নোবলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মুখে ‘হিন্দুত্ব', ‘হিন্দু ভারত', ‘গরু', ‘গুজরাট' – এই চার শব্দে আপত্তি৷ একটি তথ্যচিত্র আটকে দিল ভারতে চলচ্চিত্রের শংসাপত্র দেওয়ার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় পর্ষদ৷
বিজ্ঞাপন
নামে যদিও ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড, যাদের কাজ প্রতিটি চলচ্চিত্র দেখে, সেটি কোন বয়সের উপযুক্ত, সেই সার্টিফিকেট দেওয়া৷ কিন্তু কাজে তারা সেন্সর বোর্ডের থেকেও দড়৷ এই সেন্সরশিপের শিকার হলেন নোবেল পুরস্কার জয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিশ্রুত অধ্যাপক অমর্ত্য সেন৷ তাঁর সঙ্গে তাঁর ছাত্র কৌশিক বসুর কথাবার্তার ভিত্তিতে একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছেন অ্যামেরিকা প্রবাসী চলচ্চিত্রকার এবং নিজেও অর্থনীতির একজন অধ্যাপক সুমন ঘোষ৷ সেই কথোপকথনে ভারতের চলতি পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে অমর্ত্য সেনের বক্তব্যে প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছিল গোরক্ষা বিতর্ক এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার কথা৷ সেই নিয়েই আপত্তি তুলেছে সার্টিফিকেশন বোর্ড৷ পরিচালক সুমন ঘোষকে জানিয়েছে, ‘গরু', ‘হিন্দুত্ব', ইত্যাদি আপত্তিকর শব্দগুলি ‘বিপ' আওয়াজে ঢেকে দিতে হবে৷ তবেই ‘আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান' নামে ওই তথ্যচিত্রটিকে ভারতে মুক্তির ছাড়পত্র দেওয়া হবে৷
সুমন ঘোষ
এই চূড়ান্ত অপমানজনক সেন্সরশিপের মুখে দাঁড়িয়ে সুমন ঘোষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে তিনি একটি শব্দও আড়াল করবেন না৷ ডয়চে ভেলেকে সুমন জানালেন, এমনটা যে হতে পারে, তা তাঁর প্রত্যাশিত ছিল না৷ কিন্তু তিনি পিছিয়ে আসছেন না৷ আজকাল প্রেক্ষাগৃহে কোনো ছবির মু্ক্তি পাওয়া ছাড়াও একাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে, যেখানে বিনা বাধায় ছবিটি দেখানো যায়৷ তিনি প্রথমে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাবেন৷ তাতে যদি কাজ না হয়, তা হলে অনলাইনেই ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করবেন৷ না, এই নিয়ে আদালতে যাওয়া, বা মামলা করার কথা তিনি ভাবছেন না৷ প্রসঙ্গত, সুমনের এই তথ্যচিত্রটি এর আগে ইউরোপে এবং অ্যামেরিকায় দেখানো হয়েছে এবং অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে৷
মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে ভারতে বিক্ষোভ
পর পর কয়েকটি মুসলিম হত্যাকান্ডের পর হিন্দুত্ববাদীদের হিংস্র, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ক্রমশ জোটবদ্ধ হচ্ছে, রুখে দাঁড়াচ্ছে ভারতের নাগরিক সমাজ৷ তাদেরই প্রতিবাদ হলো দেশজুড়ে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Khanna
ভারতে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
সারা ভারত জুড়েই গো-হত্যা নিষিদ্ধ করার সরকারি ফরমান একটি উগ্রবাদী অপশক্তিকে যে আরও উৎসাহিত করেছে, তার প্রমাণ গেল কিছুদিনে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড৷ সবশেষ জুনায়েদ নামের এক তরুণকে প্রথমে ‘গোখাদক’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ বলে গালি-গালাজ করা হয়৷ তার পর একটা সময় ছুরি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে দেওয়া হয় চলন্ত ট্রেন থেকে৷ এসবের প্রতিবাদেই সমগ্র দিল্লিবাসী নেমে আসেন রাজপথে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Khanna
দিল্লিবাসী প্ল্যাকার্ড হাতে
