ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার একবছর হয়ে গেলেও কারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তা সুনির্দষ্ট করে বলতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থা৷ এ পর্যন্ত আটজনকে আটক করা হলেও, তারাই সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিনা – তা নিশ্চিত নয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বিজ্ঞাপন
গত বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে বের হন রাত ন'টার সময়৷ তাঁরা পায়ে হেঁটে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-র উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের মূল গেটের উত্তর দিকে পৌঁছালে দুর্বত্তরা তাঁদের ওপর হামলা চালায়৷ দুবৃত্তদের ধারল অস্ত্রের আঘাতে অভিজিৎ নিহত হন আর তাঁর স্ত্রী বন্যা গুরুতর আহত হন৷ এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান বন্যা৷
প্রথমে এই মামলাটির তদন্ত শুরু করে শাহবাগ থানা পুলিশ৷ তবে কয়েকদির পরই মামলার তদন্তভার এসে পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) ওপর৷ মামলাটির তদন্তের সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন ডিএমপি-র কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এখনও পর্যন্ত এই মামলায় আটজনকে আটক করা হয়েছে৷ আর আলামত রয়েছে ১১ ধরনের৷ কিন্তু মামলায় নির্ভর করার মতো কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষী পাওয়া যায়নি৷ এছাড়া এ মুহূর্তে মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া বলতে গেলে থেমেই আছে৷ কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলামতের ফরেনসিক রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি৷ ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার পর আটক আটজনের ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে তা মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, আসলেই তারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিনা৷''
মনিরুল ইসলাম
This browser does not support the audio element.
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে আরো জানান, ‘‘আমরা যে আটজনকে আটক করেছি, তাদের নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই আটক করা হয়েছে৷ তাছাড়া আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত৷ আটক ব্যক্তিরা সেই টিমেরই সদস্য৷ আটককৃতরা এখনো হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি, এটা ঠিক৷ তবে তাদের আগের রেকর্ড থেকে আমরা ধারণা করেছি যে, তারা কোনো না কোনোভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত৷ অবশ্য সরাসরি জড়িত কিনা, তা নিশ্চিত হতেই ফরেনসিক রিপোর্ট লাগবে৷''
তিনি জানান, ‘‘আমরা মোট ১১ ধরনের আলামত পেয়েছি৷ আর সমস্ত আলামতই যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই-এর ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছি আদালতের অনুমতি নিয়ে৷ এ সব আলামতের বেশ কিছু অবিকল অবস্থায় নেই, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে মিশে গেছে৷ তবে আমরা একটা ‘ব্যাকপ্যাক' পেয়েছি, যেটা অবিকল আছে৷ আশা করছি ফরেনসিক পরীক্ষায় তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে৷''
তদন্তকারী সংস্থার এই কর্মকর্তা আরো জানান, ‘‘অভিজিৎ হত্যায় সাক্ষী হিসেবে কাজে লাগানোর মতো কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি৷ যে দু-একজনকে পাওয়া গেছে তারা অপরাধীদের চেহারার বর্ণনা দিতে পারেননি৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দুবৃত্তরা পালিয়ে যাওয়াতেই এ রকম হয়েছে৷''
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, বিচারের দাবি
বইমেলা থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: DW
যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাথ৷ লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নিহত হবার এই জায়গাটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷
ছবি: DW
বেঁচে গেছেন বন্যা
হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ দুষ্কৃতিকারীরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করলেও প্রাণে বেঁচে যান অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এই ব্লগার৷ বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি৷
ছবি: DW
নির্বাক অজয় রায়
ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়৷ আজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন৷
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা দেশে থাকা অবস্থায় অভিজিতের আহত স্ত্রী বন্যার জবানবন্দি নিয়েছি৷ তবে তিনি ঐ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কারুর চেহারা মনে রাখার মতো অস্থায় ছিলেন না বলেই আমাদের জানিয়েছেন৷ তাছাড়া অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি যে, তিনি মনে করেন লেখালেখির কারণেই অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে৷ কিন্তু সুনির্দষ্টভাবে তিনিও কাউকে সন্দেহ করছেন না৷''
