করোনা সংকট মোকাবিলায় ইইউ শীর্ষ নেতারা ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিচ্ছেন৷ তবে একক পদক্ষেপের বদলে সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্যোগের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির উন্মুক্ত সীমানা শুধু মানুষ ও পণ্য নয়, করোনা ভাইরাসের অবাধ সংক্রমণের পথও সুগম করে দিচ্ছে৷ গত বছর সংক্রমণের ‘প্রথম ঢেউ’ দেখা দেবার পর একাধিক দেশ লকডাউনের পাশাপাশি সীমান্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ শীতকালে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ দেখা দেবার পর অবশ্য ইইউ অভ্যন্তরীণ সীমান্তে তেমন কোনো কড়াকড়ি দেখা যায়নি৷ কিন্তু পরিস্থিতির অবনতির জের ধরে ইইউ নেতারা নাগরিকদের অবাধ চলাচলের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন৷ সেই সঙ্গে আরো পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের চাপও বাড়ছে৷
বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইউরোপের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক৷ বেড়ে চলা করোনা সংক্রমণ এবং করোনার নতুন সংস্করণের প্রাদুর্ভাবের কারণে দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷ তাঁর মতে, ইউরোপের একক বাজারের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ করা উচিত হবে না৷ পণ্য এবং শ্রমিক-কর্মীদের অবাধ চলাচল অত্যন্ত জরুরি৷ সংক্রমণের ঝুঁকি অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হচ্ছে৷ প্রায় গোটা ইউরোপের মানচিত্রই লাল হয়ে উঠেছে৷ এবার বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিকে গাঢ় লাল হিসেবে তুলে ধরে সেখানে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দিয়েছেন ফন ডেয়ার লাইয়েন৷ অর্থাৎ অতি জরুরি কারণ ছাড়া সেখান থেকে মানুষ বের হতে পারবেন না৷ করোনা পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে৷ ইউরোপীয় সরকার পরিষদের প্রধান শার্ল মিশেলও অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন৷
বৃহস্পতিবার প্রায় চার ঘণ্টার এক ভিডিও কনফারেন্সে ইইউ শীর্ষ নেতারা করোনা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের বদলে সাধারণ মানদণ্ডের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন৷ যেমন, করোনা টিকা নিলে মানুষকে সাধারণ সার্টিফিকেট দেবার প্রস্তাব বিবেচনা করছেন তারা৷ জানুয়ারি মাসেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে৷ তবে গ্রিস ও স্পেনের অনুরোধ মেনে এমন সার্টিফিকেট সম্বল করে অবাধ ভ্রমণের প্রস্তাব সম্পর্কে এখনো ঐকমত্য সম্ভব হয়নি৷ টিকা নিলেও কোনো মানুষ সংক্রমণের উৎস হতে পারে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থাকায় ফ্রান্স এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে৷ বেলজিয়াম পর্যটনের মতো কম প্রয়োজনীয় ভ্রমণ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে৷
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ভিডিও কনফারেন্সের আগে করোনা সংকটের ‘তৃতীয় ঢেউ’ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন৷ এমন পরিস্থিতি এড়াতে ব্রিটেনে করোনা ভাইরাসের মিউটেশনের ফলে নতুন সংস্করণের জোরালো মোকাবিলা করা প্রয়োজন তুলে ধরেন তিনি৷ তিনি সীমান্ত বন্ধের সম্ভাবনা এখনো উড়িয়ে দিচ্ছেন না৷ তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে এমন পদক্ষেপ এড়াতে চান ম্যার্কেল৷
বৃহস্পতিবারের আলোচনার পর আগামী কয়েক দিনে পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে আরো কড়া পদক্ষেপ নিয়ে ভাবনাচিন্তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷ গত বছরের মতো আতঙ্কের জের ধরে জাতীয় স্তরে একক পদক্ষেপ এড়িয়ে চলতে চায় ইইউ৷ আগামী রবিবার থেকে অতি প্রয়োজনীয় কারণে কেউ ইইউ-তে প্রবেশ করলে ফিরে যাবার আগে কোভিড ১৯ পরীক্ষা করতে হবে৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
করোনা ভ্যাকসিনের যত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিশ্বের অনেক দেশে শুরু হয়েছে করোনার টিকাদান৷ তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী সেটি নিয়ে এখনও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
সাধারণ প্রতিক্রিয়া
