জার্মানিতে প্ল্যাটফর্মে থাকা এক শিশুকে ট্রেনের সামনে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ ইরিত্রিয়ার এক ব্যক্তি এর জন্য দায়ী বলে অভিযোগ৷
বিজ্ঞাপন
এই ঘটনা জার্মান সমাজে আগে থেকেই চালু থাকা বিতর্কের উপর বিশাল প্রভাব ফেলবে, বলে মনে করছেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল৷ এ কারণে গণমাধ্যমে সত্য ঘটনাটি পুরোপুরি প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি৷
সোমবার ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রধান রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল আট বছর বয়সি এক শিশু৷ তাদের দুজনকেই স্টেশনে ঢুকতে থাকা একটি দ্রুতগামী ট্রেনের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল৷ এই ঘটনায় মা কোনোরকমে রেললাইন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারলেও শিশুটি বাঁচতে পারেনি৷
এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু স্টেশনে থাকা অন্য যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলেন৷ এর কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের এক মুখপাত্র জানান, অভিযুক্তের বয়স ৪০ এবং তিনি ঐ মা ও তার সন্তানের পরিচিত ছিলেন না৷ অভিযুক্ত ব্যক্তি ইরিত্রিয়া থেকে এসেছেন বলেও জানা যায়৷
শরণার্থী সংকটের কিছু আইকনিক ছবি
ইউরোপে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশের ছবি গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং মানুষের মতামত সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে৷ অভিবাসন এবং অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তির এত ছবি আগে দেখেনি বিশ্ব৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
লক্ষ্য: টিকে থাকা
অনিশ্চিত যাত্রার ধকল সামলাতে হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে৷ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক তুরস্ক হয়ে গ্রিসে জড়ো হয়েছেন৷ সে দেশের তিনটি দ্বীপে এখনো দশ হাজারের মতো শরণার্থী বসবাস করছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ছয় হাজার নতুন শরণার্থী এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Messinis
পায়ে হেঁটে ইউরোপে
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গ্রিস ও তুরস্ক থেকে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছে৷ ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অর্থাৎ বলকান রুট ব্যবহার করে তাদের এই যাত্রার অধিকাংশই ছিল পায়ে হেঁটে৷ অভিবাসীদের এই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়, যখন রুটটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কয়েকটি দেশ সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷
ছবি: Getty Images/J. Mitchell
বৈশ্বিক আতঙ্ক
এই ছবিটি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ তিন বছর বয়সি সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ তুরস্কে সমুদ্রতটে ভেসে ওঠে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে৷ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরণার্থী সংকটের প্রতীকে পরিণত হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/DHA
বিশৃঙ্খলা এবং হতাশা
শেষ সময়ের ভিড়৷ ইউরোপে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে ক্রোয়েশিয়াতে এভাবে ট্রেনে এবং বাসে উঠতে দেখা যায় অসংখ্য শরণার্থীকে৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে হাঙ্গেরি সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং শরণার্থীদের জন্য কন্টেইনার ক্যাম্প তৈরি করে৷
ছবি: Getty Images/J. J. Mitchell
বিবেকবর্জিত সাংবাদিকতা
হাঙ্গেরির এক সাংবাদিক এক শরণার্থীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার ভিডিও নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ সার্বিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন হাঙ্গেরির একটি এলাকার সেই ঘটনায় আলোচিত সাংবাদিকের চাকুরি চলে যায়৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
উন্মুক্ত সীমান্ত নয়
২০১৬ সালের মার্চে বলকান রুট আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়ার পর সীমান্তগুলোতে আরো আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ হাজার হাজার শরণার্থী বিভিন্ন সীমান্তে আটকা পড়ে এবং তাদের সঙ্গে বর্বর আচরণের খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থান থেকে৷ অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে৷
ধুলা এবং রক্তে ঢাকা এক শিশু৷ পাঁচবছর বয়সি ওমরানের এই ছবিটি প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে৷ আয়লান কুর্দির ছবির মতো এই ছবিটিও গোটা বিশ্বকে আরেকবার নাড়িয়ে দেয়৷ সিরীয়ায় গৃহযুদ্ধ কতটা বিভৎস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং সিরীয়রা কতটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, তার এক প্রতীক হয়ে ওঠে ছবিটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Aleppo Media Center
