অভিবাসী ও স্বেচ্ছাসেবীদের অপরাধী বানানোর প্রবণতা বাড়ছে
২৯ এপ্রিল ২০২৫
ইউরোপজুড়ে অভিবাসী এবং তাদের সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবী ও মানবাধিকার কর্মীদের অপরাধীকরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে৷ অভিবাসী অধিকার রক্ষায় কাজ করা সংস্থা পিআইসিইউএম সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে৷
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে লিবিয়া উপকূলে প্রাণ হারানো অভিবাসীদের মরদেহ উদ্ধারের সময় সহযোগিতা দিচ্ছিলেন রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীরা৷ ছবিটি ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তোলা৷ছবি: Mohaned Krema/ROPI/picture alliance
বিজ্ঞাপন
চলতি মাসের ২৩ এপ্রিল প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে দ্য প্ল্যাটফর্ম ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন অন আনডকুমেন্টেড মাইগ্রেন্টস (পিআইসিইউএম)৷
পিআইসিইউএম-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপে অভিবাসন নীতি কঠোর করার ফলে অভিবাসীদের শুধু অনিয়মিতভাবে সীমান্ত অতিক্রমের জন্য নয়, বরং ছোটখাটো সহায়তা দেওয়ার জন্যও মানবপাচার বা চোরাচালানের মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে৷
২০২৪ সালে ইটালি, গ্রিস ও স্পেনে অন্তত ৯১ জন অভিবাসীকে চোরাচালান ও অনিয়মিত অভিবাসনে সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাদের অধিকাংশই সীমান্ত পারাপারে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, যদিও বাস্তবে অনেকেই শুধু যাত্রী ছিলেন৷
এমনই একজন অভিবাসী মাহতাব সাবেতারা গত বছর ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেছিলেন, "আমার বাবা গাড়ি চালিয়েছিলেন৷ এর দায়ে তাকে গ্রিসের কোরিডালোস কারাগারে পাঠানো হয়৷ আমি বাবার গ্রেপ্তারের পর অনেক দিন পর্যন্ত তার খোঁজ পাইনি৷ এটি ছিল অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর৷ কারণ আমরা ভেবেছিলাম তিনি কেবল একটি ক্যাম্পে ছিলেন৷''
পিআইসিইউএম বলছে, অনেক অভিবাসীকে বন্দুকের মুখে অভিবাসীবাহী নৌকা চালাতে বাধ্য করা হয়৷ আবার অনেকেই কেবল ফোনের জিপিএস ব্যবহার করে বা আহত ব্যক্তিকে পানি দেয়ার মতো কাজ করলেও তাদের ‘পাচারকারী' হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে৷
ইইউর যে দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ
উন্নত ভবিষ্যতের আশায় অনেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷ কিন্তু ইইউর কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক আইন না মেনে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Borja Suarez/REUTERS
গ্রিস
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে ইইউতে ঢোকার অন্যতম জনপ্রিয় রুট তুরস্ক হয়ে গ্রিসে প্রবেশ করা৷ এই পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের চাপ কমাতে গিয়ে গ্রিক কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক অনেক আইন লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর৷ গ্রিক কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগের বিষয়ে অনেকসময় চুপ থাকে৷ কখনওনা অভিযোগ অস্বীকার করে৷
ছবি: Griechische Küstenwache/dpa/picture alliance
ক্রোয়েশিয়া
দেশটির সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জোর করে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে৷ এছাড়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মারধর করা ও ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে৷ ক্রোয়েশিয়ার সরকার সাধারণত এসব অভিযোগ অস্বীকার করে৷
ছবি: Elvis Barukcic/AFP/Getty Images
হাঙ্গেরি
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জোর করে হাঙ্গেরি থেকে সার্বিয়া পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ হাঙ্গেরির সরকার প্রকাশ্যেই স্বীকার করে৷
ছবি: Chris McGrath/Getty Images
স্পেন
অভিবাসনপ্রত্যাশীরা আফ্রিকা থেকে স্পেন পৌঁছতে দুটি রুট ব্যবহার করে৷ এক, আফ্রিকার উপকূলের কাছে অবস্থিত ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া৷ দুই, মরক্কো থেকে আফ্রিকায় থাকা স্পেনের দুটি ছিটমহল সেউটা ও মেলিয়ায় যাওয়া৷ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে স্পেনের ভূমি থেকে প্রায়ই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জোর করে মরক্কোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ এসব ঘটনায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে৷
ছবি: Fadel Senna/AFP/Getty Images
ইটালি
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে ইইউতে পৌঁছানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট উত্তর আফ্রিকা থেকে ইটালির ছোট্ট দ্বীপ লাম্পেদুসায় পৌঁছানো৷ ইটালির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার অভিযোগ প্রায়ই ওঠে৷ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ না দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Zakaria Abdelkafi/AFP
ফ্রন্টেক্স
ইইউর সীমান্ত ও উপকূল সুরক্ষার দায়িত্ব এই সংস্থার৷ অন্তত ২০০৯ সাল থেকে এই সংস্থা অবৈধ উপায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ ঐ বছর ফ্রন্টেক্সের কর্মীরা অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকায় উঠে তাদের সেনেগালে ফিরিয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ৷
ছবি: Innenministerium Nord-Mazedonien
6 ছবি1 | 6
সহায়তাকারীদের অপরাধী বানানোর চেষ্টা
প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, ২০২৪ সালে অন্তত ১৪২ জন এনজিও বা অভিবাসন সংস্থার কর্মীকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ তাদের কেউ পানির বোতল দিয়েছেন, কেউ খাবার কিংবা পোশাক দিয়েছেন৷ এমন সহায়তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে৷
গ্রিসে অভিযুক্ত এমন একজন এনজিও কর্মী শন বাইন্ডার ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছিলেন, "আপনি যদি পানিতে কাউকে দেখতে পান এবং তারা যদি বাঁচার জন্য সাহায্য চান, তখন আপনি কী করবেন?”
