অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখে সিরিয়ার আল-শারা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জাতিসংঘে বক্তৃতায় প্রশংসা কুড়িয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। তবে অভ্যন্তরীণ অমীমাংসিত সংকট এবং আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার ছায়া ফেলেছে।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টআহমেদ আল-শারার জন্য নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ তার রাজনৈতিক জীবন এবং দেশটির স্বীকৃতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
১৯৬৭ সালের পর এই প্রথম সিরিয়ার কোনো রাষ্ট্রপ্রধান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিলেন। জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে আল-শারা বলেন, "সিরিয়া বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে তার ন্যায্য স্থান পুনরুদ্ধার করছে।"
আসাদ পরিবারের ৫০ বছরের শাসনকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক শীতল ছিল। সাধারণ পরিষদে এতদিন রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাই সিরিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আহমদ আল-শারার নেতৃত্বে ইসলামপন্থি মিলিশিয়া হায়াত তাহরির আল-শাম অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এর ফলে প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। তখন থেকেই সিরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রকল্পের পরিচালক জুলিয়েন বার্নস-ডেসি ডিডাব্লিউকে বলেন, "বাস্তবিক উন্নতি এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক শক্তিকে নিজেদের লাভে রূপান্তর করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আহমদ আল-শারাকে খুব সচেতন বলে মনে হচ্ছে। কারণ, তিনি জানেন যে, তার সরকার এবং দেশের স্থিতিশীলতাই অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কিত।"
অভ্যন্তরীণ সংকট রয়ে গেছে
সিরিয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অব্যাহত থাকলেও আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এখনো চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে আল-শারা ইসরায়েলের নিয়মিত হামলার নিন্দা করে বলেছেন, "এটা সিরিয়া এবং তার জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।"
তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, সিরিয়া "সংলাপের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ", তবে সেই সঙ্গে এ-ও জানিয়েছেন যে, সিরিয়া শীগগিরই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার আলোচনা এখন কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা থেকে সরে এসেছে। বরং, একটি নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সিরিয়ার ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং ১৯৭৪ সালের অনাক্রমণ চুক্তি আবার কার্যকর করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। (আগের চুক্তিটিতে যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখা এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল)।
আল-শারা এই বছর তার শাসনামলে আলাউইত, খ্রিস্টান এবং দ্রুজ সংখ্যালঘুদের মতো ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত মারাত্মক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়টিও জাতিসংঘে উত্থাপন করেছেন। এই হামলায় সরকারি বাহিনী এবং মিলিশিয়া জোট জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘে আল-শারা বলেন, "আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, সিরিয়ার জনগণের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।" সিরিয়া তথ্য-অনুসন্ধান মিশন গঠন করেছে এবং জাতিসংঘকে হত্যাকাণ্ডের তদন্তের অধিকার দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক
সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সম্মান করার এবং সিরিয়ার বৈচিত্র্যময় জাতিগত ও ধর্মীয় গঠনকে প্রতিফলিত করে - এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন আল-শারা।
কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, সিরিয়ার আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের অভাব রয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ভোট পিছিয়ে ৫ অক্টোবর নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে তিনটি অঞ্চল থেকে দুই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বাদ দেওয়া হচ্ছে এই নির্বাচনে।
এছাড়াও বিতর্কের আরো কারণ রয়েছে। পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন না। বরং ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে এই নির্বাচন হবে।
সিরিয়ার নতুন পার্লামেন্টে মোট ২১০ টি আসন রয়েছে। ১২১টি আসনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা নির্বাচনি সংস্থাগুলোই প্রার্থী নির্বাচন করবে। মূলত, ১৪০টি আসনে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে দুই সংখ্যালঘু গোষ্ঠাকে বাদ দেওয়ার কারণে আপাতত তাদের জন্য বরাদ্দ ১৯টি আসন পূরণ করা হবে না। সংসদের অবশিষ্ট আসনগুলতে প্রেসিডেন্ট আল-শারা সরাসরি নিয়োগ দিবেন।
বার্নস-ডেসি সতর্ক করেছেন, "ধারণা করা হচ্ছে, আল-শারা তার নেতৃত্বে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার উপর মনোযোগ দেওয়ার ফলে সংখ্যালঘুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন পদ্ধতি এবং ক্ষমতার ভৌগোলিক ফেডারেলাইজেশনের সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে।"
আল-শারা তার বক্তৃতায় সিরিয়ার উপর নানা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, "তারা যাতে আর সিরিয়ার জনগণকে শৃঙ্খলিত না করে।" তিনি মনে করেন, সিরিয়া ‘সংকটময় রপ্তানিকারক'-এর জায়গা থেকে সরে এখন ‘সুযোগের' জায়গায় অবস্থান করছে। ফলে দেশটির আর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা অনেক নিষেধাজ্ঞাই এই বছরের শুরুতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা- ২০১৯ সালের সিরিয়া বেসামরিক সুরক্ষা আইন এখনো বহাল রয়েছে। এই আইনের আওতায় জারি করা নিষেধাজ্ঞাগুলো আসাদের অধীনে পূর্ববর্তী সিরিয়ান সরকার, তার মিত্র রাশিয়া এবং ইরানের অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছিল। তবে এই নিষেধাজ্ঞার স্থায়ী অপসারণ নির্ভর করছে মার্কিন কংগ্রেসের উপর।
বার্নস-ডেসি মনে করেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততারমাধ্যমে তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন, যা দেশটির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক প্রবাহ উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে।"
জরিপে আশাবাদের লক্ষণ
বার্লিনে হাইনরিখ বোল ফাউন্ডেশনের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের প্রধান বেন্টে শেলার ডিডাব্লিউকে বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত, সিরিয়ার পরিবর্তন এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বিশ্ব আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, "বিশেষ করে যখন কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো আমরা সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে সমর্থন করার সুযোগ পাবো, তখন জার্মানিতে সিরিয়ার রাজনৈতিক ফাউন্ডেশনের জন্য বিশেষ তহবিল ফুরিয়ে আসছে।"
শেলার আরো বলেন, "উন্নয়ন সহযোগিতা বাজেট এত ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে যে, আগামী বছরগুলোতে সিরিয়ার জন্য আমাদের কাছে খুব কমই তহবিল থাকবে।"
এর ফলে সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে সহযোগিতা করার একটি বিরল সুযোগ হারাতে হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন শেলার।
১৮ সেপ্টেম্বর সবশেষ আরব মতামত সূচক অনুসারে, ৬১ শতাংশ সিরিয়ান একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করেন। ২০১১ সালের গণতন্ত্রের দাবিতে যে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সেটা কঠোরভাবে দমন করতে গিয়েই গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। সিরিয়া জুড়ে গবেষণা চালানো বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবার সিরিয়ায় আশাবাদের এক নতুন অনুভূতির উত্থান দেখতে পাচ্ছেন তারা।
আরব মতামত সূচকের গবেষকেরা বলছেন, "৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সিরিয়া সঠিক পথে এগিয়ে চলেছে এবং বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই স্বস্তি, নিরাপত্তা, সুখ এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।"
সিরিয়ার সম্ভাব্য বিভাজন, বাইরের হস্তক্ষেপ, সিরিয়ার ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং স্থল আক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও উত্তরদাতারা ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী।
জেনিফার হোলাইস/এডিকে