ভূমধ্যসাগরে বিপদে পড়া অভিবাসীদের সহায়তা করা সংস্থাগুলোকে জার্মানির অর্থায়ন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ইটালি৷ বার্লিনের এমন পদক্ষেপ রোমের জন্য ‘ক্ষতিকর' বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷
বিজ্ঞাপন
লিবিয়া, টিউনিশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে অভিবাসীদের আগমন ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায় ইটালি৷ এক্ষেত্রে অভিবাসীদের সহায়তা করা সংস্থাগুলোকে বাধা বলে মনে করে আসছে ক্ষমতাসীন ডানপন্থি সরকার৷ তাদেরকে অর্থায়নে নেয়া একটি প্রকল্প নিয়ে বার্লিনের উপরও নাখোশ রোম৷ এর মাধ্যমে জার্মানি ইটালির জন্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইডো ক্রোসেট্টো৷ ইটালির মাটিতে অভিবাসীদের দেখভালের জন্য অর্থায়নকে রোম অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ হিসেবেও বিবেচনা করছে৷
দেশটির দৈনিক লা স্টাম্পাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মানবপাচারকারীদের ঠেকাতে তার সরকার বদ্ধপরিকর৷ তিনি এর সঙ্গে জড়িতদের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধী' হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন৷
তিনি বলেন. ‘‘বার্লিন এটি না বোঝার ভান করছে৷ তারা একটি দেশের জন্য এমন সমস্যা তৈরি করছে যে আসলে তাদের বন্ধু হওয়া উচিত৷''
অভিবাসন নিয়ে তথ্যচিত্র- ভূ'মৃত্যু'সাগরের ওপারে
31:43
তবে জার্মানি এই বিষয়ে আগেই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক জানিয়েছেন, সমুদ্র থেকে মানুষকে উদ্ধার করাকে ‘আইনি, মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব' বলে মনে করে বার্লিন৷
অভিবাসীদের সহায়তার বিষয়ে শুক্রবার জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন এই বিষয়ক প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত দেশটির পার্লামেন্টের৷ এই প্রকল্পের প্রথম কিস্তিতে চার লাখ থেকে আট লাখ ইউরো ছাড় করা হবে৷ ভূমিতে অভিবাসীদের দেখভাল করা এবং সমুদ্র থেকে তাদের উদ্ধারে এই অর্থ ব্যয় করা হবে৷
যে সংগঠনগুলো এই টাকা পেতে যাচ্ছে তার একটি ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীদের সহায়তাকারী সংস্থা এসওএস হিউম্যানিটি৷ শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা জার্মান সরকারের কাছ থেকে সাত লাখ ৯০ হাজার ইউরোপ পেতে যাচ্ছে৷
ইটালির সরকারের হিসাবে নৌকায় করে চলতি বছর এখন পর্যন্ত এক লাখ ৩২ হাজার জন ইটালি পৌঁছেছেন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬৯ হাজার৷
অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকা ইটালির সরকার চলতি সপ্তাহে জানিয়েছে অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা আটককেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশপাশি বন্দি রাখার সময়সীমা বাড়াবে৷
সুরক্ষা প্রাপ্তির আবেদনের প্রক্রিয়া চলাকালে অর্থের বিনিময়ে অভিবাসীরা বন্দিদশা এড়াতে পারবেন এমন একটি নিয়মও আরোপ করা হয়েছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো যা নিয়ে কড়া সমালোচনা করছে৷
জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার বলেছেন, শরণার্থীর সংখ্যা ইতিমধ্যে জার্মানির সামর্থ্যের শেষসীমা ছুঁয়েছে৷ এক সাক্ষাৎকারে অভিবাসনপ্রত্যাশী রুখতে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের কথাও বলেন তিনি৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Markus Schreiber/picture alliance/AP/dpa
শরণার্থী ও আশ্রয় আবেদনের চাপ