এই হত্যা মামলার তদন্তে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সহযোগিতা দিচ্ছে শুরু থেকেই৷ তাদের সহযোগিতা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে৷ তবে তাদের সহযোগিতা শুধুমাত্র মামলার আলামত পর্যবেক্ষণ, ফরেনসিক টেস্ট এবং ডিএনএ প্রোফাইলিং-এর ক্ষেত্রে কাজে দিচ্ছে৷ এর ভিত্তিতে অপরাধীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিন্তিত করতে হবে বাংলাদেশের তদন্তকারীদেরই৷
মামলা তদন্তে ধীর গতি বা ব্যর্থতার প্রশ্নে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা ব্লগার রাজিব হত্যার সঙ্গে জড়িদের চিহ্নিত করেছি৷ এরইমধ্যে আদালত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে৷ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু ছাড়া বাকি সব ব্লগার হত্যা মামলারও তদন্ত শেষে চার্জশিট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ আশা করছি অভিজিৎ হত্যা মামলাও আমরা ‘ডিটেক্ট' করতে পারব৷ কারণ আমরা নিশ্চিত যে, এটা ঐ একই উগ্রপন্থি গ্রুপ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমেরই কাজ৷ এমনকি এফবিআই-ও মনে করে উগ্রপন্থিরাই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত৷''
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হচ্ছে না কেন? জানান আপনার মতামত, নীচের ঘরে৷
জার্মানি ঘুরে গেলেন ব্লগার বন্যা আহমেদ
ডয়চে ভেলের দ্য বব্স অ্যাওয়ার্ড নিতে সম্প্রতি জার্মানি ঘুরে গেছেন ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যা, বাংলাদেশে যিনি পরিচিত বন্যা আহমেদ নামে৷ ঢাকায় দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ সফর৷
ছবি: DW/M. Müller
জার্মানিতে বন্যা
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হন নাস্তিক ব্লগার, লেখক ড. অভিজিৎ রায়৷ তবে হামলায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ৷ বন্যা মনে করেন, ধর্মীয় মৌলবাদীরা সেই হামলা চালিয়েছিল৷ গত ২০ জুন জার্মানিতে আসেন তিনি৷
ছবি: DW/M.Magunia
মুক্তমনাদের মিলন
চলতি বছর ঢাকায় নিহত তিন ব্লগারের মধ্যে দু’জনই ছিলেন মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ স্বভাবতই এরপর মুক্তমনা ব্লগারদের মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ তবে সেই আতঙ্ককে পাশ কাটিয়ে রেখে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা৷ শুধু নিজেদের পরিচয় গোপন রাখছেন৷ বন্যার সঙ্গে জার্মানিতে দেখা করেছেন এ রকম কয়েকজন ব্লগার৷ ছবিটি তুলেছেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম৷
ছবি: Instagram/shahidul001
অন্য বিজয়ীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ
বন্যার জার্মানি সফরের মূলে ছিল ডয়চে ভেলের দ্য বব্স অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করা৷ এ বছর তাঁর এবং অভিজিতের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সামাজিক পরিবর্তন বিভাগে জুরি অ্যাওয়ার্ড জয় করে মুক্তমনা ব্লগ৷ জার্মানি সফরের দ্বিতীয় দিনে বন্যা দেখা করেন দ্য বব্স-এর অন্যান্য বিজয়ী এবং টিমের সঙ্গে৷
জাহাজে আড্ডা
শারীরিকভাবে এখনো দুর্বল বন্যা৷ দুর্বৃত্তরা এলোপাথাড়ি কুপিয়েছেন তাঁকে৷ মাথায় কোপের ক্ষতগুলো দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তাঁকেও হত্যা করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য৷ তবে মানসিকভাবে আজ আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী বন্যা৷ জুনের ২৩ তারিখ ডয়চে ভেলের আয়োজনে নৌভ্রমণে অংশ নেন তিনি৷ তখন আলোচনায় উঠে আসে এ সব বিষয়৷ ছবিতে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে বন্যা৷
ছবি: DW/A.Islam
অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণ
জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে একটি অনুষ্ঠানে দ্য বব্স বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়৷ বব্স-এর বাংলা ভাষার জুরি ড. শহিদুল আলম বন্যার হাতে পু্রস্কার তুলে দেন৷ এ সময় তিনি বলেন, ‘‘মুক্তমনা ছিল অভিজিতের গর্ব এবং আনন্দ৷ এই অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে পারলে তাঁর চেয়ে সন্তুষ্ট কেউ হতে পারত না৷’’
ছবি: DW/M. Müller
টিম সেলফি
বন্যা সেলফি তুলতে পছন্দ করেন না৷ তারপরও ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের জোরাজুরিতে রাজি হন তিনি৷ ছবিতে বাংলা বিভাগের বর্তমান এবং প্রাক্তন কর্মীরা ছাড়াও রয়েছেন ডয়চে ভেলের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর গ্যার্ডা ময়ার৷
ছবি: DW/A.Islam
ফিরে যাওয়া
ডয়চে ভেলের মহাপরিচালক পেটার লিমবুর্গ একাধিকবার কথা বলেছেন ব্লগার বন্যা আহমেদের সঙ্গে৷ বন্যার সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন সবাই৷ ২৫শে জুন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন তিনি৷