বাংলাদেশের যৌন ব্যবসায় আইন বহির্ভূতভাবে নারীদের ব্যবহারের অভিযোগ আছে৷ এমনকি ১০ বছর বয়সের মেয়ে শিশুকেও যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হয়৷ এর বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা প্রয়োগের যথেষ্ট নজির নেই৷
ছবি: Thomson Reuters Foundation/S. Glinsk
বিজ্ঞাপন
যুব মহিলালীগের নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়া আটক হওয়ার পর এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে৷ তাকে আটকের পর শনিবার র্যাব প্রেস ব্রিফিং-এ জানায়,‘‘পাপিয়া নারীদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করেছে৷ আর এটা সে করেছে হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেডিডেন্সিয়াল স্যুইট ভাড়া নিয়ে৷'' কিন্তু পাপিয়া বা ওয়েস্টিনের বিরুদ্ধে এবিষয়ে কোনো মামলা হয়নি৷
আইনজীবীরা জানিয়েছেন,বাংলাদেশের সংবিধানে পতিতাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে৷ সংবিধানে এই পেশা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷ কিন্তু প্রচলিত আইনে ১৮ বছর বয়স হলে কোনো নারী আদালতে ঘোষণা দিয়ে পেশা হিসেবে গণিকাবৃত্তি বেছে নিতে পারেন৷ শর্ত হলো তাকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে এবং স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে আদালতের কাছে ওই পেশা বেছে নেয়ার ঘোষণা দিতে হবে৷
অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলেও কাউকে জোর করে যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত করা যাবে না৷ এটা করলে তারা নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে অপরাধী হবেন৷
সেক্স ওয়াকার্স নেটওয়ার্কের(এসএনডাব্ল্উি) সেলিনা আক্তার জানান,‘‘এদেশের সেক্স ওয়ার্কারদের অনেকের বয়সই ১৮ বছরের নিচে৷ তাদের বড় একটি অংশকে জোর করে এই পেশায় নামানো হয়েছে৷এর সঙ্গে পুলিশও জড়িত৷''
এরকম ১০০ মেয়েকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সেলিনা জানিয়েছেন, কীভাবে তাদের জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা হয়েছে৷ দালালেরা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে, কাউকে অপহরণ করে আবার প্রেমের অভিনয় করেও নারীদের যৌন পল্লীতে বিক্রি করে৷ এরপর আর সেখান থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারে না৷ আবার কেউ ফিরে এলেও আইনি সহায়তা পায়না৷
তিনি আরো জানান,‘‘প্রাপ্তবয়স্ক কারো এই পেশায় আসার জন্য আদালতে ঘোষণা দেয়ার আইন থাকলেও তা মানা হয় না৷ ঘোষণা দিয়ে এই পেশায় আসার সংখ্যা খুবই কম৷ আর অনেক সময় দালালেরা শিশু বা কিশোরীদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে দেখায় আদালতে৷''
সেলিনা আক্তার
This browser does not support the audio element.
তুহিন হাওলাদার
This browser does not support the audio element.
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসেবে দেশের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে চার হাজারের মত যৌনকর্মী আছেন৷ আর সারাদেশে ভ্রাম্যমান যৌনকর্মী আছেন ১০ হাজারের মত৷ সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের কমিউনিটি সুপারভাইজার সবুজ মিয়া জানান এই সংখ্যা বাস্তবে আরো বেশি হবে৷ তিনি জানান যৌনপল্লী থেকে মাঝে মধ্যে পুলিশ অপ্রাপ্তবয়স্কদের উদ্ধার করে৷ তবে যারা ভাসমান তাদের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই৷
অভিযোগ রয়েছে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক দেখানোর জন্য চক্র আছে৷ ওই চক্রে দালান, পুলিশ এবং আদালতের কর্মচারীরা জড়িত৷ সবুজ মিয়া জানান,‘‘বয়স বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ আছে৷ আবার জোর করে এই পেশায় নিয়োজিত করার অভিযোগও আমরা পাই৷'' আর সেলিনা জানান,‘‘১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদেরও যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে৷''
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলের,‘‘বাংলাদেশের সংবিধানে পতিতা বৃত্তিকে নিষিদ্ধই করা হয়েছে৷ মুসলিম আইনেও এটা নিষিদ্ধ৷ তবে এই পেশা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের আগে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে৷ তাই প্রচলিত আইনে প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের বেশি বয়সের কেউ ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে ঘোষণা দিয়ে এই পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন৷ জোর করে কাউকে এই পেশায় নিয়েজিত করা যাবে না৷''
অন্যদিকে পাপিয়া এবং ওয়েস্টিনের ঘটনার আইনি ব্যাখ্যা দেন অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার৷ তিনি বলেন,‘‘ওয়েস্টিনে পাপিয়া নারীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছেন৷ এ বিষয়ে তথ্য প্রমাণ থাকে তাহলে পাপিয়া এবং ওয়েস্টিন হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানবপাচার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়৷ সেটা করা না হলে আইনের লঙ্ঘন হবে৷''
এদিকে এই বিষয় নিয়ে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেনা৷ কোনো তথ্যও দিচ্ছেনা৷
