হবিগঞ্জের বনাঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, সমরাস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় ধরণের হুমকি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা৷
বিজ্ঞাপন
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের পর মঙ্গলবার হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনাটিই সবচেয়ে বড়৷
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সেন্টার ফর পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ এর প্রধান মেজর জেনারেল এম মুনীরুজ্জামান (অব.) ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত যা খবর তাতে ঘটনা ভয়াবহ এবং গুরুতর৷ বাংকারে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ মজুদ করা হয়েছে এবং এটা একটি বড় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কাজ৷ আর এ থেকে প্রমাণ হয় বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তৎপর৷ ধারণা করা হয়েছিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের পর বাইরের বিচ্ছিন্তাবাদীরা এখানে আর নেই৷ তবে এখন তা ভুল প্রমাণিত হলো৷'' তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ফাঁক থাকার সুযোগ নিচ্ছে তারা৷ সরকার যেসব কথা বলছে তার সঙ্গে পুরো প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করছেনা৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সাম্প্রতিক ঘটনাও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে বাংলাদেশকে৷ মিয়ানমার যেভাবে স্থল এবং জলপথে মহড়া দিচ্ছে তাতে পরিস্থিতি অত সহজ মনে হয় না৷ সহজে পরিস্থিতি শান্ত হবে না৷''
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে আটক জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা উল্লেখ করে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যাপক ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন৷
মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘‘সংরক্ষিত সাতছড়ি বনাঞ্চলে যে বাংকার এবং যেধরণের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ মিলেছে তাতে এটাকে দীর্ঘদিনের ঘাঁটি বলে মনে হচ্ছে এবং এটা বিছিন্নতাবাদী গ্রুপের কাজ৷''
উল্লেখ্য, সাতছড়ি সীমান্ত ঘেঁষে থাকা বনে এক সময় ‘অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স' এটিটিএফ এর সদর দফতর ছিল৷ এই সংগঠনের সদস্যরা সাতছড়ি এলাকায় অপরহরণ এবং মুক্তিপণ আদায় করত৷ ২০১৩ সালের জুনে বাংলাদেশ এটিটিএফ এর প্রধান রঞ্জিত দেববর্মনকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করার পর সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়ে বলে জানা যায়৷
র্যাবের অভিযানে সেখানে এখন পর্যন্ত মোট সাতটি বাংকারের খোঁজ পাওয়া গেছে৷ এগুলো ৫০ থেকে ১০০ ফুট গভীর৷ সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রকেট লঞ্চার, ট্যাঙ্কবিধ্বংসী বিস্ফোরক, মর্টার শেল, রকেট লঞ্চারের চার্জারসহ সমরাস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