যেকোন টিকারই সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে৷ যেমন, শরীরে ইনজেকশন দেয়ার স্থানটি লাল হয় বা ফুলে যায়৷ তিনদিনের মধ্যে অবসাদ, জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যাথা হতে পারে৷ তবে এর কোনটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ শরীরে টিকার কার্যকারিতা শুরু হলে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ অনুমোদন পাওয়া করোনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷
ছবি: Mark Lenninhan/AFP/Getty Images
গুরুতর প্রতিক্রিয়া
বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে৷ যেমন, যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচি চালুর পর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুইজনের অ্যালার্জি দেখা দেয়৷ দেশটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে সতর্ক করেছে৷ তবে সার্বিকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেই করোনার বিভিন্ন টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি, যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
টিকার উপাদান
সাধারণত টিকায় দুর্বল বা মৃত ভাইরাস থাকে৷ যার মাধ্যমে শরীর সেই ভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে৷ তবে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রথমবারের মতো এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি৷ এতে কোন ভাইরাস থাকে না৷ তার বদলে কোভিড-১৯ এর জীবাণুর ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিরূপ থাকে৷ তাই দুই ধরনের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দুই রকম হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
বায়োনটেক-ফাইজার
অনুমোদন পর্যায়ে বায়োনটেক-ফাইজার উদ্ভাবিত টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কোন কোন ক্ষেত্রে টিকা গ্রহীতা সাময়িক অবসাদ আর মাথা ব্যাথায় ভুগেছেন৷ এমআরএনএ ভ্যাকসিনটির ব্যবহার শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে একজন ও ব্রিটিনে দুইজনের ত্বক লাল হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল৷ যাদের অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে তাদেরকে সতর্ক করেছে বিট্রিশ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি৷
ছবি: Jacob King/REUTERS
মডার্না
বায়োনটেক-ফাইজারের মতোই এমআরএনএ ভিত্তিক মডার্নার টিকাটি৷ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকাগ্রহীতাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি৷ হালকা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো ছিল সাময়িক৷ তবে ১০ শতাংশ অবসাদে ভুগেছেন বলে জানিয়েছে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক প্যানেল৷ অল্প কয়েকজন রোগী অ্যালার্জি ও মুখের স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হওয়ার মতো জটিলতায় ভুগেছেন৷ তবে কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: Dado Ruvic/Reuters
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একজন মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভুগেছেন৷ সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর কিছুদিন ট্রায়াল বন্ধ ছিল৷ কিন্তু পরে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরীক্ষার পর জানিয়েছে সেটির কারণ ভ্যাকসিন নয়৷ এছাড়া টিকাটি নেয়ার পর ইনজেকশনের স্থানে ও পেশিতে ব্যথা, মাথাব্যাথা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম ছিল৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/J. Porzycki
স্পুটনিক ফাইভ
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরুর আগে গত আগস্টেই নিজেদের টিকা স্পুটনিক ফাইভ এর অনুমোদন দেয় রাশিয়া৷ দুই ধরনের পরিবর্তিত অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে এতে৷ রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্বর, মাথাব্যাথার মতো টিকাটির কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ তবে কোন গুরুতর প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ না করার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে৷
ছবি: Sergei Karpukhin/TASS/dpa/picture alliance
দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে সেগুলোর কোনটিই আসলে পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরছে না৷ দীর্ঘ মেয়াদে টিকাগুলোর ব্যবহার মানবদেহে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা অজানা৷ সেটি হয়ত সামনের মাস বা বছরগুলোতেই পরিস্কার হবে৷