সাবা দেওয়ান নামে এক তথ্যচিত্র পরিচালক প্রথম ডাক দেন, বুধবার সন্ধেয় দিল্লির যন্তরমন্তরে নীরব প্রতিবাদে সামিল হতে৷ তার ডাকে সাড়া দিয়ে গেল ২৮ জুন দিল্লিসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ৷ প্রতিবাদের শ্লোগান হিসেবে বেছে নেয়া হয়, ‘নট ইন মাই নেম’ বা ‘আমার নামে নয়’৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Khanna
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিরোধী প্রতিবাদ
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় অ্যামেরিকার শান্তিকামী মানুষ যে যুদ্ধবিরোধী স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই ‘নট ইন মাই নেম’ আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়, হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিরোধী নাগরিক প্রতিবাদের নয়া মন্ত্র৷ স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেওয়া, এই হত্যায় আমার সায় নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Khanna
কলকাতাও উত্তাল
একই বিক্ষোভে সাড়া ফেলে কলকাতার রাজপথেও৷ লেখক, কবি, শিল্পীরা ছাড়াও ছিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত'র মতো বিশিষ্টরা, যারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পক্ষে সরব হয়েছিলেন৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তাঁরা হাজির থাকলেন আগাগোড়া৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Das
সব বড় শহরে বিক্ষোভ
দিল্লির মতো মুম্বাইও ফেটে পড়ে বিক্ষোভে৷ ‘নট ইন মাই নেম’-এর পাশাপাশি হিন্দু ডানপন্থি সরকারের নিশ্চুপতার সমালোচনা করেও প্ল্যাকার্ড দেখা যায়৷ এছাড়াও পাটনা, পুণে, লখনউ, এলাহাবাদ, চণ্ডীগড়, জয়পুর, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কোচি, অর্থাৎ দেশের সব বড় শহরে বুধবার ধ্বনিত হয়েছে এই প্রতিবাদ৷
ছবি: picture.alliance/AP Photo/R. Maqbool
প্রিটোরিয়ার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
গেল ২০ মে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ার রাজপথ সরব হয় ‘নট ইন মাই নেম’ নামের প্রতিবাদে৷ এই প্রতিবাদটি ছিল পুরো দক্ষিণ আফ্রিকায় নারীদের হত্যা ও ধর্ষণের প্রতিবাদে৷ ছবিতে বিয়ের গাউন পরে এক নারীকে এই প্রতিবাদে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/W. de Wet
আইএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
এর আগে ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম হ্যাশট্যাগ দিয়ে ‘নট ইন মাই নেম’ প্রতিবাদটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়ায়৷ ব্রিটিশ এক তরুণী এই প্রতিবাদের উদ্যোক্তা৷ বিশ্বব্যাপী আইএসের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এই উদ্যোগটি নেয়া হয়৷
7 ছবি1 | 7
বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল এই সেন্সরশিপের ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, বিচলিত৷ কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘‘স্পর্ধা যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, এটা তারই লজ্জাজনক নজির৷'' অভিনেতা এবং কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি এর আগে সুমন ঘোষ পরিচালিত একটি কাহিনিচিত্রে অভিনয় করেছেন, তিনি বলেছেন, এ হলো চূড়ান্ত মূর্খামি৷ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য সেন্সর করতে চাওয়া মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘটনার খবর পেয়েই টুইট করে জানান, বিরোধিতার প্রতিটি কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে৷ এবার অমর্ত্য সেন!
পরের টুইটেই মমতা লেখেন, যদি অমর্ত্য সেনের মতো লোকও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে না পারেন, তা হলে সাধারণ নাগরিকের কী হবে!
