অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরকারের নীতি নির্ধারকরা নীরব কেন?
৬ মার্চ ২০১৫গত ২৫ই ফেব্রুয়ারি রাত ন'টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন অভিজিৎ রায়৷ তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর আহত হয়ে এখনো চিকিত্সাধীন৷ হত্যাকাণ্ডের পরের দিন অভিজিৎ রায়ের বাবা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড.অজয় রায় এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জঙ্গি এবং উগ্রবাদীদের দায়ী করেন৷ তখন তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত তা বের করা পুলিশের জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়৷ আমি এ জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করছি৷''
এরপর সরকারের আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া সরকারের নীতি নির্ধারকরা এ নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেননি৷ সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল কেউই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেননি৷
তবে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ছাত্র-শিক্ষক, লেখক ও সাহিত্যিকসহ সব শ্রেণির মানুষ৷ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়৷ সেখানে সরকারের নীতিনির্ধারকদের নীরবতারও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে৷
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন হিসেবে অভিজিতকে হত্যার হুমকি দেয়া ফারাবীকে আটক করা হয়েছে৷ রানা নামের আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের একজনকে খুঁজছে পুলিশ৷ তবে হত্যাকারী কারা তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত নয় গোয়েন্দারা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অভিজিৎ হত্যার পর সরকারের নীতি নির্ধারকদের নীরবতায় আমি বিস্মিত৷ সরকারের মধ্যে এক ধরনের পলায়নপর মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘যারা এই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন, সেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এই সরকারের সরব অবস্থান আমরা আগে দেখেছি৷ কিন্তু অভিজিৎ হত্যার ব্যাপারে তারা সরব হচ্ছেন না৷''
ফাহমিদুল হক বলেন, ‘‘আমরা এর আগে দেখেছি ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর হেফাজতে ইসলামের চাপের মুখে সরকার উলটে ব্লগারদেরই আটক করেছে৷ সরকার ওই গোষ্ঠীকে চটাতে চায়নি৷ এবারও সেরকম কিছু হয়ে থাকতে পারে৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘এখন সরকার-বিরোধী আন্দোলন চলছে, সরকার হয়তো চাইছে না অভিজিৎ হত্যার ব্যাপারে সরব হয়ে নতুন কোনো ঝামেলায় পড়তে৷''
ফাহমিদুল হক আরো বলেন, ‘‘এই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো বর্তমান সরকারের বিরোধী৷ তাই তাদের ছাড় দেয়া উচিত না সরকারের৷ সরকার হয়তো আন্তরিকভাবেই চাইছে অভিজিৎ হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে৷ কিন্তু সরকার ধর্মীয় বিষয়টিও বিবেচনায় নিচ্ছে৷ কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা – এ সব বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার না হলে আমাদের জন্য ক্ষতিকর'', বললেন ফাহমিদুল হক৷
আর লেখক ও ব্লগার বাঁধন অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা কেন নীরব, সেটা সরকারই ভালো বলতে পারবে৷ আমি ঠিক জানি না৷ তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘ইসলাম বনাম সেকুলারিজম'-এর কথিত দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছে৷ এদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে রাজনীতি, নিজের স্বার্থে৷'
তিনি বলেন, ‘‘ব্লগার অভিজিতকে হত্যা করে ধর্মীয় চরমপন্থিদের ভীতি ছড়ানোর সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি সরকারের তরফেও সুযোগ রয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে ধর্মীয় চরমপন্থিদের বিরোধিতায় নিজেদের যুক্ত করে আর সব ইস্যুকে দূরে সরিয়ে দেয়ার৷''
‘‘এই সরকার নিজেদের সেকুলার দাবি করে, অভিজিৎ নিজেও সেকুলার ছিলেন৷ তাই দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই৷ কোনো অজুহাতেই হত্যাকাণ্ড জায়েজ হতে পারে না৷ মত প্রকাশের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত৷''
ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রধান যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অভিজিৎ হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি৷ আশা করি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অতি দ্রুত চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে পারব৷'' তিনি বলেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গোয়েন্দা বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে৷ আমাদের ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই৷ যারা জড়িত বলে প্রমাণ হবে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে৷ তারা কোন গোষ্ঠী বা দলের তা আমাদের বিবেচ্য নয়৷ আমরা অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখি৷''
এদিকে বৃহস্পতিবার থেকে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তে সহায়তার কাজ শুরু করেছেন ঢাকায় আসা এফবিআই-এর এজেন্টরা৷ তারা শুক্রবার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল টিএসসি ছাড়াও বাংলা একাডেমি এবং আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেছেন৷ তারা আরো দু'একদিন ঢাকায় অবস্থান করে তদন্তের একটি গাইড লাইন এবং সহায়তার ক্ষেত্র ঠিক করবেন৷
মনিরুল ইসলাম জানান, অভিজিৎ রায় যেহেতু একই সঙ্গে মার্কিন নাগরিক তাই সে দেশের পুলিশও সেখানে একটি মামলা করবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় আসা এফবিআই এজেন্টরা৷