অজানা নতুন ঠিকানা
গ্রিক-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্তের ইডোমিনিতে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাঁটছেন এক সিরীয় নাগরিক৷ ইউরোপে তাঁর পরিবার নিরাপদ থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁর৷ ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, একজন শরণার্থী প্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেন, সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে৷ ফলে যারা আরো ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Y. Behrakis
সহযোগিতার আশা
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রবেশের কারণে জার্মানি অভিবাসন নীতি আরো কড়া করে ফেললেও এখনো শরণার্থীদের প্রথম পছন্দ জার্মানি৷ ইউরোপের আর কোনো দেশ জার্মানির মতো এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী নেয়নি৷ ২০১৫ সালে সঙ্কট শুরুর পর থেকে দেশটি ১২ লক্ষ শরণার্থী নিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা
ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা চলতি বছর কমেছে, তবে থেমে যায়নি৷ বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে অনেকে৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর এখন অবধি সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে প্রায় দু’হাজার মানুষ৷ গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
10 ছবি1 | 10
সত্য প্রকাশ করা নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের একটি নৈতিক দায়িত্ব৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত - কিংবা অপ্রকাশিত - তথ্য সমাজে বিতর্কের দিক নির্ধারণ করে দেয়৷ সেজন্য জার্মান গণমাধ্যমকে একটি নৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করতে হয় এবং তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সর্বজনস্বীকৃত একটি প্রেস কোড মেনে চলে৷
ঐ প্রেস কোডে বলা হয়েছে, একটি সহিংস অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির ‘অরিজিন' অর্থাৎ তাঁর পরিচয়, গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে, যদি এই তথ্য ‘কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয় কিংবা এর সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের আইনসঙ্গত স্বার্থ জড়িত থাকে'৷
সুতরাং অভিযুক্ত যখন ইরিত্রিয়ার নাগরিক তখন কীভাবে এই প্রেস কোড মানা হবে? ডিডাব্লিউর কি এ নিয়ে প্রতিবেদন করা উচিত?
২০১৫ সালে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল শরণার্থীদের জন্য জার্মানির দরজা খুলে দেয়ার পর থেকে জার্মানি পরিবর্তিত হয়ে গেছে৷ কিছু জার্মান আছেন, যাঁরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন৷ ‘বিদেশিদের' কারণে জার্মানি হুমকির মুখে রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা৷ ফলে একজন শরণার্থী যখন কোনো অপরাধ করেন সেটিকে তাঁরা তাঁদের সেই দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন৷
তবে এমন জার্মানও আছেন যাঁরা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের আরও ভালো সেবা দেয়া দরকার বলেও মনে করেন৷
জার্মানির রাজনীতিবিদদের একটি অংশও ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতির বিরুদ্ধে জনমতকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন৷
এমন পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে৷ সেটি হচ্ছে, কখন গণমাধ্যমের অভিযুক্ত ব্যক্তির জাতীয়তা প্রকাশ করা উচিত? এবং কখন এই তথ্য ‘সাধারণ নাগরিকের আইনসঙ্গত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট' বিষয় হয়ে ওঠে৷
জার্মানি একটি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ একদিকে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হচ্ছে, অন্যদিক একটি উন্নত দেশের পরিচয় ধরে রাখার বিষয়ও রয়েছে৷ এছাড়া গত কয়েক দশকের সামাজিক উন্নয়ন (যেমন লিঙ্গ সমতা) রক্ষায় কোথায় এবং কীভাবে একটি স্পষ্ট রেখা টানতে হবে, তা বুঝে উঠতে পারছেনা জার্মানি৷
এই অবস্থায় সত্য ও নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে জার্মানির এমন সমস্যা তুলে ধরতে হবে৷ ফলে বিতর্কিত ব্যক্তিদের মন্তব্যও আমাদের প্রকাশ করতে হবে৷ তাঁদের ভয়, আশঙ্কা এবং তাঁরা কার বিরুদ্ধে লড়তে চায়, তা বুঝতে হবে ও প্রচার করতে হবে৷
ফ্রাঙ্কফুর্টে শিশু হত্যার ঘটনা জার্মানিতে শরণার্থী সংক্রান্ত বিতর্ককে আরও উসকে দেবে৷ কিছু গণমাধ্যম শিরোনামের খাতিরে বর্ণবাদী মতবাদকে ইন্ধন জোগানোর মতো খবর প্রকাশ করবে, যা নিন্দনীয় এবং এর সঙ্গে প্রেস কোডে উল্লেখ থাকা ‘জনস্বার্থ' বিষয়টির সম্পর্ক নেই৷
অবশ্য ফ্রাঙ্কফুর্টের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির ইরিত্রিয়া থেকে আসার বিষয়টি যদি সত্যি হয় তাহলে দায়িত্বের কারণেই আমাদের তা প্রকাশ করতে হবে৷
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এমন তথ্য নিয়ে আলোচনার কারণে একজন শিশুর দুর্ভাগ্য ও তার পরিবারের প্রতি সবার সহানুভূতিশীল হওয়ার যে বিষয়, তা আড়াল হয়ে যায়৷