে সুলতানা আক্তার বলেন, "যে জিনিসগুলোর দাম এখন বেশি..মানে ঊর্ধ্বগামী, যেমন ডিমের যতগুলো দোকান ছিল সবগুলো দোকান দেখেছি আমরা। তাদের যে রসিদ ছিল তা পরীক্ষা করে দেখেছি কত মূল্যে তারা কিনেছে, কত মূল্যে বিক্রি করছে। চারদিন আগের তুলনায় তারা যে দামে কিনেছে তাতে ডজন হিসেবে ১০ টাকার মত কমে এসেছে।”

সিন্ডিকেট নেই, তবুও কেন এই পরিস্থিতি? জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, বন্যার কারণে অনেক পণ্য নষ্ট হয়েছে। ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যেটা প্রতিবছরই হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, আমদানি করা যেসব খাদ্যপণ্য। যেহেতু ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না, ডলার ঠিকমতো দিতে পারছে না। ডলারের উচ্চমূল্য তো আছেই। এর মধ্যে সরকার বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের ডিউটি কমিয়েছে। কিন্তু বাজারের মূল সমস্যা নিয়ে কাজ করা হয় না। অনেকেই সিন্ডিকেটের কথা বলেন, কিন্তু সমাধান নিয়ে কাজ করা হয় না। শুধু বাজার মনিটরিং করে সামাধান আনা যাবে না। যতক্ষন না সাপ্লাই চেইনে আপনি পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারবেন। তড়িৎ উদ্যোগ নিয়ে সাময়িক কিছু সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। তবে সাপ্লাই চেইনটা ঠিক না করা পর্যন্ত কোন কিছু স্থায়ী সুফল আসবে না।”

ঋণখেলাপি যে দলেরই হোক না কেন, আমরা ছাড়বো না: গভর্নর

26:34

This browser does not support the video element.

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