ইউরোপীয় শরণার্থী সংস্থা বলছে, ইইউভুক্ত সব দেশ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত যত আশ্রয় আবেদন জমা পড়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশই জার্মানিতে৷ জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত শুধু ইউক্রেন থেকেই এসেছেন প্রায় ১১ লাখ আশ্রয়প্রার্থী৷ এছাড়া, আরো দু’লাখ আশ্রয় আবেদন জমা পড়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৭ শতাংশ বেশি৷
ছবি: Adam Berry/Getty Images
আবাসন ও অন্যান্য সংকট
জার্মানিতে আসা বহু আশ্রয়প্রত্যাশী ও শরণার্থীকে থাকার জন্য বাসা দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ৷ অস্থায়ী আবাসনগুলিতে থাকা কষ্টকর৷ ফুলদায় যেমন শরণার্থীদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ৷ নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা শিশুদের দেখভাল করার পরিষেবাও৷ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫-১৬ সালে আসা আশ্রয়প্রত্যাশীদের অন্তত ২৫ শতাংশ এখনও প্রাথমিক আবাসনেই থাকেন৷ ফলে নতুনদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকছে না৷
ছবি: Ying Tang/NurPhoto/imago images
কেন এত চাপ জার্মানিতে
ইটালি বা স্পেনে আসা আশ্রয়প্রত্যাশীদের একটা বড় অংশ ইইউ’র নিয়ম অনুযায়ী সেখানে আবেদন না করে চলে আসেন জার্মানিতে৷ জার্মানিতে শুরু হয় আশ্রয় লাভের প্রক্রিয়া৷
ছবি: Nicolas Economou/NurPhoto/picture alliance
আবেদন-জট
জার্মানিতে যত আশ্রয়ের আবেদন জমা পড়ে, তার অর্ধেকেরও কম আবেদন গৃহীত হয়৷ যাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাময়িকভাবে থাকার অনুমতি (ডুলডুং) পান৷ ফেরত পাঠানো উচিত, এমন প্রায় ৯৫ হাজার আবেদনকারীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না জার্মান কর্তৃপক্ষ৷ এ কারণে তাদের অন্য কোথাও পাঠাতেও পারছে না৷
ছবি: Markus Schreiber/picture alliance/AP/dpa
অভিবাসনপ্রত্যাশী রুখতে সীমান্তে কড়াকড়ি
বুধবার ইটালির ‘কোরিয়েরে দেলা সেরা’ পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নতুন অভিবাসনপ্রত্যাশীদের রুখতে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের কথা বলেছেন জার্মানির প্রেসিডেন্ট৷ এর আগে জার্মানির ফ্রি ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও এ প্রস্তাব দেয়৷ ডানপন্থি ক্রিশ্চিয়ান সোশাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) মনে করে, শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ ভাতা কমানো উচিত, যাতে নিশ্চিত আয়ের কথা ভেবে আরো বেশি আশ্রয়প্রার্থীরা জার্মানিতে না আসেন৷
ছবি: Sascha Schuermann/Getty Images
কেন বাড়ছে আশ্রয়ের আবেদন
ইউরোপের দেশগুলিতে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার খামতির পাশাপাশি জার্মান কর্তৃপক্ষকে আরো চিন্তিত করছে আশ্রয়প্রার্থীদের উৎস৷ জার্মানিতে সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রয় পাওয়াদের বড় একটা অংশই এসেছেন সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরানের মতো দেশ থেকে৷ এসব দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যত কঠিন হবে, তত বেশি বাড়বে দেশ ছেড়ে ইউরোপ পাড়ি দেবার ঝোঁক৷
ছবি: Ssgt. Emma James/U.S. Air/Planet Pix via ZUMA Press Wire/picture alliance
আইন বদলের ভাবনা
জার্মান সংবিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার সবার আছে৷ কিন্তু আইনের মানবিক দিক মাথায় রাখলেও বর্তমান সংকটকে মোকাবিলা করতে বেগ পাচ্ছে জার্মানি৷ তাই ইইউ শরণার্থী নীতিতে বদল আনতে চায় তারা৷ যাদের আবেদন গৃহীত হবার সম্ভাবনা কম, তাদের সীমান্ত থেকেই ফেরত পাঠাতে চায় জার্মানি৷ বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন বা ইইউ নীতিমালায় এর অনুমোদন নেই৷