আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু প্রতিপক্ষ নয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর সহিংসতা এড়ানোও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না, বুঝতে হবে তারা সুবিধাবাদী৷
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনের সময় অভ্যন্তরীণ কোন্দল মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে থাকবে বলে জানা গেছে৷ দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক এই বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ একটা বড় দল৷ এখানে অনেকেই মনোনয়ন চাইবেন৷ সবাইকেতো আর মনোনয়ন দেয়া যাবে না৷ তবে যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর দলীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানানো হবে৷ এই ধরনের কোন্দলে যিনিই জড়িত হোন না, তিনি যত বড় নেতাই হোন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''
‘সবাইকেতো আর মনোনয়ন দেয়া যাবে না’
সর্বশেষ শনিবার রাজধানীর মোম্মদপুর-আদাবর এলাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে৷ সেখানে গাড়ি চাপা পড়ে দুই কিশোর নিহত হয়েছেন৷ তাদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে৷ ওই এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক৷ এবার এখানে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন ঢাকা মহানগর (উত্তর) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান৷ এই দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল৷
আদাবর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাওসার আহমেদ জানান, শনিবার আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল৷ তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন৷ এখনও এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে৷ পুলিশ নজরদারি অব্যহত রেখেছে৷ নতুন করে সংঘাত এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে৷
‘নির্বাচনের আগে এমনটাই আমরা দেখে আসছি’
নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগে এমনটাই আমরা দেখে আসছি৷ আর আওয়ামী লীগের মত একটা বড় দলেরতো এই ধরনের সমস্যা হতেই পারে৷ তবে আমি মনে করি সবাইকে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে৷ যারা মানবেন না, বুঝতে হবে তারা সুবিধাবাদী৷ এদের ব্যাপারে নীতি নির্ধারকদের সতর্ক থাকতে হবে৷''
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনী উত্তাপ শুরু হয়েছে৷ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হচ্ছে৷ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার পক্ষে ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে৷
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার কম হয়নি৷ এমনকি ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় থেকেও যদি দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার আঘাত এসেছে৷ কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো স্থানীয় স্বার্থে৷
ছবি: bdnews24.com
ভারতভাগের পরপরই
ভারত ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে৷ এর পরপর পূর্ব বাংলার অনেক জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে৷ অনেকে বলে থাকেন যে, রাষ্ট্রীয় মদদে স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে৷ ১৯৪৯ সালে কালশিরা ও নাচোলে চলে বর্বরতা৷ এরপর ১৯৫০ সালে বরিশাল, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশ, পাকিস্তানি পুলিশ, আনসার বাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ চালায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
গুজব ছড়িয়ে হামলা
প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে বাঙালি হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয়েছে, যা এখনো দেখা যায়৷ তেমনই এক ঘটনা ঘটে ১৯৬৪ সালে৷ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত হজরতবাল নামক তীর্থক্ষেত্রে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি করা হয়েছে – এই সংবাদ ছড়িয়ে পূর্ব-বাংলায় আবারো সংগঠিত হয় বাঙালি হিন্দু হত্যা৷ আবারো হাজারো হিন্দু ধর্মাবলম্বী পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Mustafa
স্বাধীনতা আন্দোলনে
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়৷ তারা হিন্দু অধ্যুষিত অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে৷ একটি হিসেব বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা নেমে হয়েছে ২১ শতাংশ৷
ছবি: AP
বাবরি মসজিদের গুজব
ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশে৷ তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও৷ ১৯৯০ সালে হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে নির্মম নৃশংসতা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলে৷ এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত থেকে থেকে পুরো বংলাদেশেই হিন্দুদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
রাজনৈতিক হামলার শিকার
শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা অন্য স্থানীয় স্বার্থে নয়, রাজনৈতিক কারণেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ৷ যেমন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নির্দিষ্টভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা হয়৷ এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শুরুতেও ব্যাপক হামলা হয়৷ এসব হামলার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় নয় লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান৷
ছবি: bdnews24.com
নিস্তার পাননি অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা৷ এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক নিন্দিত হয়৷ ২০১৬ সালে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সাঁওতালদের৷ এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন সাঁওতাল মারা যান ও উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়৷ এছাড়া পাহাড়ে প্রায়ই নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়৷
ছবি: AFP/Getty Images
এখনো থেমে নেই
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ের পর হামলা করা হয় নোয়াখালীর অনেকগুলো হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়৷ অনেক মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া রংপুর বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে পরিকল্পনা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়েছে৷ এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন সারা দেশের মানুষ৷
ছবি: Khukon Singha
কত শতাংশ অবশিষ্ট?
কিছু হিসেবে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ ছিল সংখ্যালঘু৷ ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে তা ২২ শতাংশ৷ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে তা নেমে হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ৷ তবে সবশেষ ২০১৫ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো যে হিসেব দেখিয়েছে, তাতে হিন্দু ধর্মের মানুষের সংখ্যা ২০১১ থেকে বেড়েছে৷ ২০১৫ সালে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ সংখ্যালঘু রয়েছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW
শত্রু সম্পত্তি আইন
২০০৮ সালে অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতসহ আরো কয়েকজনের লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়৷ বইটির নাম, ‘Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property’৷ সেখানে লেখকরা বলেন, শত্রু সম্পত্তি আইনের ফলে ১৯৬৫-২০০৬ সময়কালে ১২ লাখ পরিবারের ৬০ লাখ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ এ সময় তাঁরা ২৬ লাখ একর ভূমি হারিয়েছেন৷
ছবি: bdnews24.com
হামলার বিচার হয় না
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ইতিহাস দীর্ঘ৷ কিন্তু হামলার বিচার এবং দোষীদের শাস্তির নজির নেই বাংলাদেশে৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
শনিবার ছিল মনোনয়নপত্র বিক্রির দ্বিতীয় দিন৷ এ দিন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া সাংবাদিকদের জানালেন, রবিবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম তুলবেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের (ওয়ানডে) অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান৷ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তাদের এ ব্যাপারে কথা হয়েছে বলেও জানালেন বিপ্লব৷ মাশরাফির নড়াইল থেকে আর সাকিবের মাগুরা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা আগেই প্রচার হয়েছে৷