অনেক মামলার রায় পেতে বছর লেগে যাচ্ছে৷ অভিযুক্তরা তাদের জীবন ও জীবিকা হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।
আইনজীবীরা বলছেন, এটা একটিনতুন ধরনের বিচারিক হয়রানির কৌশল। যেখানে অভিযোগ দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখে অভিবাসী ও সহায়তাকারীদের মানসিকভাবে দুর্বল করা হচ্ছে৷
একজন আইনজীবী ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, "আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন এই আইন বদলাবে৷ তবে সেটা ইউরোপীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷''
পিআইসিইউএম-এর মতে, অভিবাসী এবং মানবিক সহায়তাকারীদের অপরাধীকরণের এই প্রক্রিয়া কেবল মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক কৌশল৷ যার উদ্দেশ্য হলো অভিবাসনের পথকে ভয়ভীতির মাধ্যমে রুদ্ধ করা৷
তবে আশার কথা, অনেক মামলায় আদালত অভিযুক্তদের অব্যাহতি দিয়েছে৷ তবু অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই ধরনের প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার হুমকির মুখে পড়ছে৷
অভিবাসী বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস তিনটি প্রধান ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্বে একটি যৌথ প্লাটফর্ম৷ প্লাটফর্মটিতে রয়েছে জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স মিডিয়া মোন্দ, এবং ইটালিয়ান সংবাদ সংস্থা আনসা৷ এই প্রকল্পের সহ-অর্থায়নে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷
যুক্তরাষ্ট্রে অনিশ্চয়তায় অভিবাসীরা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর আশঙ্কায় দেশটিতে বসবাসরত অনেক অভিবাসী।
ছবি: Carlos Barria/REUTERS
প্রত্যর্পণের ভয়
জানালার পর্দার ফাঁক গলে কয়েকজন পুলিশকে একটি বাড়ির দিকে এগোতে দেখছেন একজন। যদিও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে বাসিন্দাদের অনুমতির প্রয়োজন। কিন্তু তাদের উপস্থিতিতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন অনিয়মিত অভিবাসীরা। জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো হবে -এই ভয়ে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না অনেকে।
চরম অনিশ্চয়তায় অভিবাসীরা
ভেনেজুয়েলা থেকে আসা ২২ বছরের ইতাইলি বলেন "আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে এ নিয়ে আমি বেশ আতঙ্কে দিন পার করছি।" তার ছেলে বন্ধুকে কয়দিন আগেই একটি নিরাপত্তা চৌকিতে আটক করা হয়। ৫ মাসের শিশুসহ জর্জিয়ার আটলান্টায় একটি বাড়িতে বসবাস করছেন ইতাইলি। কিছুদিন আগেই রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন তারা। এর মাঝেই প্রশাসনের সাম্প্রতিক তৎপরতায় অস্থিরতার মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে তাদের।
ছবি: Carlos Barria/REUTERS
পুলিশে নতুন নিয়োগ
অনিয়মিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে সীমান্তবর্তী অনেক রাজ্যেই নতুন করে পুলিশ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আটলান্টা আইসিই পুলিশের কর্মকর্তা ক্রিস্টিন সুলিভান বলেন, "আমাদের অবশ্যই সদস্য বাড়ানো প্রয়োজন।"
ছবি: Carlos Barria/REUTERS
অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ফয়সালা হয় আদালতে, যার উপর নির্ভর করে একজন অনিয়মিত অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারবেন কিনা অথবা তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে কিনা। তবে আদালত আশ্রয় আবেদন খারিজ করে দিলেও যুক্তরাষ্ট্রে তার কোনো অপরাধের রেকর্ড না থাকলে তিনি দেশটিতে থাকতে পারেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায়ই এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ।
ছবি: Carlos Barria/REUTERS
রেকর্ড মাত্রায় গ্রেপ্তার
ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি কতটুকু কঠোর হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে পুলিশের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিদিন অন্তত ৮০০ থেকে এক হাজার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ৩১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে দুই লাখ ৭০ হাজার অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠিয়েছে।