একটি নতুন জরিপ থেকে সেই তথ্যই জানা গেছে: অভিবাসী শিশু-কিশোরদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বোধ করে৷ সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ব্যবহারেও নাকি তা প্রকাশ পায়৷
বিজ্ঞাপন
আনিয়া আর্সলান-কেই ধরা যাক৷ তুর্কি অভিবাসীদের সন্তান আনিয়া কোলোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেছেন, পরে মিডিয়া কালচার নিয়ে ডক্টরেট করেছেন৷ জাতিতে তুর্কি হওয়ার দরুন যে তাঁর প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে, এ অনুভূতি তাঁর স্কুলজীবন থেকেই আছে৷ ‘‘খুবই কষ্ট পেয়েছি,'' আজও মনে পড়লে বলেন আনিয়া৷
বিশেষ করে একটি ধারণা তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না৷ সেটি হল: অভিবাসীরা নাকি ভালো জার্মান বলতে-লিখতে পারে না৷ জার্মানদের সম্বন্ধে কিন্তু এ ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করা হয় না৷ ওদিকে কারো জার্মান ভাষাজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার জন্য তার বিদেশি নাম, কিংবা উচ্চারণে সামান্যতম টানই যথেষ্ট৷
বৈষম্যবোধ
আনিয়া আর্সলান বারংবার এ ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন৷ তাঁর অভিজ্ঞতা হল, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নেন ঠিকই, কিন্তু ‘বৈষম্য' কথাটি ব্যবহার না করে৷ অথচ এই বৈষম্যবোধ শুধু আনিয়ার একার নয়৷ স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে যারা অভিবাসী পরিবার থেকে এসেছে, তাদের এক-চতুর্থাংশ জার্মান শিক্ষাপদ্ধতিতে তাদের প্রতি সমান আচরণ করা হচ্ছে বলে মনে করে না৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
যে জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে, সেটি প্রকাশ করেছে জার্মান ফেডারাল সরকারের বৈষম্য প্রতিরোধ কার্যালয় (এডিএস)৷ শুধু অভিবাসীদের সন্তানরাই নয়, প্রতিবন্ধী ও সমকামীরাও বৈষম্য এবং অপমানজনক কথাবার্তার কথা বলেছে৷ এ সবই রয়েছে খোদ জার্মান সংসদের কাছে পেশ করা এডিএস-র রিপোর্টে৷
শিক্ষা অথবা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য সম্পর্কে এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ইতিপূর্বে জার্মানিতে প্রকাশিত হয়নি, বলছে এডিএস স্বয়ং৷ এডিএস-এর অধ্যক্ষা ক্রিস্টিনে ল্যুডার্স বলেছেন: ‘‘বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য আছে৷ সূক্ষ্ম ধরনের বৈষম্য হলো, যখন একজনকে নানাভাবে বারংবার অপমান করা হয়৷'' শারণ্য বার্লিনের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী, তার বাবা-মা এসেছেন শ্রীলঙ্কা থেকে৷ রাস্তায় বেরলে শুধু তার গায়ের রঙের জন্য তাকে ‘হ্যালো, চকোলেট!' বলে অভিবাদন জানানো হয়৷
শিক্ষাক্ষেত্রে কাঠামোগত বৈষম্য
জার্মানির শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইমারি স্কুল থেকে ‘গিমনাজিয়ুম' বা হাইস্কুলে যাবার যোগ্যতা কোনো ছাত্রছাত্রীর আছে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেন ক্লাস টিচার৷ সে ক্ষেত্রেও দেখা যায়, দু জন ছাত্রছাত্রীর মার্কস এক হলেও, অভিবাসী ছেলে কিংবা মেয়েটির পরিবর্তে ‘খাঁটি' জার্মান ছেলে কিংবা মেয়েটিকেই গিমনাজিয়ুমে পাঠানো হয়৷
মুশকিল এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার পথ ঐ গিমনাজিয়ুমের মাধ্যমেই৷ কাজেই এক হিসেবে প্রাইমারি স্কুলের শেষেই অভিবাসী শিশুটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যাচ্ছে৷ অপরদিকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানেন – এবং বলেন, হাইস্কুলের পড়াশুনার জন্য বাড়িতে বাবা-মার সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে, যেমন হোমওয়ার্ক করতে৷ অথচ অনেক অভিবাসী বাবা-মায়ের নিজেদেরই স্কুলের শিক্ষা যৎসামান্য, তার ওপর আবার জার্মান ভাষা নিয়ে সমস্যা আছে৷ কাজেই যা প্রয়োজন, তা হলো, হাইস্কুলে অভিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ টিউটোরিয়াল ও কোচিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে৷
অনেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, অভিবাসী ছেলেমেয়েদের সমাজের অঙ্গ করে তোলার ইচ্ছাটা থাকা চাই৷ জার্মানিতে সেটারই অভাব বলে মনে করেন তারা৷ তাঁদের মতে, এমন সব স্কুল তৈরি করা চাই, যেখানে গোড়া থেকেই কোনো ভাষার বেড়া কিংবা প্রতিবন্ধক থাকবে না, যেখানে সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখা হবে৷ এবং সেই ধরনের স্কুলে অবশ্যই এমন সব শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকবেন, যারা নিজেরাই অভিবাসীর সন্তান৷