মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একজন ইসলামিক জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশ৷ মেজর জিয়ার নির্দেশে ওই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে সে৷
বিজ্ঞাপন
আবু সিদ্দিক সোহেল নামে ৩৪ বছরের ঐ জঙ্গি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য বলে জানা গেছে৷ লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যার পেছনে আল-কায়েদা সমর্থিত এই জঙ্গি দলটির হাত রয়েছে বলে আগে থেকেই জানিয়েছিল পুলিশ৷ ওয়ান্টেড তালিকায় ছিল সোহেলের নাম৷ উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ‘‘অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে সোহেল জড়িত বলে সন্দেহ করছি আমরা৷''
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল অভিজিৎ হত্যার সাথে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছে৷ বরখাস্তকৃত সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়ার নির্দেশে সে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
বাংলাদেশে প্রগতিশীলদের প্রাণনাশের হুমকি প্রদান নতুন নয়৷ স্বাধীনতার পরপর একটি কবিতা লেখার জন্য দেশ ছাড়তে হয় একজন কবিকে৷ এখন কেবল হুমকি নয়, খুনও হয় অহরহ৷ কিন্তু এরপরও এসবে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷
ছবি: AFP/Getty Images
দাউদ হায়দার
লেখালেখির জন্য মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকিতে প্রথম বাংলাদেশ ছাড়তে হয় দাউদ হায়দারকে৷ ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতার জন্য স্বাধীনতার পরপর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল মৌলবাদীরা৷ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কবিতাটি প্রত্যাহার করে দাউদ হায়দার ক্ষমা প্রার্থণা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ তিনি গ্রেপ্তার হন৷ মুক্তির পর তাঁকে কলকাতাগামী বিমানে তুলে দেয়া হয়৷ তিনি জার্মানিতে রয়েছেন৷
ছবি: DW/A. Islam
ড. আহমদ শরীফ
দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের শেষের দিকে মৌলবাদীরা মাঠে নামে৷ ওই বছরের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়৷ ড. আহমেদ শরীফও ওই কমিটির সদস্য ছিলেন৷ কমিটির আন্দোলনে চাপে পড়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের দল’ হিসেবে পরিচিত জামায়াত৷ সেই পরিস্থিতিতেই আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমানননার অভিযোগ তোলা হয়৷ জামায়াত এ বিষয়ে সংসদেও কথা বলে৷
ছবি: Khandaker Mohitul Islam
তসলিমা নাসরিন
ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তসলিমা নাসরিনের নামও সেখানে যুক্ত হয়৷ ১৯৯৪ সালে তসলিমা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে৷ আগের বছর প্রকাশিত ‘লজ্জা’ উপন্যাসকে ঘিরেই মৌলবাদী বিভিন্ন সংগঠন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ফাঁসি দাবি করে৷ হত্যার ফতোয়া দিয়ে তাঁর মাথার দামও ঘোষণা করা হয়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
হুমায়ুন আজাদ
‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নামে একটি বইয়ের জন্য ‘প্রথাবিরোধী’ লেখক হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মাঠে নামে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন৷ এর মধ্যে একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় তাঁর উপর হামলা হয়৷ সে বছরেরই আগস্ট মাসে জার্মানির মিউনিখে তাঁর মৃত্যু হয়৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
শাহরিয়ার কবির
সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা নানা ধরণের হুমকির শিকার হয়ে আসছিলেন, তাদের মধ্যে শাহরিয়ার কবির অন্যতম৷ দীর্ঘদিন যাবত তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের হাল ধরে আছেন৷ ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় হওয়ার পর তিনি ও তার সহকর্মীরা অনেকবার হত্যার হুমকি পান৷
ছবি: bdnews24.com/A. Pramanik
জাফর ইকবাল
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং শিক্ষাবিদ জাফর ইকবালকেও নানা সময়ে মৌলবাদীরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী-কে হত্যার হুমকি দেয়৷ এরা আগের বছরও তাঁকেসহ প্রগতিমনা ২০ জনকে হত্যার হুমকি দেয়৷ মৌলবাদীদের হামলায় নিহত হন রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং একেএম শফিউল ইসলাম নামের দু’জন শিক্ষাবিদ ও বেশ কয়েকজন বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু৷
ছবি: DW/M. Mamun
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভায় দাপটের সাথেই ছিলেন৷ হজ নিয়ে করা মন্তব্যের পর তাঁর ফাঁসির দাবিতে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন মাঠে নামে৷ এক পর্যায়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবে পরিচিত এই মন্ত্রী দলীয় পদ, মন্ত্রিত্ব সবই খোয়ান৷
ছবি: DW
সুলতানা কামাল
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হন মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল৷ একটি টেলিভিশন বিতর্কে পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়ে বলা এক কথার পর তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার বা দেশ ছাড়া করার দাবিও জানায় তারা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কেবল হুমকি নয়, খুনও হচ্ছে
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর হুমকি দেয়া শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চ শুরুর পর৷ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে তরুণ-তরুণীরা শাহবাগে আন্দোলন শুরু করলে মঞ্চকর্মীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে হুমকি দেয়া শুরু হয়৷ এর মাঝে খুন হন মঞ্চকর্মী রাজিব হায়দার৷ একে একে নিহত হন অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয় ও দীপনসহ অনেকে৷ হুমায়ুন আজাদসহ প্রায় সব হামলায়ই ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP
বাঁচার জন্য দেশত্যাগ
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার লালমাটিয়ায় হামলা হলেও প্রাণে বেঁচে যান ‘শুদ্ধস্বর’-এর আহমেদুর রশীদ টুটুল৷ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও আতঙ্কে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরতে পারেননি৷ এক পর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়েন৷ তাঁর সঙ্গে আহত হওয়া ব্লগার তারেক রহিমও ওই সময় দেশত্যাগ করেছিলেন৷ গত ৩-৪ বছরে আরও অনেক ব্লগার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন৷
ছবি: DW/A. Islam
10 ছবি1 | 10
অভিজিৎ রায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক৷ ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়কে৷ ওই সময় তাঁর সঙ্গে থাকা স্ত্রী বন্যা আহমেদও হামলার শিকার হয়ে একটি আঙুল হারান৷
ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সোহেলকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাসুদুর রহমান৷ রবিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলায় মুক্তচিন্তার ব্লগার, নাস্তিক, বিদেশি এবং সংখ্যালঘু নিহত হয়েছেন৷ এর মধ্যে অভিজিৎ হত্যাসহ বেশ কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছিল আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট৷ যদিও বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলে আসছে, কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী এ সমস্ত হামলার পেছনে জড়িত নয়৷ দেশের ভেতরের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনই এ সব হামলা চালিয়েছে৷
অভিজিৎ হত্যার পর শাহবাগ থানায় তাঁর বাবার দায়ের করা মামলায় এর আগে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ গত বছর ১৯ জুন হত্যাকাণ্ডের ‘প্রধান সন্দেহভাজন' মুকুল রানা ওরফে শরিফুল খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন৷