1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বাংলাদেশ হাঁটছে পিছন দিকে’

ডা. ইমরান এইচ সরকার২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একটি গুমোট সময় পার করছি - সন্দেহ নেই৷ যে ফেব্রুয়ারি মাস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গর্জে ওঠা বাঙালির অনন্য আত্মত্যাগের মাস, বইমেলার উৎসবে প্রাণে প্রাণ মেলানো ফাল্গুনের মাস - ক্রমেই তা শোকের পাথরে ভারি হয়ে উঠছে৷

Blogger Avijit Roy ###ACHTUNG SCHLECHTER QUALITÄT###
ছবি: Privat

এ যেন চিরাচরিত বাঙালির উৎসবের বসন্ত নয়; বরং শোকের মাতমে, সহযোদ্ধা হারানোর যন্ত্রণায় আর বিচারহীনতার কিংবা প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে-প্রতিবাদে জাজ্বল্যমান এক অন্য বসন্ত৷ ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি মাসের একেকটি তারিখ কী ভীষণ রক্তাক্ত আর ক্ষত-বিক্ষত৷ শাহবাগ থেকে শহিদ মিনার, টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর — সবখানেই কী এক পাথর চাপা শোক৷ এই শোক আমাদের প্রতিটি পদবিক্ষেপ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে, চোখ থেকে চোখে সঞ্চারিত হচ্ছে দারুণ ক্রোধে এবং জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে চেতনার মোমবাতি আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে এবং সর্বশেষ আমাদের এনে দাঁড় করাচ্ছে সেই ন্যায্য প্রশ্নটির সামনে— এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার আমরা কবে পাবো?

অভিজিতের উপর এইখানে হামলা করা হয়ছবি: DW

বছর ঘুরে আসছে ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি; ২০১৫ সালের এই দিনে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি'র জনবহুল চত্বরেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় লেখক অভিজিৎ রায়কে৷ গুরুতর আহত হন তাঁর জীবনসঙ্গী বন্যা আহমেদ৷ এই এক বছরে অভিজিতের হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছি আমরা, তাঁর সহযোদ্ধারা৷ সন্তান হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে সেই আন্দোলনে স্থির-অবিচল আর দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটেছেন শিক্ষাবিদ ড. অজয় রায়৷ কিন্তু এক বছরেও এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা করতে পারেনি রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ উপরন্তু বিচারহীনতার সুযোগে ২০১৫ সালেই একের পর এক হত্যা করা হয়েছে মুক্তচিন্তার লেখক-প্রকাশকসহ আমাদের পাঁচজন সহযোদ্ধাকে, হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তিনজনকে৷ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ কোন পথে দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে এক তীব্র সংশয়ের দোলাচল কাজ করছে প্রতিটি মানুষের মাঝেই৷ সারা পৃথিবী যেখানে বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, জাতি ও সম্প্রদায়গত বিভেদ ভুলে নতুন পৃথিবী গড়ার ডাক আসছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে, সেখানে বাংলাদেশ কোথায়? এখনও বাংলাদেশে ধর্মের নামে মানুষ হত্যার বিভৎস উৎসব চলছে৷ কথায় কথায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা হচ্ছে৷ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ' কেবলই একটি কাগুজে শব্দবন্ধ ছাড়া কিছুই না৷ প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমে যে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠছে, তা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়; বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে রক্তাক্ত করে মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী৷ যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলছে এবং অনেকগুলো রায় বাস্তবায়িতও হয়েছে, তবুও জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি এখনও পূরণ হয়নি৷ যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে এখনও অবধি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি রাষ্ট্র৷ এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বদৌলতেই যুদ্ধাপরাধী ও দেশবিরোধী সংগঠন জামাত-শিবির দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে৷ একের পর এক মুক্তমনের চিন্তাশীল মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে সারা দেশে তারা স্থাপন করছে কূপমণ্ডুকতার স্থবির ও কুৎসিত নজির৷ কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদের বেশি দূর যেতে হবে না৷ এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তৎপরবর্তী রাষ্ট্রীয় ভূমিকাগুলোই যথেষ্ট৷ পুলিশের নাকের ডগার উপর ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা পুলিশ করতে পারে নি৷ তাহলে আমরা কী ধরে নেবো— বাংলাদেশের পুলিশ অদক্ষ? না কি তাদের মানসিকতাটাই অনেকটা জেগে ঘুমানোর মতো৷ গত বছরের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ কার্যালয়ে জাগৃতি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী ফয়সল আরেফীন দীপনকে হত্যা করে এই মৌলবাদী ও জঙ্গি গোষ্ঠী৷ প্রাথমিকভাবে সিসিটিভির ফুটেজের কথা জানা গেলেও এক সময় পুলিশ এ বিষয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়৷ উপরন্তু সরকার ও পুলিশের নানা পর্যায়ের লোকজন ব্লগারদের সীমারেখা সংক্রান্ত অলৌকিক কিছু সারবত্তাহীন বক্তব্য দিতে থাকে৷ যেন অপরাধী গ্রেফতার বা অপরাধ দমনে কঠোর হওয়ার চেয়ে লেখকদের উপযাজক হিসেবে পরামর্শ দেয়াটাই এদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের এই ধরণের বক্তব্য হত্যাকারীদের জন্যই যেন এক ধরণের গ্রিন সিগনাল৷ অথচ, তাদের বেতন-ভাতা সবই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হয়, কেবল এদের বক্তব্যগুলো আর জনগণের বক্তব্য হয় না৷