যেসব দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ
পতিতাবৃত্তি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পেশা৷ কিন্তু কোনো যুগে, কোনো দেশেই মানুষ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি, আজও করে না৷ তবে বিশ্বের বহু দেশেই পতিতাবৃত্তি বৈধ এবং সেখানে যৌনকর্মীরা নিয়মিত আয়করও দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Vennenbernd
হল্যান্ডের ‘পতিতাপল্লী’ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ
নেদারল্যান্ডসে পতিতাবৃত্তি শুধু বৈধ নয়, ইউরোপের এই দ্বীপদেশটির পতিতাপল্লী সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিখ্যাত৷ ঐ ‘রেডলাইট জোন’ দেখতে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসে আমস্টারডামে৷ নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপের আরেক দেশ বেলজিয়ামেও দেহব্যবসা সম্পূর্ণ বৈধ৷
ছবি: picture-alliance/AP
জার্মানি এবং ফ্রান্সে কঠোর আইন
জার্মানি এবং ফ্রান্সেও দেহব্যবসা বৈধ৷ তবে এ দু’দেশেই যৌনকর্মীদের এই ব্যবসা করতে হয় কঠোর আইন মেনে৷ জার্মানির কিছু শহরে এখনো যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমে খদ্দের ডাকতে পারেন না, এভাবে খদ্দের সংগ্রহ করা সেসব জায়গায় আইনত দণ্ডনীয়৷ ফ্রান্সেও ২০১৪ সালে এমন একটা আইন হয়েছে, যা মেনে যথেচ্ছ দেহব্যবসা করা খুব কঠিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সুইডেন আর নরওয়েতেও নিয়ন্ত্রিত পতিতাবৃত্তি
ফ্রান্স ২০১৪ সালে যে আইন প্রবর্তন করে, সেটা প্রথম চালু হয়েছিল সুইডেনে, ১৯৯৯ সালে৷ এ কারণে আইনটি ‘সুইডিশ মডেল’ হিসেবে পরিচিত৷ এ আইনে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা করে দালালদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক
সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতেও দেহব্যবসা বৈধ৷ তবে এ দু’টি দেশে ১৯ বচর বয়স না হলে কেউ দেহব্যবসায় আসতে পারেন না৷ যৌনকর্মীদের যাতে কোনো যৌনরোগ না হয়, কিংবা তাঁদের মাধ্যমে খদ্দেরদের মাধ্যে যাতে এইডস, সিফিলিস বা অন্য কোনো রোগ ছড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়৷ অবশ্য শুধু সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতে নয়, জার্মানিতেও ঐ একই নিয়ম৷
ছবি: AFP/Getty Images
গ্রিস এবং তুরস্কে পতিতাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত
গ্রিস এবং তুরস্কেও পতিতাবৃত্তি পুরোপুরি বৈধ, তবে দেহ ব্যবসার আইন খুব কঠিন৷ জার্মানির মতো এই দু’টি দেশেও যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যবীমা করা বাধ্যতামূলক৷ এছাড়া যৌনকর্মীরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান কিনা, তা সবসময় তদারক করা হয়৷ স্বাস্থ্যকার্ডেই লেখা থাকে স্বাস্থপরীক্ষার সব তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Vennenbernd
যে দুই দেশের পতিতাপল্লীতে ধীরে চলা মানা
ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের পতিতাপল্লী বা ‘রেড লাইট জোন’-এর প্রায় সব আইনই জার্মানির মতো ছিল৷ তবে সম্প্রতি ব্রিটেনে কিছু বেসরকারি সংস্থার দাবিতে এতে নতুন কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে৷ ব্রিটেনের রেড লাইট জোন-এ এখন যেমন ধীরে গাড়ি চালানো নিষেধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কাউকে জোর করে পতিতা বানানো যায় না
ইউরোপের সব দেশেই পতিতাবৃত্তি আইনত বৈধ৷ তবে আইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশভেদে একটু হলেও অন্যরকম৷ যেমন স্পেন এবং পর্তুগালেও দেহব্যবসা বৈধ৷ কিন্তু স্পেনে কাউকে জোর করে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনকর্মী বানানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় অন্যরূপ
দক্ষিণ অ্যামেরিকার অধিকাংশ দেশেই যৌনব্যবসা বৈধ৷ তবে কিছু দেশে মাফিয়া এবং মানবপাচার বড় সমস্যা হয়ে ওঠায়, এই ব্যবসার ওপর কড়াকড়ি এবং তদারকি বেড়েছে৷ দেহব্যবসাকে মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে রয়েছে কঠোর আইন৷ তারপরও দেশ দু’টিতে মাফিয়া চক্রের আধিপত্য রয়ে গেছে৷
ছবি: Yasuyoshi Chiba/AFP/Getty Images
প্রতিবেশী হয়েও নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া আলাদা
নিউজিল্যান্ডে যৌনব্যবসা একেবারেই বৈধ৷ তবে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়ার অনেক রাজ্যে এই ব্যবসা এখনো অবৈধ৷ ২০০৩ সালে আইন করে সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যৌনব্যবসাকে বৈধ করে দেয় নিউজিল্যান্ড৷
ছবি: picture-alliance / rolf kremming
এশিয়ায় লুকোনো পতিতাবৃত্তি
ভারতের পতিতাবৃত্তি বৈধ৷ তারপরও পতিতাবৃত্তি চলে আড়ালে-আবডালে৷ রাস্তায় নেমে পতিতারা খদ্দের সংগ্রহ করতে পারেন না৷ খদ্দেররা অর্থের বিনিময়ে যৌনক্ষুধা মেটাতে যায় রাতের আঁধারে৷ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে পতিতালয় কমলেও মাসাজ পার্লার এবং আবাসিক হোটেলে প্রায়ই চলে পুলিশি অভিযান৷ খদ্দেরসহ পতিতা আটকের খবর আসে তখন৷ থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্সে পতিতাবৃত্তি চলে অবাধে৷ তবে দেশ দুটিতে এই ব্যবসা আইনের চোখে অবৈধ৷