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, চাইলেই সব কিছু মুছে দেওয়া যায় না৷ প্রসঙ্গ থাকলে প্রশ্ন উঠবেই৷ আর সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন বলেছেন, এই ঘটনা ভারতকে বিশ্বের দরবারে লজ্জিত করল৷ কারণ এতে প্রমাণ হবে, ভারতে বাকস্বাধীনতা বলে কিছু নেই৷
উল্লেখ্য, ভারতের বিজেপি সরকারের অমর্ত্য বিরোধিতা এই প্রথম নয়৷ কারণ বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতির কট্টর সমালোচক অমর্ত্য সেন একাধিক প্রসঙ্গে নির্ভয়ে বিরোধিতা করেছেন সরকারি নীতির৷ তাঁর সঙ্গে মতবিরোধের জেরেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা কমিটি থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয় মোদী সরকার৷ তারপরেও বিমুদ্রাকরণ থেকে গোরক্ষার নামে গুন্ডামি, একাধিক ইস্যুতে বিজেপি সরকারের প্রবল সমালোচনা করেছেন অধ্যাপক সেন৷ কিন্তু সেই রাগে এভাবে তাঁকে সেন্সর করার চেষ্টা হবে, এটা স্তম্ভিত করেছে মানুষকে৷
বন্ধু, এই অপমানজনক সেন্সরশিপের মুখে দাঁড়িয়ে সুমন ঘোষের কী করা উচিত? লিখুন নীচের ঘরে৷
অনেক হিন্দুও গরু বা মহিষের মাংস খান
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে থাকলেও ভারতে গরু বা মহিষের মাংস অনেকেই খেয়ে থাকেন৷ সে দেশে যত মানুষ গরু বা মহিষের মাংস খান তাদের মধ্যে সোয়া কোটিই হিন্দু৷
ছবি: AP
গরু কম, মহিষ বেশি
হিন্দু প্রধান দেশ ভারতে ধর্মীয় কারণেই গরুর মাংস কম খাওয়া হয়৷ তবে মহিষের মাংস খান অনেকেই৷ গরু এবং মহিষের মোট ভোক্তা প্রায় ৮ কোটি৷ ২০১১-১২-তে একটি জরিপ চালিয়েছিল ভারতের ‘দ্য ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস’ (এনএসএসও)৷ সেই জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
সাধারণ মানুষের মাঝে মাংস নিয়ে বিরোধ কোথায়?
জরিপ থেকে আরো জানা গেছে, যাঁরা গরু বা মহিষের মাংস খান তাঁদের বেশিরভাগই মুসলমান হলেও সেখানে সোয়া এক কোটি হিন্দুও এসব মাংস খান৷
ছবি: Getty Images/P. Guelland
সংখ্যাটা বাড়ছে
জরিপ থেকে আরো জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে গরু বা মহিষের মাংস খাওয়া বাড়ছে৷ এক কোটি মানুষের মধ্যে জরিপটি চালিয়েছিল এনএসএসও৷
ছবি: DW/S.Waheed
মাংস খাওয়ায় ভারত সবার পেছনে
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) ১৭৭টি দেশে সব ধরণের মাংস খাওয়ার হার সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ তালিকায় সবার নীচে রয়েছে ভারত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
রপ্তানিতে সবার আগে
এফএও-র তথ্য অনুযায়ী, গবাদি পশুর, বিশেষ করে গরু এবং মহিষের মাংসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারত৷ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং নগরায়ণের কারণে মানুষের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ তারপরও অবশ্য অন্য সব দেশের তুলনায় ভারতের মানুষ এখনো অনেক কম মাংস খায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Baumgarten
হিন্দুরা দ্বিতীয়
ভারতের মোট মুসলমানের মধ্যে প্রায় ৬ কোটি মুসলমান গরু বা মহিষের মাংস খান৷ সংখ্যার দিক থেকে তারপরেই রয়েছে হিন্দুরা৷ নিজেদের মোট সংখ্যার শতকরা হারের বিচারে মুসলমানদের পরেই রয়েছেন খ্রিষ্টানরা৷
ছবি: DW/S.Waheed
যাঁরা বেশি খান
মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি নিম্ন বর্ণের হিন্দু বা উপজাতিরাও যথেষ্ট গরু বা মহিষের মাংস খান৷ উচ্চ বর্ণের অনেক হিন্দুও গরু বা মহিষের মাংস পছন্দ করেন৷