হামলায় আহত হন অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদছবি: DW

আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে বাংলাদেশ হাঁটছে না৷ বাংলাদেশ হাঁটছে পিছন দিকে - বর্বর অন্ধকার সময়ের দিকে৷ এর কারণ অনুসন্ধান খুব জটিল কিছু নয়৷ দেশ স্বাধীন হবার পরই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশকে নানাভাবে পশ্চাদপদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল৷ যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলাম ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামি ছাত্র শিবির) স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেবার জন্যে নানা দেশে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে, তাদের লবিং চালিয়েছে৷ ষোলোই ডিসেম্বরের পর মুজিবনগর সরকার যখন দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে, তখন জামায়াতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত আল-বদর, আল-শামসের নরপিশাচরা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনের ষড়যন্ত্র করেছে৷ স্বাধীন দেশে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনে বঙ্গবন্ধু সরকার৷ নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতে ইসলামকে৷ বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে প্রণীত হয় বাহাত্তরের সংবিধান, যাতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন৷ কিন্তু পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আবার থমকে যায়৷ দালাল আইন বাতিলের মধ্য দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া৷ সেনাতন্ত্রের ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় একাত্তরের পরাজিত শক্তি৷ আল-বদরের নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন ছাত্র সংঘ রাতারাতি নাম বদলে হয়ে উঠে ছাত্র শিবির৷ আমাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা শুরু করে বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতি৷ স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছরে এই অপশক্তি ফুলে ফেঁপে এখন এক দানবের আকার ধারণ করেছে৷ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তারা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির বিষ ছড়িয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে করেছে ভূ-লুণ্ঠিত৷ বিএনপি'র ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এরা ক্ষমতায় এসেছে, অপবিত্র করেছে আমাদের মহান জাতীয় সংসদ৷ জঙ্গি অর্থায়নে বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হিসেবে এরা বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে৷ ২০০৮ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু সেই বিচারের আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ না থাকার যে বড় ফাঁদ রয়ে গিয়েছিল, তা ধরা পড়ে কসাই কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পর৷ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে সরকার আইন পরির্বতন করে ত্রিশ লক্ষাধিক শহিদের রক্তের প্রতি তাদের দায় স্বীকার করে কিন্তু জামাত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে নি৷ এই জামাত-শিবির বাংলাদেশে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে৷ জঙ্গি অর্থায়নের মাধ্যমে এরা বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী তৈরি করেছে, যারা হত্যা করছে স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তচিন্তার মানুষদের৷ বিদেশি নাগরিক হত্যার মধ্য দিয়ে বারবার বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন, তেমন এখনও এই হায়েনারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তাদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর-উপাসনালয়ের জায়গা দখল করছে৷ বিভিন্ন ধর্মীয়গুরুদের হত্যা ও আক্রমণ করা হচ্ছে৷ লেখক-প্রকাশকসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে৷ এই হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্য দিয়ে সারা বাংলাকে এরা করে তুলছে অস্থিতিশীল৷ কিন্তু রাষ্ট্র যেন গভীর ঘুমে নিমগ্ন৷ আজ পর্যন্ত অভিজিৎ হত্যকাণ্ডের কোনো ক্লুও তারা খুঁজে পায়নি৷ এতে রাষ্ট্রের মানসিকতাও আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে৷

ডা. ইমরান এইচ সরকারছবি: DW/A. Islam

এ কথা অনস্বীকার্য যে একটি দুঃসময়ের কঠিন পথ ধরে বাংলাদেশ খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে৷ যে স্বপ্ন আর দর্শনের আলোতে আমাদের পথ চলার কথা, সেই আলো নিভিয়ে দিতে উদ্ধত হয়েছে মৌলবাদী, জঙ্গি আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা৷ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রী নীল, অনন্ত বিজয় দাশ বা দীপনরা যে চিন্তা আর দর্শনের প্রদীপ জ্বালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সে-ই বাংলাদেশ নির্মাণের লড়াইয়ে এখনও আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি৷ আমাদের সহযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ কোনোভাবেই বৃথা যাবে না, কারণ তাঁরাই আমাদের চেতনার অবিনাশী বহ্নিমশাল৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