অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে উচ্চাভিলাষী ব্যয় বৃদ্ধির প্রথা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন বাংলাদেশের নতুন অর্থমন্ত্রী৷ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী৷
জাতীয় সংসদে আসছে অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রীছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিজ্ঞাপন
বাস্তবায়ন হোক বা না হোক বড় আকারের ব্যয় পরিকল্পনা, বিশাল রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা, প্রবৃদ্ধির উচ্চাশা; এমনটাই বাংলাদেশে বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল৷ এবার সেখানে কিছুটা হলেও ভিন্ন পথে হেঁটেছেন প্রথমবারের মতো বাজেট পেশ করা অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী৷ ছয় দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে নতুন বাজেট ঘোষণা করেছেন তিনি৷
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আসছে অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট বা ব্যয় পরিকল্পনা পেশ করেন৷ এটি বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি৷ তবে গত জুনে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন এটি তার চেয়ে সাড়ে চার শতাংশের কিছু বেশি৷ যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এই বৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ৷
তবু আড়াই লাখ কোটি টাকার ঘাটতি
অর্থমন্ত্রী যে ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছেন তার পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে সংগ্রহ করতে চান৷ এরমধ্যে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে আয়কর,মূল্য সংযোজন কর ও শুল্ক থেকে৷ বাকিটা আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতার বাইরে থাকা অন্যান্য কর বা সরকারের অন্য আয় থেকে৷
তারপরও ব্যয়ের পরিকল্পনায় দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থেকে যাবে, যা দেশের জিডিপির চার দশমিক ছয় শতাংশ৷ অবশ্য এটি বিগত বছরের তুলনায় কম৷
অর্থমন্ত্রীর আশা আসছে অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান বাবদ পাওয়া যাবে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা৷ ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার যোগান দেয়া হবে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি৷ দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে দুই দশমিক সাত শতাংশ বেশি৷
সরকার পরিচালনাতেই ৬৩ শতাংশ ব্যয়
যে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন তার পাঁচ লাখ ছয় হাজার ৯৭১ কোটি টাকা বা ৬৩ শতাংশই চলে যাবে সরকার পরিচলনায়৷ এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা থেকে, বিগত বছরে নেয়া ঋণ বা সুদ পরিশোধের মতো ব্যয়গুলো রয়েছে৷ এটি বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি৷
গত কয়েক বছর ধরে সরকারের ঋণের বোঝা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন অনেক অর্থনীতিবিদ৷ এবারও অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ৯৩ হাজার কোটি টাকা আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়েই ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চলে যাবে সরকারের৷
বাকি দুই লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা সরকার উন্নয়ন খাতে ব্যয় করবে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে সোয়া আট শতাংশ বেশি৷
এফএস/কেএম
কোন মেগা প্রকল্পে কত বিদেশি ঋণ
বিদেশি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের সরকার কয়েকটি মেগা প্রকল্প শেষ করেছে৷ আরও কিছু সমাপ্তির পথে৷ কয়েকটি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে৷ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে সিপিডি৷
ছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
রাশিয়া ১,১৩৮ কোটি ডলার দিচ্ছে ঋণ দিচ্ছে৷ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ এই ঋণের সুদের হার হচ্ছে, লাইবর রেট (একসময় বৈশ্বিক সুদহার নির্ধারণের অন্যতম মাপকাঠি ছিল লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফারড রেট বা লাইবর রেট) এবং সঙ্গে আরও ১.৭৫ শতাংশ৷ ইতিমধ্যে ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Abdul Goni/AFP/Getty Images
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ
এই প্রকল্পে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন৷ এই ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর৷ চলতি অর্থবছর থেকে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে৷
ছবি: Shamsul Haque Ripon
ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
প্রকল্পটিতে ১১২ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন৷ সুদহার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর৷ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৬ সালে৷
ছবি: Rehman Asad/NurPhoto/picture alliance
পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র
এই প্রকল্পে ১৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক৷ এই ঋণের সুদহার লাইবরের সঙ্গে ২.৯৮ শতাংশ৷ ৪ বছর গ্রেসসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ বর্তমানে এই ঋণের বিপরীতে প্রতিবছর ২৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে৷ ২০২৬-২৭ অর্থবছর নাগাদ তা ৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance
মেট্রোরেল
এই প্রকল্পের জন্য জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে৷ ইতিমধ্যে দুই কিস্তিতে প্রায় ৬৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে৷ ৩০ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কর্ণফুলী টানেল
এই প্রকল্পে ৬,০৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন৷ সুদসহ এটি ফেরত দিতে হবে৷ চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua/picture alliance
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৭ সালে এডিবির সঙ্গে ১৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল৷ ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালে৷
ছবি: Ehsan Kutubi
ভারতীয় ঋণগুচ্ছ
তিনটি লাইনস অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত ৭৩৬ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১৬৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে৷ এসব ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ ভারতীয় ঋণ পরিশোধের সময় পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছর৷ তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্প শেষ হয়েছে৷ চলমান আছে আটটি প্রকল্প৷
ছবি: Al-emrun Garjon/AP/picture alliance
ঋণ নিয়ে বিদেশি ঋণ শোধ
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গত ৪ এপ্রিল ঢাকায় ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন৷ এইসময় তিনি বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Patrick T. Fallon/AFP/Getty Images
দ্বিপক্ষীয় ও দাতা সংস্থার ঋণের পার্থক্য
চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে৷ আর বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং জাপানের মতো দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে সাধারণত ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে শোধ করার সুযোগ থাকে৷